অনুপ্রেরণাদায়ী তিন প্রবাসী মুখ

জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে-বিদেশে ভালো করছেন বাংলাদেশীরা। উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনা ও এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের কারণে জিতে নিচ্ছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদক। অনুপ্রেরণাদায়ী তিন প্রবাসী মুখ সম্পর্কে তুলে ধরা হলো—

মাশিয়াত লামিসা
হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
হংকং

চীনের একটি বিশেষ এলাকা হংকং। চীনের অংশ হলেও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে এ এলাকাটি। এখানে বাঙালির সংখ্যা হাতেগোনা। বিশ্বের তরুণ ইউনিভার্সিটি হিসেবে দ্বিতীয় হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এখানে অবস্থিত। এখানে কয়েকজন বাঙালি পড়াশোনা করছেন। মাশিয়াত লামিসা ছাড়া বাকি বাঙালিদের জন্ম এখানে। তারা ইংরেজি মাধ্যমে ও-লেভেল বা আইবিতে পড়াশোনা করেছেন। এখানে ভর্তির আবেদন করতে গিয়ে তাদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়নি। মাশিয়াত লামিসার বেলায় ঘটনাটি ছিল ব্যতিক্রম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানতই না, বাংলাদেশে এসএসসি ও এইচএসসি নিয়ে নিজস্ব কারিকুলাম রয়েছে। ভর্তির আবেদন করতে গেলে তার প্রতিটি বিষয়ের সিলেবাস পাঠাতে বলা হলো। বেশ ধৈর্য নিয়ে লামিসা তার প্রতিটি বিষয়ের কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রস্তুত করেছিলেন। কোনো কোনো বিষয়ের সিলেবাস ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠাতে হয়েছিল। তার ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশী কেউ ভর্তি হতে চাইলে তাকে আর সিলেবাস নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হবে না।

এখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হতে গেলে প্রয়োজন হয় এসএসসি এবং এইচএসসি অথবা ও-লেভেল এবং এ-লেভেলের ফলাফল, এসএটি, টোফেল অথবা আইইএলটিএসের ফলাফল। আবেদনপত্রের সঙ্গে দিতে হয় স্কুল শিক্ষকের সুপারিশপত্র।

এখানে ভর্তি হওয়ার কারণ হিসেবে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক এ শিক্ষার্থী জানান, ‘বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৩০তম এবং তরুণ ইউনিভার্সিটির তালিকায় দ্বিতীয়। এখানে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনার সুযোগ বেশি। ভিকারুননিসায় পড়াশোনার সময় আমি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। দেশের স্বনামধন্য একটি ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত ফিচার লিখতাম। এছাড়া বিভিন্ন এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের কারণে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দি জোসেফ লাউ লুয়েন হাং ট্রাস্ট স্কলারশিপ দেয়। এ স্কলারশিপের আওতায় আমি ১০০% স্কলারশিপ পাই।’

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুবিধা সম্পর্কে মাশিয়াত লামিসা জানান, ‘এখানে নিজের মেজর কোর্স নিজেই সাজানো যায়। ল্যাব সুবিধা অনেক ভালো। ক্যাম্পাসের পাশে সমুদ্রসৈকত। ইউনিভার্সিটির অবস্থান এবং পড়াশোনার পরিবেশ আমার বেশ পছন্দ।’

ইউনিভার্সিটিতে ঘটা একটি মজার ঘটনা শেয়ার করেন তিনি। প্রথম প্রথম ইউনিভার্সিটির পুরো এলাকা চেনা হয়নি। প্রথম দিনই কয়েকজন বন্ধু মিলে বাসে করে পাশের সমুদ্রসৈকতে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন পরে সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার প্রসঙ্গ এলে লামিসা বলল, তাহলে বাস নিতে হবে। বন্ধুরা বলল, এখান থেকে হাঁটা দূরত্ব। বাস লাগবে না। পরে দেখা গেল, সে যে হলে থাকে, তার কিছুটা দূরে সমুদ্রসৈকত। সেখানে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা গল্প করছে।

মাশিয়াত লামিসা জানান, বিদেশ থেকে উচ্চতর পড়াশোনা শেষে দেশে কাজ করতে চান তিনি।

অবন্তী বসাক
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্টা বারবারা
যুক্তরাষ্ট্র

অবন্তী বসাক তখন ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে পড়তেন। একদিন স্কুলে একটি সার্কুলার আসে। শিক্ষার্থীদের ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়। তখন বাংলাদেশে ফিজিকস অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা নতুন। সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অবন্তী জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াডের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাইল্যান্ডে যান। সেখানে জিতে নেন বেস্ট নিউকামার অ্যাওয়ার্ড এবং অনারেবল মেনশন অ্যাওয়ার্ড। সেখানে অংশ নেয়ার সময় অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করেন। তখন মাথায় আসে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে বিদেশে যাওয়ার। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবেদন করেন। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান। তবে তিনি বেছে নেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। এ নিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্বর্যাংকিংয়ে সেরা দশে সবসময় থাকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি।

অবন্তী বসাক ২০১২ সালে যোগ দেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে। ‘প্রথম প্রথম প্রিন্সটনে মন বসাতে পারতাম না। খুবই খারাপ লাগত। মন খারাপ করত। বাড়িতে ফোন করে কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এমন ছিল যে, বেশি দিন মন খারাপ করে থাকতে পারিনি।’ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেমিকন্ডাক্টর লেজার নিয়ে গবেষণা করেছেন অবন্তী। যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ার জন্য প্রয়োজন এসএটি, এসএটি সাবজেক্ট টেস্ট, রচনা, শিক্ষকের সুপারিশপত্রসহ প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলে তুমি কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও, তা তুলে ধরো।

বাংলাদেশে গণিত ও ফিজিকস অলিম্পিয়াড বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এসব অলিম্পিয়াডে মেয়েরা কম আসছে। কারণ হিসেবে অবন্তী জানান, ‘বাংলাদেশের অলিম্পিয়াডগুলোয় মেয়েরা কম অংশ নেয়। তারা এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের চেয়ে পড়াশোনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা ক্লাসে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করতে চায়। ইউনিভার্সিটি বা ক্যারিয়ারে ভালো কিছু করতে চায়। কিন্তু এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে না থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়তে হয়। আমি ঝুঁকি নিতে পছন্দ করতাম। এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের জন্য আমার পরিবার থেকে উৎসাহ দেয়া হতো।’

ছোটবেলায় নাচ করতেন অবন্তী। জাতীয় নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় উচ্চাঙ্গ নৃত্য ক্যাটাগরিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ফ্রেঞ্চ শিখেছিলেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সর্বকনিষ্ঠ ফ্রেঞ্চ শিক্ষক ছিলেন। ২০০৭ সালে ১৫ বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১২ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।

বর্তমানে অবন্তী বসাক পিএইচডি করছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্টা বারবারায়। গবেষণা করছেন নতুন কম্পিউটার আর্কিটেকচার ডিজাইনের ওপর। ভবিষ্যতে একজন ইন্ডাস্ট্রি রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হতে চান। একসময় যে মেয়েটি বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেনি, সে এখন অনেক বাঙালি মেয়ের উদাহরণ!

ইশরাত নাহের ইরিনা
ফ্রেডরিখ শিলার ইউনিভার্সিটি
জার্মানি

পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে তোড়জোড় চলছে বিশ্বে। কিছু দেশে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, আবার কিছু দেশে জনসংখ্যা কমছে। পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে সচেতন করতে তিন বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে হান্ড্রেড টোয়েন্টি আন্ডার ফোরটি প্রতিযোগিতা। অনূর্ধ্ব চল্লিশের ৪০ জন যুবককে তাদের পরিবার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত কাজের জন্য বিল গেটস ফাউন্ডেশন এবং জন হপকিন্স স্কুল অব পাবলিক হেলথ কর্তৃক সম্মানিত করা হয়। ২০১৬ সালে এ তালিকায় নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশী তরুণী ইশরাত নাহের ইরিনা। ইরিনা কাজ করেছিলেন সেক্স এডুকেশন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ নিয়ে। কড়াইল বস্তি, বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদের সচেতন করেছেন।

ইরিনা বড় হয়েছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। সেখানে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল সম্পন্ন করেছেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মেসি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের পাশাপাশি পড়াশোনায়ও মনোযোগী ছিলেন ইরিনা। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে যেন উন্নত বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করতে পারেন, সে বিষয়ে তার খেয়াল ছিল। তাই স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় থেকে ল্যাবে বসে কাজ করতেন। আন্তর্জাতিক জার্নালে যেন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, সেদিকে নজর রাখেন। শতভাগ বৃত্তির বিষয়েও মনোযোগী ছিলেন। এতে জার্মানির ফ্রেডরিখ শিলার ইউনিভার্সিটি তাকে মাস্টার্সে পড়ার জন্য শতভাগ স্কলারশিপ দেয়। ভর্তি হন বায়োকেমেস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার সেল বায়োলজিতে।

জার্মানিতে মাস্টার্সে ভর্তিতে পরামর্শ হিসেবে ইরিনা জানান, ‘এখানে ইংরেজি বা জার্মান- দুই বিষয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তির আবেদনের ক্ষেত্রে স্নাতকে পড়ার সময় থিসিসকে গুরুত্ব দেয়া হয়। তিনটি জিনিস দরকার হয়। প্রথমত. আগের পরীক্ষার ফলাফল। দ্বিতীয়ত. সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দ করার কারণ এবং তৃতীয়ত. ভাষা দক্ষতা প্রমাণের জন্য জিআরই, আইইএলটিএস অথবা জার্মান ভাষা পরীক্ষার ফলাফল।’
নাদিম মজিদ
বণিক বার্তা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.