‘অবয়বহীন’ নেতার সন্ধানে ভিয়েতনাম
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী।
কমিউনিস্ট দেশগুলোতে ব্যক্তিপুজার কথা কারো অজানা নয়। দেশ ও দলকে ছাপিয়ে একজন ব্যক্তিরই ‘সর্বময়’ হয়ে ওঠাটা তাদের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিহীন হলেও তা-ই হয়ে চলছিল। স্তালিন থেকে মাও জেদং, কিম ইল সুং থেকে ফিদেল ক্যাস্ত্রো Ñ সবাই এর একেকজন জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
এই ‘উদাহরণ’কে হটিয়ে এখন নতুন উদাহরণ সৃষ্টির পথে হাঁটতে চাইছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামেও এ রকম একজন ক্যারিশমেটিক নেতা ছিলেন Ñ হো চি মিন। ভিয়েতনাম এখন চাচ্ছে এমন নেতা, যিনি ঐকমত্যের ভিত্তিতেই দেশ ও দল চালাবেন। তার কোনোভাবেই ক্যারিশমেটিক নেতা হওয়া চলবে না, বরং তিনি হবেন খানিকটা ‘অবয়বহীন’।
শুধু চাওয়াই নয়, এই পথে আরো খানিকটা এগিয়েও গেছে ভিয়েতনাম। গত মাসের শেষ সপ্তাহে হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ওই দেশে কেউ শক্তিমান ও ক্যারিশমেটিক নেতা উঠলে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হচ্ছে ‘পতন’। ভিয়েতনামের রাজনীতিতে সফল হতে হলে নেতাকে কাজ করতে হবে সবার মতামত নিয়ে।
পার্টি কংগ্রেস এ লক্ষ্যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমত, পার্টির মহাসচিব ন্গুয়েন ফু ত্রংকে পাঁচ বছরের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো বহাল রেখেছে এবং দ্বিতীয়ত সংস্কারমনস্ক প্রধানমন্ত্রী ন্গুয়েন তান দুং-কে পার্টির যৌথ নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর ডানা ছেঁটে দিয়েছে পার্টি। কারণ, পার্টি নেতৃত্বের মতে, ‘তিনি তাঁর পদের চাইতে বড়’ হয়ে গেছেন।
ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসন কীভাবে কাজ করে, জানতে হলে এই যৌথ নেতৃত্বের বিষয়টি বুঝতে হবে।
আধুনিক ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠাতা হো চি মিনের মৃত্যুর পর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি ব্যাপক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে ব্যক্তিপুজার ধারণাটিকে এড়িয়ে চলতে থাকে। সেটা এমন যে, এমনকী ভিয়েতনাম যুদ্ধের বীর সৈনিক বো ন্গুয়েন গিয়াপ পর্যন্ত রাজনীতিতে যোগ দিলেও জীবদ্দশায় কোনো রাষ্ট্রীয় পদ পাননি। তাঁর পাওনা বলতে কেবল মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পাদন। এছাড়া দেশটির কোথাও তাঁর কোনো আবক্ষ মূর্তি বা ছবি পর্যন্ত দেখা যায় না। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু নেই, যদি ভিয়েতনাম এমন নেতাই চায়, যিনি পাদপ্রদীপের নিচে থাকেন না এবং পার্টি পলিব্যুরোর সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশ চালান।
প্রধানমন্ত্রী ন্গুয়েন তান দুং যেরকমই হোন, এরকম অন্তত নন। তিনি একজন ক্যারিশমেটিক নেতা এবং ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয়। মনে করা হচ্ছিল, সব মিলিয়ে ‘দলের চাইতে বড়’ হয়ে উঠছিলেন প্রধানমন্ত্রী দুং। দলের প্রবীণরা, যারা চান একজন ‘অবয়বহীন’ নেতাই পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশ চালাবেন, তাঁরা দুং-এর এই ভাবমূর্তিকে পার্টির আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করছিলেন না।
অতএব যা হওয়ার, তা-ই হলো। পার্টি কংগ্রেস ক্ষমতার ডানা ছেঁটে দিল দুং-এর। তাকে সরিয়ে দেয়া হলো পলিটব্যুরো থেকে।
এর ফল কী হবে? ভিয়েতনামে দুং-এর সূচিত অর্থনৈতিক সংস্কার কি বন্ধ হয়ে যাবে? যে চীনের বিরুদ্ধে তরবারি উঁচিয়েছিলেন দুং, সেই চীনের সামনে কি ফের নতজানু হবে ভিয়েতনাম? দুং-এর আমলের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি কি কমে আসবে? ভিয়েতনাম কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে?
সব প্রশ্নের উত্তর একটাই : না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী দুং ও পার্টি-মহাসচিব ত্রং-এর মধ্যে তফাৎ আদর্শের নয়, স্টাইলের। পার্টি কংগ্রেস শেষে গণমাধ্যমের কাছে দেয়া বক্তব্যে সে কথা খোলাসাও করেছেন ত্রং। বলেছেন, ভিয়েতনামে যদিও কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসনই চলে, কিন্তু আমরা গণতান্ত্রিক নীতিমালা মেনে চলি। আমাদের দলের নেতাদের জবাবদিহিতা আছে। এটা না থাকলে সব ভালো কিছুর কৃতিত্ব হতো কতিপয় ব্যক্তির, খারাপের দায়ও তাদের ঘাড়েই চাপতো। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াতো তার নাম বিশৃঙ্খলা।
ত্রং-এর কথার সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী দুং-এর দেশ পরিচালনার দিকে তাকানো যাক। তাঁর অধীনে ভিয়েতনামে মাথাপিছু জিডিপি তিন গুণ বেড়ে ২১০০ মার্কিন ডলারে পৌঁছে যায়। গত বছর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয় ছয় দশমিক সাত শতাংশ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় ১,৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া সস্তা শ্রমের কারণে দেশটি চীনের বিকল্প হিসেবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়।
একই সময় ভিয়েতনাম যোগ দেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ১২ দেশীয় ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপে। এ জোটের অন্যতম উদ্দেশ্য বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা হ্রাস। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেবমতে, এ জোট থেকে সবচাইতে বেশি লাভবান হবে ভিয়েতনাম।
এ সবই দুং-এর কাজ। এতসব সাফল্যেল পরও তাঁকে পদ হারাতে হচ্ছে। ছয় মাস পরই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন ন্গুয়েন সুয়ান ফুক।
ভাবী প্রধানমন্ত্রী কেমন মানুষ? পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তিনি কড়া ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ নন। তবে ভিয়েতনামে ব্যক্তিবিশেষের কোনো বড় ভূমিকা নেই। কারণ, এদেশ চলে যৌথ সিদ্ধান্তে। সেই যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পলিটব্যুরো এবং পার্টির মহাসচিব ত্রং ভালোমতোই জানেন যে অর্থনৈতিক সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, এর ওপরই পার্টির অস্তিত্ব নির্ভর করছে। আর সংস্কার চালিয়ে যেতে চাই বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ। প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতেও প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ব্যবসা। কারণ, সরকারি ও বেসরকারি Ñ উভয় ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই দুর্বল ও সমস্যাজর্জরিত।
প্রশ্ন উঠেছে, দুং-এর সূচিত সংস্কারকে কি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে নতু নেতৃত্ব?
এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তবে অনেকে বলছেন, দুং-এর বিদায় খুব-একটা খারাপ, তা’ কিন্তু নয়। এদের একজন আলেক্সান্দার এল. বুবিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে বসবাসরত বুবিং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভিয়েতনাম বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, বড় সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি থেকে খাজনা আদায়কারী একটি বিশাল চক্রের শীর্ষব্যক্তি ছিলেন দুং। এই চক্রে সরকারি আমলাতন্ত্রও জড়িত ছিল। কাজেই, তার অপসারণে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির সংস্কারের বাধা দূর হলো।
তাই কি? হবেও বা।
তবে নেতা ক্যারিশমেটিক বা অবয়বহীন Ñ যা-ই হোন না কেন, এটা পরিষ্কার যে, সরাসরি নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা ভিয়েতনাম নামের দেশটির নয় কোটি ৩০ লাখ মানুষের নেই এবং ৪০ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা কমিউনিস্ট পার্টি যতদিন থাকবে, ততো দিন ভিয়েতনামীরা এ ক্ষমতা পাবেও না।