আজও অশ্রুসিক্ত চোখে স্মরণ করি যাঁরে…

আজও অশ্রুসিক্ত চোখে স্মরণ করি যাঁরে…

বিউটি আকতার হাসু

প্রথিতযশা, স্বনির্ভর সাংবাদিককে শেষ জীবনেও নিজের ও স্ত্রীর ওষুধের জোগান দিতে চাকরি করতে হয়েছে। কারণ, সততা আর নিষ্ঠার বলে মহৎ এই ব্যক্তি সারাজীবনের পুঁজি মানুষের ভালোবাসা, কর্মজীবনের সঞ্চয় হিসেবে শুধু সুনাম কুড়িয়েছেন, খ্যাতি অর্জন করেছেন। মানুষের ভালোবাসার পাহাড় গড়লেও শেষ জীবনে বসে খাওয়ার মতো সঞ্চয়ও তার ছিল না। এমনকি যতটা প্রয়োজন ততটুকুও না।আতাউস সামাদ সাংবাদিক জগতে আগাগোড়া অনুকরণীয় একজন সৎ, আদর্শ সাংবাদিক। তিনি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলেন না, তিনি দেশের সম্পদ। এমন নিখাদ, নির্ভেজাল আর একজনের দেখা আদৌ মিলবে কি? আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে অশ্রুভেজা চোখে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি তাঁকে!

নিজেকে উজাড় করে যিনি শুধু দিতেই জানতেন, প্রতিদানের আশা কখনও করেননি এমন একজন মহান ব্যক্তিত্বের নাম- আতাউস সামাদ। যিনি আমরণ নিজেকে নিঃস্ব করে অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত থেকেছেন। নির্মোহ এই ব্যক্তিকে কোনো ধরনের লোভই কখনও স্পর্শ করেনি । লোভ, প্রতিহিংসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে এই ব্যক্তি বিবেকের তাড়নায় বলিষ্ঠভাবে কলম ধরেছেন খেটে খাওয়া, খেতে না পাওয়া মানুষের কথা ভেবে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের কালে, গণমাধ্যমের সম্প্রসারণ ও প্রসার বিস্তারের যুগে আরও বিভিন্ন ধরনের পত্রিকা আসবে, নতুন নতুন চ্যানেল খুলবে। এমনকি নতুন অনলাইন সংবাদ আসছে এবং আসবে। কিন্তু সাদা মনের বিশুদ্ধ চিন্তাশীল আতাউস সামাদ কি আর আসবেন?

সাংবাদিকতার আকাশে সামাদ স্যার কী শক্তিশালী জ্যোতিষ্ক ছিলেন তা শুধু দেশবাসী নয়, প্রবাসী বাঙালি ভিনদেশিরাও অবহিত। সে সম্পর্কে লেখার সাহস আমার নেই। তাঁর লেখনী শক্তি ও সাংবাদিকতার জ্ঞানের ভান্ডার সম্পর্কে কোনোকিছু লেখার ধৃষ্টতা দেখাতে আমি একেবারেই অপারগ।

তবুও তার সম্পর্কে দু’কলম লেখার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারলাম না। এতে হয়তো মনের গহীনে জমে থাকা কষ্ট সামান্যতম হলেও লাঘব হবে।Ahataus_samad

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২।যখন আমার এক শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সহকর্মীর কাছে ফোনে শুনলাম সামাদ স্যারের অবস্থা ভালো নয়, সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দুটি রোজা মানত করলাম- উনি যদি সুস্থ হয়ে ওঠেন দুটি রোজা রাখব। তারপরও কিছুতেই মনটা শান্ত হলো না। মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত লাগল, ভীষণ অস্থিরতাবোধ করলাম। ওজু করে এশার নামাজে বসলাম। নামাজ শেষ করে আমার এক বান্ধবীকে ফোন দিয়ে স্যারের জন্য দোয়া করতে বললাম। ওর সঙ্গে কথা বলে ফোন রাখতেই এনায়েত ভাইয়ের(সহকর্মী) ফের ফোন এলো- ‘স্যার আর নেই।’ কথাটি শুনে নিমিষে বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেল। চোখের পানি অনর্গল ঝরতে লাগল।

হাসপাতালে থাকা অবস্থায় যখন শুনি স্যারের একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে, তারপরও আশায় বুক বাঁধি, স্বপ্ন দেখি হুইল চেয়ারে বসেই তিনি আবার একদিনের জন্য হলেও অফিসে আসবেন, সেই নির্ভেজাল শিশুসুলভ হাসিমাখা মুখে কথা বলবেন। কে জানত আমার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে কান্নায় রূপান্তরিত হবে। সারারাত ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি। ২৭ সেপ্টেম্বর, অফিসে যাওয়ার সময় বাসে বসে কিছুতেই চোখের পানি লুকাতে পারছিলাম না। পাছে কেউ চোখের পানি দেখে ফেলে ভেবে লজ্জাও লাগছিল। কিন্তু কিছুতেই মন শান্ত রাখতে পারছিলাম না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি শরতের গুরুগম্ভীর মেঘলা আকাশ; অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। প্রকৃতিও যেন আমার ব্যথায় কাতর, চারপাশ কেমন চুপচাপ। এ অশ্রু বিসর্জন কোনো বিখ্যাত কলামিস্টের জন্য নয়। একজন নির্ভেজাল, নির্মোহ, সত্যিকার অর্থে খাঁটি ভালো মানুষের জন্য। তিনি সবসময় শিশুসুলভ নিষ্পাপ হাসি দিয়ে সবার ভালো-মন্দের খোঁজখবর নিতেন। এ অন্তরদহন এমন উদার, সরল মনের মানুষ হারানোর ব্যথায়। বেয়াড়া মন কিছুতেই বাধা মানছিল না। বার বার শুধু মনে হয়েছে,‘তিনি এভাবে হুট করে নীরবে চলে যেতে পারেন না।’ দয়া-মায়া, ভালোবাসার লোডশেডিংয়ের যুগেও তার জন্য এই ক্ষুদ্র বুকজুড়ে কত ভালোবাসা! কত শ্রদ্ধাবোধ! তিনি তা জানতেও পারলেন না। নীরবে চলে গেলেন। এমন সহমর্মী ও মানবিক গুণাবলির অধিকারী মানুষ আর দ্বিতীয়টি কোথায় পাব?

আজ মনের মধ্যে রাজ্যের কথা, স্মৃতি এসে ভর করছে। তিনি কোনো প্রয়োজনে কখনও পিয়ন দিয়ে ডেকে পাঠাতেন না, নিজেই উঠে এসে ডাকতেন- ‘একটু আসতে পারবেন?’ তার বিনয়ী আচরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এই মহান ব্যক্তির সামনে আমরা কতটা তুচ্ছ, নগণ্য। আদেশের সুরে কিংবা ধমকের সুরে তাকে আমি কখনও কথা বলতে শুনিনি। আমাকে ডেকে প্রায়ই (আমার পাতার) ‘নারী’ ও ‘আমার জীবন’ পাতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন, উপদেশ দিতেন, নানা ধরনের পরামর্শ দিতেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনীতি, তরুণ-প্রবীণদের সমস্যা, দেশ থেকে শুরু করে পরিবারের খুঁটি-নাটি বিষয়েও কথা বলছেন নির্দ্বিধায়। তিনি যখন আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, বোধ হয় ভুলেই যেতেন তার সামনে আমার মতো এক শিক্ষানবীশ বসা, যার প্রতিদিনের আপ্রাণ চেষ্টা নিজের নামের আগে ‘সাংবাদিক’ বিশেষণটি লাগানোর জন্য। তার সরলতা আর স্বভাবসুলভ হাসি দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যেত। চারপাশের অস্থিরতা, হত্যা, খুন, রাহাজানি মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ কমে যাওয়া নিয়ে বেশ ক’দিন কথা বলেছেন।2012

জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নিম্নবিত্ত মানুষের আহার-রুজির কথা ভেবে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে যেত। তিনি দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। তার চোখে-মুখে তখন হতাশার ছাপ (দেখা যাচ্ছিল) স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত। সহজ সরল, সাদামনের মানুষ চিন্তা-চেতনায় ও নিরপেক্ষ ভাবনায় আমৃত্যু দেশের মানুষের কল্যাণে লড়েছেন। তাই তো এই প্রথিতযশা, স্বনির্ভর সাংবাদিককে শেষ জীবনেও নিজের ও স্ত্রীর ওষুধের জোগান দিতে চাকরি করতে হয়েছে। কারণ, সততা আর নিষ্ঠার বলে মহৎ এই ব্যক্তি সারাজীবনের পুঁজি মানুষের ভালোবাসা, কর্মজীবনের সঞ্চয় হিসেবে শুধু সুনাম কুড়িয়েছেন, খ্যাতি অর্জন করেছেন। মানুষের ভালোবাসার পাহাড় গড়লেও (টাকার টিলাও গড়তে পারেননি) শেষ জীবনে বসে খাওয়ার মতো সঞ্চয়ও তার ছিল না। এমনকি যতটা প্রয়োজন ততটুকুও না। তাই তো ঈদে তার পছন্দের একটি পাঞ্জাবি ‘আড়ং’ থেকে কেনা হয়নি, ফেরত এসেছেন। দেশীদশ-এর ফ্যাশন হাউস থেকে কিনতে গিয়েও অনেক ঘুরতে হয়েছে, ভাবতে হয়েছে। তিনি অনেকটা গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন,‘আগে একজোড়া জুতা কিনলে কয়েক বছর পরা যেত, এক বছর ভালোভাবেই পরা যেত। কিন্তু এখন একজোড়া জুতা ছয়মাসও পড়া যায়না।’ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, এমন একজন দরদী সাংবাদিককে শেষ জীবনে এসেও ওষুধের টাকা জোগাড় করতে চাকরি করতে হয়েছে! নিজের পায়ের জুতা কেনার টাকা নিয়ে ভাবতে হয়েছে।যে কথা ভেবে আজও আমার দু’চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরে।স্যারের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তিনি যার সঙ্গে কথা বলতেন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন ভাবতেন। এই যে আপন করে নেয়ার দুর্লভ শক্তি, এটা বিরল। এ গুণ আমাকে বিমোহিত করত।

যখন ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় আগুন লাগার পর সুযোগ বুঝে অনেকে অন্যত্র পাড়ি জমালেন, আমাদের দীর্ঘ ১১ মাস বেতন বন্ধ ছিল। আমার সাড়ে তের মাস বকেয়া ছিল। সেই ক্রান্তিলগ্নে আমাকে আবদাল ভাই, হাফিজ ভাই ‘আমার জীবন’ ও ‘নারী’ পাতার দায়িত্ব দিলেন। আমাকে ১ বছর ৬ মাস একাই এ পাতা দুটি চালাতে হয়েছে। এজন্য আমাকে তিন দিন ডেকে শুধু একজন ব্যক্তিই সাধুবাদ জানিয়েছেন—তিনি সামাদ স্যার। তার মতো উঁচুমানের লোক যখন বলেন, ‘আমার দেশ’ পত্রিকার জন্য অনেক করেছেন, এ ঋণ শোধ করার নয়।’ আমার জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! এ সুখ রাখার জায়গা খুঁজে পাইনি। যার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ‘আমার দেশ’ পত্রিকাকে নতুন জীবন দিয়েছে, যিনি পত্রিকাটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর লড়াই করে গেছেন, যিনি নিজেকে নিঃস্ব করে ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়েছেন, যার স্নেহের কাছে আমরা অহর্নিশ ঋণী তার মুখে এমন কথা শুনে আমি লজ্জিত না হয়ে পারিনি, অপ্রস্তুত হয়েছি তো বটেই।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই স্যার ছিলেন সমান দক্ষ। অর্থ-বিত্ত, প্রাচুর্য কোনোকিছুর লোভই সামাদ স্যারকে টানেনি। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি কোনোকিছুর কাছেই নিজেকে বিক্রি করেননি। সামাদ স্যারের মতো দুর্লভ ব্যক্তিদের কেনা যায় না, অর্জন করতে হয়। তাই তো আতাউস সামাদ সাংবাদিক জগতে আগাগোড়া অনুকরণীয় একজন সৎ, আদর্শ সাংবাদিক। তিনি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলেন না, তিনি দেশের সম্পদ। এমন নিখাদ, নির্ভেজাল আর একজনের দেখা আদৌ মিলবে কি? আল্লাহ তাকে (সামাদ স্যারকে) জান্নাতবাসী করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.