অমর একুশে . . . . . .
আবার এসেছে অমর একুশে। মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত একটি দিন— শহীদ দিবস। একই সঙ্গে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও।
১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখরাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলে। ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে শহীদ হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ আরো অনেকে। বাঙালি জাতির জন্য দিবসটি চরম শোক ও বেদনার। একই সঙ্গে গৌরবেরও।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে জাতি। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদও। হরতাল প্রতিহত করতে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে বসেন ভাষা আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ। পরবর্তী দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না তা নিয়ে নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলায় ছাত্র সমাবেশের কর্মসূচি ছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা নিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, পরের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাবি আমতলার সমাবেশে এ বিষয়ে উপস্থিত ছাত্রদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে রাতেই অনেক ছাত্রনেতা পরের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ছাত্ররা আসতে থাকেন আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনের মাঠ)। বেলা ১১টায় বিস্ফোরণোন্মুখ ছাত্র-যুবকদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন- শামসুল হক, তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নওয়াজ চৌধুরী, শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, আব্দুল মতিন। ঘণ্টাখানেক সভার কাজ চলার পর সভাপতির বক্তৃতায় গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মত দেন। এতে সম্মতি দেন উপস্থিত সব ছাত্র-জনতা।
পাঁচজন করে ছাত্র বের হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হয়। ১০ জনের প্রথম গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আলী আজমল। তাকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। এভাবে দ্বিতীয় ১০ জনের গ্রুপটির নেতৃত্ব দেন ইসলামিক ভ্রাতৃসংঘের নেতা ইব্রাহিম তাহা ও আব্দুস সামাদ, তৃতীয় দলের নেতৃত্ব দেন আনোয়ারুল হক ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের পুলিশ ঘেরাও করে রাখে।
বেলা সাড়ে ৩টায় মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় প্রথম ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে পুলিশ। এতে ছাত্ররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিকেল ৪টায় মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলি বর্ষণে নিহত হন রফিকউদ্নি আহমদ (তার নাম মুহম্মদ সালাহুদ্দীন নিয়ে বিভ্রান্তি আছে)। রাত ৮টার পরে আহতদের মধ্যে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত ও গফরগাঁওয়ের আব্দুল জব্বার। সাংবাদিক মোদাব্বের সে সময় ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং একুশের ঘটনা জানতে পারেন। একুশের রাতে তিনি পুলিশের গাড়িতে ৯টি লাশ তুলতে দেখেছেন। ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় আটজন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। তবে পরে ইতিহাস অন্বেষণে ছয়জন শহীদের প্রকৃত নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। ওপরে যাদের নাম উল্লেøখ করা হয়েছে তারা বাদে অন্যরা হলেন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, নবাবপুর রোডের বাসিন্দা, সরকারি অফিসের পিয়ন আব্দুস সালাম।
কর্মসূচি : ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ছুটির দিন। এ দিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
এক তথ্যবিবরণীতে জানানো হয়েছে, দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতি রেখে মাদরাসাসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কুরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সব উপাসনালয়ে ভাষাশহীদদের রূহের মাগফিরাতের জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাজনক স্থানে বাংলা বর্ণমালাসংবলিত ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হবে। সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো একুশের অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সংলগ্ন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপন করা হবে।
দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, আর্কাইভস্ ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রন্থমেলা, আলোচনাসভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আবৃত্তি ও রচনা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।