‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
সংবাদপত্রের দায়িত্বশীলতা নিয়ে নানা মন্তব্য এবং দায়িত্বশীল হবার নসিহত সময়ে-সময়ে আমাদের নেতানেত্রীরা করে থাকেন। ‘দায়িত্বহীন’ সংবাদপত্রগুলোই আবার সেসব মন্তব্য ও উপদেশামৃত যত্নসহকারে ছাপায়।
ছাপায় বটে, তবে এসব মন্তব্য ও উপদেশ শ্রবণে মিডিয়া সংশ্লিষ্ট লোকজন-যে বিলক্ষণ কৌতুক অনুভব করে কিংবা কখনো বিরক্ত হয়, নগণ্য একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বিষয়টি আমারও জানা। এই বিরক্তি ও কৌতুকের কারণ, উপদেশ বর্ষণকারী ব্যক্তি ও তার দল-গোষ্ঠীর দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে মিডিয়া পিপলের চূড়ান্ত অনাস্থা।
আস্থা-অনাস্থার এই বিতর্কটি উপস্থিত মুলতবি থাক। আপাতত দায়িত্বশীলতা নিয়ে খানিকটা আত্মসমালোচনা করি। প্রথমেই বলি, নেতানেত্রী কিংবা বিদ্বজ্জনের উপদেশের কারণে বা তাদের উষ্মা দর্শনে নয়, এমনিতেই মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমাদের মিয়িা (আমি প্রিন্ট মিডিয়ার মানুষ বলে মিডিয়া বলতে এস্থলে শুধু প্রিন্ট মিডিয়াকেই বোঝাতে চাই) কি সবসময় দায়িত্বশীল থাকতে পারি?
প্রশ্নটি কিছুদিন আগে আমার মনে নতুন করে জাগ্রত হয়। এর পেছনে আছে দৈনিক ‘যুগান্তর’-এ ফলাও করে প্রকাশিত একটি খবর। খবরটিতে বলা হয়েছে, প্রস্তরযুগীয় খেলা ‘তাহারুশ জামা-ই’ আরব দুনিয়ায় বহুকাল ধরে প্রচলিত ছিল, এখন তা ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ছে। ‘তাহারুশ জামা-ই’ হচ্ছে গণধর্ষণের খেলা।
এরপর খবরে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে ঘৃণ্য এ খেলাটির- কোথায়, কীভাবে এটি ‘খেলতে’ হয়। কীভাবে অপকর্মটি সেরে পালাতে হয়। পুরো বিবরণটি পড়ে মনে হবে না এটি চরম ঘৃণ্য একটি কাজ, বরং মনে হবে যেন একটি শিল্প।
পড়তে-পড়তে প্রশ্ন জাগে, এটি কি খবর? খবর যদি হয়ও তা-কি আমাদের দেশে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা খুব দরকার ছিল। এতো বিশদ বিবরণ দেয়াই বা কেন? পশ্চিমা দেশে একটা নতুন খেলা চালু হয়েছে, তাকে এ দেশে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তোলাই কি এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের কারণ?
জানি, যারা বিদেশি বার্তা সংস্থার ইংরেজি কপি থেকে খবরটি বাছাই করেছেন, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত পত্রিকার পাতায় ছাপার অনুমোদন দিয়েছেন, তারা উপরের প্রতিটি প্রশ্নের একাধিক জবাব দিতে, যুক্তি দেখাতে ও তর্ক করতে পারবেন। অধম সর্ব অর্থে অতিশয় দুর্বল ব্যক্তি। কোনো যুক্তি-তর্কের মোকাবেলা আমার পক্ষে প্রায়-অসম্ভব। তাই দুর্বল যক্তি দেখাই, এদেশের পত্রপত্রিকায় এক সময় কোনো নারীর সম্ভ্রমহানির খবরে ‘ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ’ দেয়া হতো। তা পড়ে পাঠকের মনে দুষ্কর্মের হোতার প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভের পরিবর্তে ষড়রিপুর প্রথমটি অধিকতর জাগ্রত হওয়াই স্বাভাবিক বলে অনেকে বলতেন। সংবাদকর্মীরা এখন আরো বেশি সচেতন। ফলে ওই প্রবণতাটি এখন নেই বললেই চলে।
কিন্তু আলোচ্য সংবাদটি পড়ে মনে হলো, আমাদের কারো-কারো মধ্যে প্রবণতাটি প্রখনো বুঝি সক্রিয়। তা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আপন মনের নিভৃত বিকৃতি প্রকাশের মাধ্যমে নিশ্চয়ই সংবাদপত্র নয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, বিকৃতির এই অসতর্ক প্রকাশটি ঘটেছে একটি পাঠকপ্রিয় দৈনিকে। এই পত্রিকাটি প্রতিদিন লাখো পাঠকের হাতে যায়। নানা বয়সের মানুষ পত্রিকাটির পাঠক। এই দূষিত ও সংবাদমূল্যহীন সংবাদটিও নিশ্চয়ই অনেকে পড়েছে। সেই পাঠকের মধ্যে তরুণ ও যুবারাও আছে। তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশও যদি এর মধ্য দিয়ে নতুন দুষ্কর্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত এবং তা প্রয়োগে উৎসাহিত হয়, তার দায় একটুও কি মিডিয়ার ঘাড়ে চাপে না?
লেখাটি এখানেই শেষ করতে চাই। তার আগে বলি, আমি নিজেও একজন সংবাদকর্মী। তাই শুরুতেই বলেছি, এ নেহাৎ আত্মসমালোচনা। আলোচ্য খবরটি যে-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, দৈনিক যুগান্তর, আমি তার নিয়মিত পাঠক। প্রতিদিন ভোরের আলোয় চোখ মেলে যে-ক’টি পত্রিকার পাতা ওল্টাই, যুগান্তর তার অন্যতম। একটি রুচিশীল, জনপ্রিয় দৈনিকে কোনো রকম অসতর্কতায়ও যেন এরকম বিচ্যুতি ঘটতে না-পারে, সেদিকে যুগান্তর ও অন্য সকল পত্রিকা ও সংবাদকর্মীর (আমি নিজেও) দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এ বাগবিস্তার। এ কেবলই শতাব্দীকাল পূর্বেও হুতোম রচিত ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ গ্রন্থের দুর্বল অনুকরণে আত্মসমালোচনা।
আশা করি, ‘পূজনীয় পাঠকগণ বেয়াদবী মাফ্ কর্ব্বেন।’