‘আব্বার মতো বন্ধু কেউ হতে পারেনি’

‘আব্বার মতো বন্ধু কেউ হতে পারেনি’

বাঙালির প্রাণের শিল্পী আব্বাসউদ্দীন, বাংলার লোকসংগীতের কিংবদন্তি তিনি। তার গান মানেই সাধারণের মনের ভাষা সুরে-দরদে উপস্থাপন। আজ এ শিল্পীর ১১৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আত্মজা ফেরদৌসী রহমান বলেছেন বাবাকে নিয়

সব সন্তানের কাছেই তার বাবা সবচেয়ে ভালো। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আমার আব্বা সত্যিই অন্য রকম, খুবই অসাধারণ একজন মানুষ। এ বয়সে এসে যখন তাকে ব্যক্তি হিসেবে দেখি, তখন মনে হয় এমন মানুষ খুব কমই হয়। তিনি একজন আদর্শ পিতা ছিলেন। বাবা হিসেবে তিনি যে খুব কড়া ছিলেন, তা নয়। তিনি বন্ধুর মতো করে আমাদের বড় করে তুলেছেন। এখনো অনুভব করি, আমার আব্বাই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তাকে হারানোর এত দিন পরও মনে হয়, আমি আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়েছি। এই জীবনে আব্বার মতো বন্ধু কেউ হতে পারেনি। সন্তানের কাছে বাবা যে এত বড় বন্ধু হতে পারে, তা এই সময়ের ছেলেমেয়েরা ভাবতেই পারে না। হতে পারে দৈনন্দিন ব্যস্ততার কারণে এ সময়ের মা-বাবারা তাদের সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। কিন্তু আমার বাবাও তো প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। একাধারে তিনি চাকরি, গানবাজনা করতেন, বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। তার পরও আমাদের প্রতি তার কর্তব্য পালনে তিনি এতটুকু অবহেলা করেননি। একাধারে তিনি আমাদের ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন আবার শাসনও করতেন। একটি জিনিস না বুঝলে তিনি এমনভাবে বুঝিয়ে দিতেন, যেটা মজ্জার ভেতর গেঁথে যেত।

‘আব্বার মতো বন্ধু কেউ হতে পারেনি’বাবার হাত ধরেই এই সঙ্গীতের পথে এসেছি। এখন তার হাত ধরতে পারছি না। কিন্তু তার শিক্ষা, প্রত্যাশা, লক্ষ্যগুলো পূর্ণ করতে এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাবা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, সবার কাছে সারাক্ষণ বলতেন, ‘আমার মা (ফেরদৌসী রহমান) অনেক ভালো গান করবে, অনেক বড় হবে।’ তার সেই স্বপ্নগুলো আমাকে এমনভাবে তাড়িত করে যে, সেই পথে না হেঁটে উপায় ছিল না।

খুবই মজার ব্যাপার হলো, আব্বাকে এখন ‘পল্লীগীতি সম্রাট’ বলে ডাকা হলেও তার সংগীতজীবনের শুরুটা হয়েছিল আধুনিক গান দিয়ে। তবে সত্যিই তিনি পল্লীগীতি সম্রাট। কারণ তিনি গ্রাম থেকে খুঁজে খুঁজে গান এনেছেন, সেগুলোকে গ্রামীণ উপাদানে সাজিয়ে শহরের মানুষের মাঝে ছড়িয়েছেন। এগুলো করতে গিয়ে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন, অনেক লড়াই করেছেন। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তিনিই প্রথম সংগীতশিল্পী, যিনি গ্রাম থেকে গান এনে এ দেশের সবার কাছে তুলে ধরেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে তার অনুপস্থিতি আমাকে ভাবায়। কোনো সন্তানের কাছেই বাবা-মা চিরকাল থাকে না। আমার বাবাও চলে গেছেন। কিন্তু এমন একটা সময়ে আমি তাকে হারিয়েছি, যখন তাকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, ক্যারিয়ার কেবল শুরু। যখন একটু একটু করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি কিংবা যখন কোনো পুরস্কার পেতাম বা ভালো গান করে সবার কাছ থেকে প্রশংসা শুনতাম, তখন আব্বাকে অনেক বেশি অনুভব করতাম। সবসময়ই ভাবি, ইশ! এই সফলতা যদি আব্বা দেখে যেতে পারতেন, কি খুশিই না হতেন। এগুলো তো তারই স্বপ্নে বোনা ফসল।

শুধু তাই নয়, ভালো কিছু করতে গেলে এখনো তার কথা মনে পড়ে। এখনো যত প্রশংসাই শুনি না কেন, আমার কাছে এসব কিছুই মনে হতো না যদি আব্বা এসে আমাকে বলতেন, ‘মা ভালো হয়েছে।’ উনি আমার সব অনুষ্ঠান দেখলে হয়তো আরো ভালো কিছু শিখতে পারতাম।

(অনুলিখিত)

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.