আমনেও দাম পাচ্ছে না কৃষক
২০১৩ সালে প্রতি কেজি আমন ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ১৭ টাকা ২ পয়সা। গেল বছর কেজিপ্রতি ধান উৎপাদনে ব্যয় ১৮ টাকায় দাঁড়ায় বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে উঠে এসেছে। এ হিসাবে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৭২০ টাকা। এ সময় প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। এ হিসাবে ধান উৎপাদন করে কৃষক মণপ্রতি লোকসান দিয়েছেন ১২০ থেকে ২২০ টাকা। বাড়তি ব্যয়ে সেচ দিয়ে বোরো চাষ করে চাষিরা লোকসান দিয়েছেন আরও বেশি। চলতি বছর শ্রমিকের মজুরি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ধানের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কেজিপ্রতি ধান উৎপাদনে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। আমন সংগ্রহের মৌসুম পুরোদমে শুরু হতেই ধানের দাম নেমে এসেছে ৫০০ টাকার মধ্যে। বোরোর পর এবার আমন ধানেরও নায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষক অনেকটাই দিশেহারা। দেশজুড়ে খবর নিয়ে জানা গেছে, ক্রমাগত লোকসান গুনে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক। এর ফলে কয়েক বছর ধরেই কমে আসছে ধান চাষের আওতায় জমির পরিমাণ। তবে একই জমিতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মোটের ওপর চাল উৎপাদন কমছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানেও বিষয়টি উঠে এসেছে। দীর্ঘদিন লোকসান দিয়ে ধান উৎপাদন কৃষকের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে তারা মনে করেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ৫ বছরে কেজিপ্রতি আমন ধানের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৫ টাকা ৪৬ পয়সা। বোরো ধানের কেজিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৬ টাকা ৭৮ পয়সা। শতকরা হিসাবে ধানের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২৯ থেকে ৩৪ শতাংশ। ২০০৯ সালে প্রতি কেজি আমন ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ১৩ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৪ সালে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮ টাকায়। ২০০৯ সালে প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে ব্যয় হয় ১৩ টাকা ৩২ পয়সা। ২০১৪ সালে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ টাকা।
ধানের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, আমন মৌসুমে ১ বছরে দৈনিক কৃষি শ্রমিকের মজুরি ২৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। বীজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১ টাকা। বোরো উৎপাদনে প্রতি একর জমির সেচ ব্যয় ১ বছরে বেড়েছে ৭০০ টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ কয়েকটি মৌসুমে দেশে ধান চাষের জমির পরিমাণ কমেছে। গেল বছর আমন মৌসুমে ৫৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার হেক্টর বেশি। আগের বছর সমান জমিতে ধান চাষ হলে গেল মৌসুমে ১ লাখ ৮০ হাজার টন চাল বেশি উৎপাদিত হতে পারত। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে ৪৮ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছিল। পরের অর্থবছরে ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরে বোরো ধান চাষ হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছর বোরোতে মাত্র ২০ হাজার হেক্টর বাড়িয়ে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক জেলায় আগের তুলনায় বর্তমানে ধান চাষ কম হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় কৃষকের কাছে খবর নিয়ে জানা গেছে, মৌসুমের সময় ধানকাটা শ্রমিকের অতিরিক্ত মজুরি ছাড়াও সার, বীজ, কীটনাশক ও জমি তৈরিতে যে খরচ হচ্ছে, ধান বিক্রি করে সে টাকা উঠছে না। ফলে কৃষক ধান চাষে প্রতিনিয়ত নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, কয়েক বছর ধরেই খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। ২৪ শতাংশের বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে, এমন দেশের জন্য বিষয়টা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে বাস্তবতা হলো এ সময় খাদ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে। কৃষক ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছেন। বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষক রক্ষার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের নাগালের মধ্যে স্বল্প মেয়াদে খাদ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করা যেতে পারে। সরকার ক্রয় কার্যক্রমের মাধ্যমেও কৃষককে সহায়তা দিচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে ধানের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, একই জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করতে পারলে ব্যয় কমে আসবে। অপচয় রোধের মাধ্যমেও উৎপাদন ব্যয় কমানো যেতে পারে। তাছাড়া ধানের বাণিজ্যিক চাষ ও নতুন উন্নত প্রযুক্তিও উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারে।
রাজশাহী ব্যুরোপ্রধান সোনা চৌধুরী জানান, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে আমন কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত শত শত দিনমজুর। স্থানীয় আাদিবাসী নারী-পুরুষও বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠে ধান কাটছেন। তবে এবার বৃষ্টির অভাবে অনেক ক্ষেতে ধানের ফলন ভালো হয়নি। শ্রমিকরা ধান কাটতেও অনীহা প্রকাশ করছেন। ফলন কম ও বাজারে ধানের দাম ভালো না থাকায় কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমন চাষিরা হতাশ হয়েছেন। চলতি বছর এ অঞ্চলে কৃষক এবার সুমন স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা ও সাদা স্বর্ণা বেশি চাষ করেছেন। এবার এসব ধান বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ১৩ মণ ফলন হচ্ছে, যা গেল বছর ১৬ থেকে ১৮ মণ পর্যন্ত হয়েছে। তবে ফলন কম হওয়ার পেছনে সময়মতো বৃষ্টি না হওয়াকে দায়ী করছেন কৃষক। রাজশাহীতে বাজারে নতুন ধান প্রতি মণ (৪০ কেজি) সুমন স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা দরে। আগের বছরের তুলনায় এ দাম অনেক কম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক নিত্যরঞ্জন বিশ্বাস আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ধান চাষ কমিয়ে কৃষক সবজিসহ অন্য আবাদ করছেন। তবে তারা বৃষ্টি মৌসুমের আমন চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করে বোরো বা ইরি চাষ কমানোর পরামর্শ দেন। কারণ বোরো ধান সেচনির্ভর এবং এতে উৎপাদন খরচ বেশি।
বগুড়া সংবাদদাতা গনেশ দাস জানান, বগুড়ার হাটবাজারে নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু বাজারে ধানের দাম না থাকায় কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। ফলে নতুন ধান পেয়ে কৃষকের মুখে হাসি নেই। জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় ধান কাটা-মাড়াই শুরু হলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পূর্বাঞ্চলে ধান কাটা শুরু হতে সময় লাগবে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন। বুধবার বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে বিনা-৭ জাতের নতুন ধান বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৫৭০ থেকে ৫৯০ টাকায়। নন্দীগ্রামের রিধইল গ্রামের কৃষক আবদুল বাছেদ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ২৬ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করে এখন খরচ উঠছে না। ধান আবাদ করে একদিকে হাতে টাকা নেই, অন্যদিকে হাটে ধানের দাম নেই। তারপরও সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে ৬ বিঘা জমির ধান ৫৭০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হয়েছে।
শরীয়তপুর সংবাদদাতা এস এম মুজিবুর রহমান জানান, আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত এখন শরীয়তপুরের কৃষক। তবে খরচের তুলনায় ধানের বাজার মূল্য কম হওয়ায় লোকসানের মুখে তারা। একদিকে ধানের মূল্য কম, অন্যদিকে শ্রমিক সঙ্কট ও বেশি মজুরি কৃষকের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর শরীয়তপুর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক কম পরিমাণ জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়েছে।
জামালপুর সংবাদদাতা সাইদ পারভেজ তুহিন জানান, জামালপুরে রোপা আমন ধান কাটার কাজ চলছে পুরোদমে। যদিও বন্যার কারণে জেলায় রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ বিষয়ে জামালপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, এবার রোপা আমনের ফলনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বন্যাপরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি, চড়া শ্রমবাজার এবং ধানের বাজারমূল্যের সমন্বয়হীনতা কৃষকের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে।
মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা এ এস এম সাইফুল্লাহ জানান, উৎসবমুখর পরিবেশে আমন ধান কাটা চলছে। এ বছর বাম্পার ফলন হওয়ায় তাদের চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি। তবে ধানকাটা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোঃ আলীমুজ্জামান জানান, গেল বছরের চেয়ে এবার ফলন অনেক ভালো। শ্রমিকের মূল্য বেশি হওয়ার পরও কৃষক সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা এস এম তফিজ উদ্দিন জানান, সিরাজগঞ্জসহ চলনবিল অঞ্চলে রোপা আমন ধান এখন পুরোদমে কাটা শুরু হয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষাণ-কৃষাণিরা ধান কাটা ও মাড়াই কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ নতুন ধান হাটবাজারেও উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু এ নতুন ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম না থাকায় কৃষকের মুখে হাসি নেই। তাদের চাষাবাদের খরচই উঠছে না। সংশ্লিষ্ট কৃষক ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এ চাষাবাদ করলেও ধানের দাম কম থাকায় এবং কাটা ও মাড়াই কাজে বেশি খরচ পড়ায় ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন। বিশেষ করে তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলার চলনবিল অঞ্চলে এবার এ আমন ধানের চাষাবাদ ভালো হলেও বাজারে ধানের দাম কম থাকায় কৃষকের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। জেলার হাটবাজারে নতুন আমন ধান ৫০০ থেকে ৫১০ টাকা, ব্রি-৩২ ধান ৫৪০ থেকে ৫৫০, বিনা-৭ ধান ৫৮০ থেকে ৬০০, পাইজাম ৬৭০ থেকে ৬৮০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
ভৈরব সংবাদদাতা মোঃ আল আমিন টিটু জানান, উপজেলার জোয়ানশাহী হাওরে প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষ ও ঘরে তোলা পর্যন্ত তার খরচ পড়েছে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ মণ। এর ফলে জমিতেই প্রতি মণ ধানের খরচ পড়েছে ৭০০ টাকা। বাজারে এ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।
কেশবপুর সংবাদদাতা জানান, ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় যশোরের কেশবপুরের কৃষকও এ ফসল চাষে অনীহা প্রকাশ করেছেন। গেল বোরো মৌসুমে ধানের ফলন আশাতীত হলেও বাজারে দাম কম থাকায় তারা হতাশ হন। চলতি আমন ধানে তিন মাস পরিশ্রমের পর স্থানভেদে তাদের বিঘাপ্রতি লোকসান গুনতে হয়েছে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।
– See more at: http://www.alokitobangladesh.com/first-page/2015/11/24/160663#sthash.ETDoC0hw.dpuf