আমাদের প্রাণের মেলা আরও প্রাণবন্ত হোক
রেজাউল করিম খোকন।
চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বছর ঘুরে বারবার আসে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ফেব্রুয়ারি মানেই রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আমাদের এই প্রাণের মেলার আয়োজন দীর্ঘদিন থেকেই জাতীয় সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেক বইপ্রেমী সারা বছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাস এবং এই মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার জন্য অপেক্ষা করেন। কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে মূল গ্রন্থমেলা কিছু সরে এসে পাশের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃহত্ পরিসরে বিস্তৃত আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতার ইতিহাসে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন চলে এলেও দিনে দিনে মেলায় আগত বইপ্রেমীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন রীতিমতো কঠিন হয়ে উঠেছিল। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতি বছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করেছে।
যত দিন যাচ্ছে ততই জমে উঠছে বাঙালির প্রাণের বইমেলা। এখন প্রতিদিন বিকেলে মানুষজনের ভিড়ে মুখরিত বাংলা একাডেমি প্রান্তর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এ যেন লেখক-পাঠকের এক মহাসমাবেশ। সেই সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের তুখোড় আড্ডায় জমে উঠছে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় মোড়ক উন্মোচিত হচ্ছে অনেক নতুন বইয়ের। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রবীণ প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় লেখকদের পাশাপাশি তরুণ নবীন লেখকদেরও বই আছে। মেলা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টলে দেখা যায় তরুণ লেখকদের নতুন বইই বেশি। লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধ গড়তে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতি বছর নতুন লেখকদের জন্য ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। আমাদের একুশের এই গ্রন্থমেলার ব্যাপ্তি আর আমাদের ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই, সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও আজ স্বীকৃত। যারা বইপ্রেমিক তারা সবাই এই বইমেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এই বইমেলা যারা সাহিত্যচর্চা করেন, যারা প্রকাশক এবং যারা বই পড়তে পছন্দ করেন সেসব ছোট্ট শিশু থেকে সব বয়সীর চমত্কার এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বিপুল বই প্রকাশিত হয়, যা প্রায় চার হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। বলা যায়, এই মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক নতুন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকের সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারি মাসের পুরোটা সময় ধরে চলে। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এতদিন ধরে চলে না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা।
এই মেলায় মানুষের আগ্রহ এতই বেশি যে শুধু প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকেও গ্রন্থপ্রেমী বাঙালিরা এতে অংশ নেন। কিন্তু বাংলা একাডেমির ভেতরে অনেক নতুন ভবন এবং অবকাঠামো তৈরি হওয়ার ফলে এখানে আর বইমেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান পাঠক দর্শনার্থীর কারণে বইমেলার পরিসর বাড়িয়ে এর একটি বড় অংশকে গত কয়েক বছর ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর ফলে অমর একুশের স্মৃতিবাহী এই মেলাটির ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটেছে। যে মেলা একুশের মহান ঐতিহ্যকে ধারণ করে এত বিশাল আকার করেছে, তা এখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এই স্থান থেকেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন। আরও আছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ও স্বাধীনতা জাদুঘর। তাই এখানে বইমেলা সম্প্রসারিত হওয়ায় বাংলাদেশের বাঙালির জাতিসত্তার উদ্বোধনের স্মৃতিবাহী একুশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা যুক্ত হয়ে মেলাটি এখন নতুন আঙ্গিক, পরিসর ও মাত্রিকতায় স্থিত হয়েছে বলা যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষাশহীদ বরকত, সালাম প্রমুখের বুকের তাজা রক্তে। স্বাধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে নামার উত্তাল সূচনা হয়েছিল তখন, যা ইতিহাসের নানা ক্রমধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে গড়িয়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নিয়েছিল। মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই দিনে দিনে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এদেশের মানুষকে। ভাষা আন্দোলনের নানা স্মৃতিবাহী বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে স্বাধীনতার লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জনের স্মৃতিবাহী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রসার আমাদের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রসার এবং স্থানান্তর সেই ইতিহাসেরই বহিঃপ্রকাশ যেন।
এ বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আরও বিস্তৃত অংশে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ ও নান্দনিকতায় ঋদ্ধ হয়েছে। গত কয়েক বছরের চেয়ে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন তুলনামূলকভাবে অনেক পরিপাটি, সুন্দর সুশৃঙ্খল মনে হয়েছে অধিকাংশ মানুষের কাছে। এবারের গ্রন্থমেলার আয়োজনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, যা মেলায় আগতদের মাঝে মাঝে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেললেও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো সবাইকে আশ্ব্বস্ত করেছে। কারণ এর আগে বইমেলায় ঘটে যাওয়া বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এবার সেই আতঙ্ক, অস্বস্তি ভাবটি নেই মেলায় আগত বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল পরিসরে মেলায় আয়োজন করায় বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল বিন্যাসে চমত্কারিত্বের প্রকাশ ঘটেছে, যা মেলায় আগতদের প্রশংসা অর্জন করেছে।
এখন মেলায় প্রচুর ভিড় হলেও কারও চলাচলে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। প্রতিটি স্টলের সামনে-পেছনে চারদিকে যথেষ্ট জায়গা থাকায় পাঠক দর্শনার্থীরা স্বচ্ছন্দে স্টলগুলোতে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করে দেখতে পারছেন। বই কিনতে পারছেন ভালোভাবে দেখেশুনে। মেলায় আগে ধুলাবালির প্রকোপটা ছিল অসহনীয়। এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা মেলায় তাদের স্টল বিন্যাস, সাজসজ্জায় নান্দনিকতায় প্রকাশ ঘটাতে অনেকটা সচেষ্ট ছিলেন। যে যার সামর্থ্য এবং রুচি অনুযায়ী স্টল সাজিয়েছেন, যা পাঠক ও দর্শনার্থীদের বিশেষ নজর কেড়েছে। এত বড় আয়োজনের অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আমাদের গর্ব হলেও এখনও বেশ কিছু বিষয় আমাদের বেশ পীড়া দেয়, অস্বস্তিতে বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসে। প্রতিদিন মেলায় প্রচুর লোকসমাগম হলেও সে তুলনায় বিক্রি হচ্ছে অনেক কম। যারা মেলায় আসছেন সবাই কিন্তু বই কিনছেন না। ঘুরেফিরে বই দেখে, আড্ডা মেরে আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। প্রত্যেকে যদি অন্তত একটি করে বই কিনতেন তাহলে আমাদের প্রকাশনা শিল্পে দারুণ এক গতির সঞ্চার হতো। প্রকাশকরা সাধারণত বই প্রকাশ করতে গিয়ে নানা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ যদি বাড়ে তাহলে প্রকাশকরা অনেকটা স্বস্তিতে, স্বচ্ছন্দে বই প্রকাশ করতে পারতেন। প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বেশ কয়েক হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। এত বেশি সংখ্যক নতুন বই এলেও এর মধ্যে বেশির ভাগ বই থাকে মানহীন। কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই বইগুলো মলাটবন্দি হয়ে আসে। যেখানে অসংখ্য ভুল বানান থাকে। বাক্যবিন্যাসও থাকে যাচ্ছেতাই, এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নিম্নমানের লেখায় সমৃদ্ধ অগণিত অসম্পাদিত বই পাঠকদের ভালো কিছু দেওয়ার বদলে কেবলই বিভ্রান্ত করে। মানহীন, আজেবাজে বইয়ের সংখ্যাধিক্য আমাদের পীড়া দেয়, অস্বস্তি জাগায় মনে। এ বিষয়ে প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বই প্রকাশের আগে এর সুসম্পাদনা প্রয়োজন। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
এখন মহাসমারোহে চলছে আমাদের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। যে মেলা আমাদের আমাদের সাহস দেয়, ডিজিটাল মাধ্যমের এই জয়জয়কারের মধ্যেও কাগজে বই হারিয়ে যাবে না। যারা বইমেলায় যাচ্ছেন কিন্তু কোনো বই কিনছেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, একেকটা বই একেকটা জানালা। দরজা জানালা বন্ধ আলোহীন বাতাসহীন ঘরে থাকতে গেলে দম বদ্ধ হয়ে আসে। আমাদের বাঁচার জন্য, স্বস্তির জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জানালা খুলতে হয়, তেমনিভাবে সুন্দর পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ জীবনের জন্য মনের জানালা খুলতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে বই-ই হতে পারে একমাত্র প্রধান অবলম্বন। অতএব, আমাদের বই কেনার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করলে চলবে না। আমাদের প্রাণের মেলা আরও প্রাণবন্ত হোক। বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী।
লেখক : ব্যাংকার
যত দিন যাচ্ছে ততই জমে উঠছে বাঙালির প্রাণের বইমেলা। এখন প্রতিদিন বিকেলে মানুষজনের ভিড়ে মুখরিত বাংলা একাডেমি প্রান্তর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এ যেন লেখক-পাঠকের এক মহাসমাবেশ। সেই সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের তুখোড় আড্ডায় জমে উঠছে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় মোড়ক উন্মোচিত হচ্ছে অনেক নতুন বইয়ের। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রবীণ প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় লেখকদের পাশাপাশি তরুণ নবীন লেখকদেরও বই আছে। মেলা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টলে দেখা যায় তরুণ লেখকদের নতুন বইই বেশি। লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধ গড়তে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতি বছর নতুন লেখকদের জন্য ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। আমাদের একুশের এই গ্রন্থমেলার ব্যাপ্তি আর আমাদের ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই, সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও আজ স্বীকৃত। যারা বইপ্রেমিক তারা সবাই এই বইমেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এই বইমেলা যারা সাহিত্যচর্চা করেন, যারা প্রকাশক এবং যারা বই পড়তে পছন্দ করেন সেসব ছোট্ট শিশু থেকে সব বয়সীর চমত্কার এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বিপুল বই প্রকাশিত হয়, যা প্রায় চার হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। বলা যায়, এই মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক নতুন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকের সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারি মাসের পুরোটা সময় ধরে চলে। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এতদিন ধরে চলে না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা।
এই মেলায় মানুষের আগ্রহ এতই বেশি যে শুধু প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকেও গ্রন্থপ্রেমী বাঙালিরা এতে অংশ নেন। কিন্তু বাংলা একাডেমির ভেতরে অনেক নতুন ভবন এবং অবকাঠামো তৈরি হওয়ার ফলে এখানে আর বইমেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান পাঠক দর্শনার্থীর কারণে বইমেলার পরিসর বাড়িয়ে এর একটি বড় অংশকে গত কয়েক বছর ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর ফলে অমর একুশের স্মৃতিবাহী এই মেলাটির ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটেছে। যে মেলা একুশের মহান ঐতিহ্যকে ধারণ করে এত বিশাল আকার করেছে, তা এখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এই স্থান থেকেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন। আরও আছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ও স্বাধীনতা জাদুঘর। তাই এখানে বইমেলা সম্প্রসারিত হওয়ায় বাংলাদেশের বাঙালির জাতিসত্তার উদ্বোধনের স্মৃতিবাহী একুশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা যুক্ত হয়ে মেলাটি এখন নতুন আঙ্গিক, পরিসর ও মাত্রিকতায় স্থিত হয়েছে বলা যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষাশহীদ বরকত, সালাম প্রমুখের বুকের তাজা রক্তে। স্বাধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে নামার উত্তাল সূচনা হয়েছিল তখন, যা ইতিহাসের নানা ক্রমধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে গড়িয়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নিয়েছিল। মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই দিনে দিনে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এদেশের মানুষকে। ভাষা আন্দোলনের নানা স্মৃতিবাহী বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে স্বাধীনতার লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জনের স্মৃতিবাহী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রসার আমাদের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রসার এবং স্থানান্তর সেই ইতিহাসেরই বহিঃপ্রকাশ যেন।
এ বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আরও বিস্তৃত অংশে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ ও নান্দনিকতায় ঋদ্ধ হয়েছে। গত কয়েক বছরের চেয়ে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন তুলনামূলকভাবে অনেক পরিপাটি, সুন্দর সুশৃঙ্খল মনে হয়েছে অধিকাংশ মানুষের কাছে। এবারের গ্রন্থমেলার আয়োজনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, যা মেলায় আগতদের মাঝে মাঝে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেললেও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো সবাইকে আশ্ব্বস্ত করেছে। কারণ এর আগে বইমেলায় ঘটে যাওয়া বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এবার সেই আতঙ্ক, অস্বস্তি ভাবটি নেই মেলায় আগত বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল পরিসরে মেলায় আয়োজন করায় বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল বিন্যাসে চমত্কারিত্বের প্রকাশ ঘটেছে, যা মেলায় আগতদের প্রশংসা অর্জন করেছে।
এখন মেলায় প্রচুর ভিড় হলেও কারও চলাচলে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। প্রতিটি স্টলের সামনে-পেছনে চারদিকে যথেষ্ট জায়গা থাকায় পাঠক দর্শনার্থীরা স্বচ্ছন্দে স্টলগুলোতে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করে দেখতে পারছেন। বই কিনতে পারছেন ভালোভাবে দেখেশুনে। মেলায় আগে ধুলাবালির প্রকোপটা ছিল অসহনীয়। এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা মেলায় তাদের স্টল বিন্যাস, সাজসজ্জায় নান্দনিকতায় প্রকাশ ঘটাতে অনেকটা সচেষ্ট ছিলেন। যে যার সামর্থ্য এবং রুচি অনুযায়ী স্টল সাজিয়েছেন, যা পাঠক ও দর্শনার্থীদের বিশেষ নজর কেড়েছে। এত বড় আয়োজনের অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আমাদের গর্ব হলেও এখনও বেশ কিছু বিষয় আমাদের বেশ পীড়া দেয়, অস্বস্তিতে বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসে। প্রতিদিন মেলায় প্রচুর লোকসমাগম হলেও সে তুলনায় বিক্রি হচ্ছে অনেক কম। যারা মেলায় আসছেন সবাই কিন্তু বই কিনছেন না। ঘুরেফিরে বই দেখে, আড্ডা মেরে আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। প্রত্যেকে যদি অন্তত একটি করে বই কিনতেন তাহলে আমাদের প্রকাশনা শিল্পে দারুণ এক গতির সঞ্চার হতো। প্রকাশকরা সাধারণত বই প্রকাশ করতে গিয়ে নানা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ যদি বাড়ে তাহলে প্রকাশকরা অনেকটা স্বস্তিতে, স্বচ্ছন্দে বই প্রকাশ করতে পারতেন। প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বেশ কয়েক হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। এত বেশি সংখ্যক নতুন বই এলেও এর মধ্যে বেশির ভাগ বই থাকে মানহীন। কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই বইগুলো মলাটবন্দি হয়ে আসে। যেখানে অসংখ্য ভুল বানান থাকে। বাক্যবিন্যাসও থাকে যাচ্ছেতাই, এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নিম্নমানের লেখায় সমৃদ্ধ অগণিত অসম্পাদিত বই পাঠকদের ভালো কিছু দেওয়ার বদলে কেবলই বিভ্রান্ত করে। মানহীন, আজেবাজে বইয়ের সংখ্যাধিক্য আমাদের পীড়া দেয়, অস্বস্তি জাগায় মনে। এ বিষয়ে প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বই প্রকাশের আগে এর সুসম্পাদনা প্রয়োজন। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
এখন মহাসমারোহে চলছে আমাদের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। যে মেলা আমাদের আমাদের সাহস দেয়, ডিজিটাল মাধ্যমের এই জয়জয়কারের মধ্যেও কাগজে বই হারিয়ে যাবে না। যারা বইমেলায় যাচ্ছেন কিন্তু কোনো বই কিনছেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, একেকটা বই একেকটা জানালা। দরজা জানালা বন্ধ আলোহীন বাতাসহীন ঘরে থাকতে গেলে দম বদ্ধ হয়ে আসে। আমাদের বাঁচার জন্য, স্বস্তির জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জানালা খুলতে হয়, তেমনিভাবে সুন্দর পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ জীবনের জন্য মনের জানালা খুলতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে বই-ই হতে পারে একমাত্র প্রধান অবলম্বন। অতএব, আমাদের বই কেনার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করলে চলবে না। আমাদের প্রাণের মেলা আরও প্রাণবন্ত হোক। বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী।
লেখক : ব্যাংকার