আল মাহমুদ: কুহলি পাখির পিছুপিছু…
মাঈনউদ্দিন জাহেদ
কে জানে ফিরলো কেনো, তাকে দেখে কিষাণেরা অবাক সবাই
তাড়াতাড়ি নিড়ানির স্তুপাকার জঞ্জাল সরিয়ে
শস্যের শিল্পীরা এসে আলের ওপরে কড়া তামাক সাজালো।
একগাদা বিচালি বিছিয়ে দিতে দিতে
কে যেনো ডাকলো তাকে; সস্নেহে বললো ,বসে যাও,
লজ্জার কি আছে বাপু, তুমি তো গাঁয়েরই ছেলে বটে
আমাদেরই লোক তুমি। তোমার বাপের
মারফতির টান শুনে বাতাস বেঁহূশ হয়ে যেতো।
পুরনো সে কথা উঠলে এখনও দহলিজে
সমস্ত গাঁয়ের লোক নরম নিরব শোনে।
সোনালি খড়ের স্তুপে বসতে গিয়েÑ প্রত্যাগত পুরুষ সে জন
কী মুস্কিল দেখলো যে নগরের নিভাঁজ পোষাক
খামচে ধরেছে হাঁটু। উরুতের পেশী থেকে সোজা
অদূর কোমর অবধি
সম্পূর্ণ যুবক যেনো বন্দি হয়ে আছে এক র্নিমম সেলাইয়ে।
যা কিনা এখন তাকে স্বজনের সহর্চয , আর
দেশের মাটির বুকে, অনায়াসে
বসতে দেবে না ।
তোমাকে বসতে হবে এখানেই,
এই ঠান্ডা ধানের বাতাসে।
আদরে এগিয়ে দেওয়া হূকাটাতে সুখটান মেরে
তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছু পিছু
কতদূর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরোজ।
এখন কোথায় পাখি? একাকী তুমিই সারা দিন
বিহঙ্গ বিহঙ্গ বলে অবিকল পাখির মতন
চঞ্চল সবুজ লতা রাজপথে হারিয়ে এসোছো।
অথচ পাওনি কিছু,না ছায়া না পল্লবের ঘ্রাণ
কেবল দেখেছো শুধু কোকিলের ছদ্মবেশে সেজে
পাতার প্রতীক আঁকা কাইয়ুমের প্রচ্ছদের নিচে
নোংরা পালক ফেলে পৌর – ভাগাড়ে ওড়ে নগর শকুন।
( খড়ের গম্বুজ- সোনালি কাবিন: আল মাহমুদ)
পঞ্চাশের মহত্তম কবি- আল মাহমুদের কাবকৃতি র অমর স্বাক্ষর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিন।
কলকাতা থেকে ১৯৭১ সালে সন্দীপন চট্টপধ্যায় সম্পাদিত ১৪টি সনেট নিয়ে “সোনালি কাবিন” পুস্তিকা পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে প্রগতি প্রকাশনী, ঢাকা থেকে আরও ৪০টি কবিতা সংযোগে প্রকাশিত হয়। এগ্রন্থের ১৭ নম্বর কবিতা ‘খড়ের গম্বুজ”। একবিতায় আল মাহমুদ নিজের কাব্যভবিষ্যতকে নিপুন ভাবে চিত্রিত করে যান অদৃষ্ট ইশারায়। ১১ জুলাই -২০১৭ কবির ৮2তম জন্ম জয়ন্তী। জীবনের এ পর্যায়ে এসেও কী কাব্যে কী যাপনের আল মাহমুদ হেঁটে চলেছে কুহলি পাখির পিছুপিছু।
কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যে বালক ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে একটি টিনের সুটকেস নিয়ে পাজামার সাথে শার্ট পড়ে রাজধানীতে গিয়ে উঠে ছিলেন, মোল্লাবাড়ীর সেই বেপারীর ছেলে আবদুস শুকুর ওরফে আল মাহমুদ কতটুকু পৌড়-ভাগাড় থেকে নগর শকুনদের সাথে প্রতিযোগিতা করে তাঁর ন্যায্য আদায় করেছেন আর পল্লবের ঘ্রাণ আর ছায়ায় ছায়ায় কতটুকু ফিরে গেছেন। বিহঙ্গঁ বিহঙ্গঁ বলে অবিকল পাখির মতন’ শস্যের শিল্পীদের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন- তা আজকের উপজিব্য।
১.
প্রথম কাব্য গ্রন্থ’ লোক লোকান্তরে আল-মাহমুদ ত্রিরিশের পঞ্চ কবির অনুবতীর্ হয়ে আত্মকেন্দ্রিক পারিপার্শ্বিক ঘটন-অনুঘটনকে পদ্যময় করে তুলেছেন। এ নিয়ে ষাটের তুখোড় কবি-সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন- “… তার নিচু কন্ঠস্বরে তিনি তাঁর অনুভবের কথা, তাঁর পারিপার্শ্বিক কম্পামান অগ্রসরমান জীবনের কথা বলে গেছেন। …এক সুস্থ-স্বস্থ-স্বচ্ছ, জগতের অধিবাসী এই কবি সযত্ম ও পরিচ্ছন্ন ছন্দ ও ভাষার অধিকারী।(“সমকাল’ ঃ কবিতা সংখ্যঅ ১৩৭১-৭২)। এ পর্যায়ে কবি আল মাহমুদের কবিতার বিষয় আসয় ব্যক্তিগত হলে ও নাগরিক বাস্তবতাকে নির্মম ভাবে কবিতার ধারণ করেছেন।
‘জীবিকাবিজয়ী দেহে কোন ঘরে দাড়াবোরে আজ
কাকের ধুর্ততা নিয়ে ফিরেছি তো এখানে ওখানে
খুজেঁছি জলের কণা থর থর ধুলোর তুফানে
এখন বুঝেছি মানে-এন্ড এক নারকী সমাজ,
( তৃষ্কার ঋতুতে:লোক-লোকান্তর)
নাগরিক এ বাস্তবতায়- জলদস্যুর প্রতীকে নগরের এ নতুন নাগর প্রেমের সিম্ফনীতে নষ্টালজিয়ার ভুগেছেন গাঁ য়ের যে বালিকাটি প্রেমে, যে বলেছিলঃ
জলদস্যুর জাহাজে যেয়োনা ভেসে
নুন ভরা দেহে আমাকে জড়িয়ে নাও।
জল ছেড়ে এসো প্রবালেই ঘর বাধি
মুক্তো কুড়াতে যেয়োনা সুদূরে ভেসে।
(সমুদ্র বিলাস:লোক-লোকান্তর)
গাঁয়ের এ নারীই আল-মহমুদের কেিবতার বার বার ফিরে এসেছেন। আলমাহমুদের বিভিন্ন পর্যেয় কবিতা যে নারী প্রচ্ছন্ন হয়ে উঁকি দিতে গেছেন তা ভাদুগরের শ্যামল গড় সেই প্রথম নারী-
দেখবেন ভাদুগড়ের শেষ প্রান্তে
এক নির্জন বাড়ির উঠোনে কুটে আছে
আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসবতী
একটি ম্লান দুঃখের করবী : (রাস্তা: লোক-লোকদের)
কিন্তু লোকলোকান্তরে কবি আল-মাহমুদ- ত্রিরিশের ভাষা উপমা-উৎপ্রেক্ষা বাক্ভঙ্গিতে আক্সান্ত। ‘কালের কলস’ এ এসে কবি নিজস্ব ভাষা খুজেঁ পান, লোকজ উপাদের সাথে সাথে এর বর্ণনা ভাঙ্গীঁও লোকজ হয়ে ওঠে। বিশিষ্ট সমালচক গোলাম মুরশিদ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন:
… পল্লীর শব্দ ও প্রবাদ প্রবোচনকে আধুনিক কোনো কবি সম্ভবত এমন নিপুন ও শৈল্পিক ভঙ্গিঁতে ব্যাবহার করেননি। পল্লীর উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপমা চিত্রকল্প। প্রকৃত পক্ষে তিনি কাব্য ভাষাক্ষেত্রে এক অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত করেন। জসীমউদ্দীন যেখানে লোক সাহিত্যের উপদানের উপর তাঁর কুটির তৈরি করেন, আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক এক প্রসাদের করুকার্যে লৌকিক উপাদান ব্যাবহার করেন। কেননা, আল মহমুদ অত্যন্ত সংবেদমশীল, সচেতন ও বিদগ্ধ শিল্পী, তাঁর উপলব্ধির গভীরতা জসীম উদ্দীনের তুলনায় অতলল্পশ্ ীতদুপরি অক্ষরবৃত্ত , মাত্রাবৃত্ত , স্বরবৃত্ত ছন্দের এই ত্রিবিধ চলনেই বর্তমান কবির স্বচ্ছদ বিহার অনেকের কাছেই ঈর্ষার বস্তু হতে পারে।’ (পূর্ববাংলার সাহিত্য: কবিতা, ‘দেশ: ১০ জুলাই ১৯৭১)
আর, এ ঈর্ষাই আল মাহমুদ কে জীবনের উপান্ত পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সোনালি কাবিনের উৎসর্গ পত্রে তাই আল মাহমুদ লিখেছেন:
শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, শহীদ-কাজারী- আমাদের
এক কালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্য-হিংসা অমর হোক।
১১ জুলাই ১৭ কবির ৮২ তম জন্ম জয়ন্তি। তাঁর অমর কৃতি ‘সোনালি কাবিন’ ইতিমধ্যে কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গেছে। তার কবি কৃতি নিয়ে উপমহাদেশে বিশিষ্ট চিন্তক শিবনারায়ন রায়ের মন্তব্য সত্যই অনন্য হয়ে আছেন। তিনি লিখেছেন:
`Mohmud has on extraordinary gift for Telescoping discrete levels of experience; in his poem I find a mervellous fusionof passion and wit which reminds me occasionally of Bishnu Day. The complete secularism of his approach is also striking, more so ……. he was born and
Brought up in a very conservative Muslim religious family; It is not a secularism forced by some ideology, but Present naturally and ubiquitously in his metaphors, Images and themes. (I Have seen Benggl’s Face- Sibnarayan Roy and Marion Madder (Ed…), 1974)’
ত্রিরিশের দশকে যে বাংলা কবিতা য়ুরোপবাহিত আধুনকিতার অনুরনন হয়ে- ‘ক্লেদ কসুম’ হয়ে নাগরিক যন্ত্রনার চিন্তা ভাষ্য হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। পঞ্চালের দশকে এসে বাংলাদেশের কবিতার তা একান্ত বঙ্গঁজ হয়ে ওঠে। তার পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহত্তর বাঙালি মুসলমানদের লোকজ জীবনাচার-ধর্ম-ঐতিহ্য ও ভাষার আচমনে আলাদা হয়ে ওঠতে দেখি আল মাহমুদের কবিতায়, যা তার অন্যান্য সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীসহ নাগরিক কবিদের উন্ন্যাাসিক আধুনিকায়নে আমরা দেখতে পাইনা। সেকুলার তকমা দিতে গিয়ে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য চ্যুত হয়ে শেকড়হীন রূপের নাগর হয়ে ওঠে বাংলা কবিতা। কিন্তু কবি আল মাহম দের এ সচেতনতা আমরা লক্ষ করি কবিতায় শব্দ ব্যাবহারের ক্ষেত্রেও । তিনি সম্পূর্ণ সচেতন ভাবে ইংরেজি-আরবি-ফারসি শব্দের পাশাপাশি প্রাচীন সংস্কৃত- সাধু-চরতি শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যাবহর করেছেন তার কবিতায়,। উদাম, কাউয়া, গাঁওয়ার, বাদাম, পাইলা, টুম, হগল, আজকা, রও, উরত, সুখ টান, ঠিলা, জেয়র, শরমিন্দা, দেনমোহর, কাবিন, খোরগী, ছেদুর, ইষ্টা, বান্দির পুত্র, বাইন্ধা, আহে, জবর, মিছাঘোর, তাজ্জয, বাঙড়ি, নাদান,ইতর, পানিউড়ি, লানৎ, … মানত, কিসিম, সবক, কসুর, ইত্যাদি শব্দ আল মাহমুদের কবিতায় ব্যাবহৃত হয়ে কবিতা হয়ে ওঠেছে অনেকবেশি মাটিলগ্ন-মানুষের ভাষা ও হৃদয়ের কাছাকাছি।
“আমার ঘরের পাশে ফোটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রানের শরবী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুরার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রোলোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।
(সনেট-৫ :সোনালি কাবিন)
২.
কবি আল মহমুদ একুশের ফেরারী কবি। গ্রাম থেকে ফেরারী হয়ে কবিতা চর্চায় ঢাকা এলেও তিনি বার বার ফিরে গেছেন কবিতার জন্য বাংলার গ্রাম-গঞ্জে শস্যের শিল্পীর কাছে- মটির কাছাকাছি। শুধু ‘সোনালি কাবিন’ সনেট সিকোয়েন্স নিয়ে বলতে গিয়ে কবি ও শিল্পসমালোচক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেন: ‘সোনালি কাবিন’ এই দীর্ঘ কবিতার মধ্যে আছ প্রতীকী ভাষণ, নিখুঁত বর্ণনা ; আবেগ স্পন্দিত স্তবক ; বিচ্ছিন্ন সুন্দর লাইন। অতীতের ব্যাবহার তিনি করেছেন অতীতের ভিত্তিতে, প্রতিটি পর্বের স্টাইলের মধ্যে যাপন করেছেন, ফলে অতীত হয়ে ইঠেছে এক ধরনের বর্তমান। বর্তমান: অতীতকে ইমারতের মতোন গড়ে তোলার জন্য তিনি এক চরিত্র ব্যবহার করেছেন বাঙ্গালি মনো স্বভারের প্রতিনিধি হিসেবে। ঐ ব্যাক্তি বাঙ্গালি, কবি, আবহমান মনুষ, ইতিহাসের মধ্যে হৃদয়ের ইতহাস গেঁথে দিয়েছেন, জনপদ, শস্য, হৃদয় সবই এক মহাসত্যের বিভিন্নদিক। আর শব্দ অবহমান, চিরকালনি গ্রামীন এবং লোকজ। আলমাহমুদের কৃতিত্ব এখানেই। ( দৈনিক বাংলা; ২২ জুলাই ১৯৭৩)
ত্রিরিশের কবিদের নগর চেতনা-নাগরিক বিবমিষা, জটিল জঙ্গম মনোভূগোল থেকে বাংলা কবিতা কে আবার তার মর্মমূলে ফিরে নেয়ার তাকিদেই কবি আল মাইমুদ নাগরিক কবিদের মতো কোকিলের ছদ্মাবেশ না নিয়ে- কুহলি পাখির পিছুপিছু গিয়েও বার বার কবিতাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন ঘড়ের গম্বুজের কাছে, নিড়ানির স্তুপাকার জঞ্জালের কাছে, এবং শস্যের শিল্পীদের কাছে, যাদের সাথে বসে কড়া তামাকে সাজালেন বাংলা কবিতার সত্যিকার লোকজ ব্যাঞ্জন।
‘আমার নিবাস জেনো লোহিতাপ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের কেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাও গৌতমের স্তব।
(সনেট-৯: সোনালি কাবিন)
‘লোক-লোকান্তর’ থেকে সাম্প্রতিকতম কাব্য গ্রন্থ ‘তোমার গল্পে ফুল ফুটেছে’ পর্যন্ত কবিতার-কবি আল মাহমুদ বাংলা কবিতাকে জনমানুষের বিশ্বাসের কাছা কাছি নিয়ে গেছেন; তার ভাষাকে লোকজ বুলির কাছাকাছি ; তাঁর শিল্প সুনমাকে সার্থক ভাবে পাঠকের সহজ বোধের তার পৌছেঁ দিয়েছেন । আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতা বা নিরীক্ষার নামে অনাচারে তিনি ঝুকেন নি। তিনি সহজাত আনন্দে কবিতা বুনে গেছেন আপন স্বরে। তার কাব্য কৃতি নিয়ে কবি সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন: এক ধরনের সহজ-সরল অনায়াস মোচরহীন কবিত্বশক্তির অদিকারী …. তাঁর প্রকরনওে সেই মোচরহীন অনায়াস সহজে সচ্ছলতা (করতলে মহাদেশ, পৃষ্ঠা: ১৭২)
আর মাহমুদের কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা একক ভাবে হয়ে ওঠে উপভোগ্য। যেনো পূর্ণ কবিতার নান্দিকতার হয়ে ওঠে তৃপ্তীময়। বাঙালি লোক মানসের জীবনের উপাত্তগুলো হয়ে ওঠে কবিতার অনেবার্যঅনুষঙ্গ : যেমন
ক. কবিতা বনের পাখি কুড়ানো হাসের ডিম
শ্লানমুখ বউটির দড়ি-ছেঁড়া হাড়ানো বাছুর
খ. চুড়ির শব্দ যেন অন্ধকার গেলাফের ওপর রূপোর কাররুকাজ
গ. তোমার টিকলি হয়ে হৃদপিল্ড নড়ে দুরু দুরু
ঘ. উগোল মাছের মাংস তৃপ্তহোক তোমার কাদায়
ঙ. জীবনে জলাধারে হতে চাই তুমুল রোহিত
৩.
বাংলা কবিতায় পঞ্চাশের দশক-বাঙ্গালি মুসলমানের জন্য একটি উজ্জ্ব ল সময়। এদশকেই ৫২ এর সৃজনশীলতা প্রবল প্লাবিত হয়েছিল বাংলাদেশের কবিতা। পঞ্চাশের কবিতাকে দুটো পর্বে চিহ্নি করা যায়। প্রথম পর্যায়ের কবি :আবদুল গনি হাজারী, সৈয়দ নুরুদ্দীন, আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুল রশিদ খান, প্রজেশকুমার রায়, হাবীবুর রহমান, আতাউর রহমান, মাযহারুল ইসলাম প্রমুখ। দ্বিতীয় পর্যায়ের কবি : শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, ওমর আলী , আবদুস সত্তার ,আবু জাফর ওবায় দুল্লাহ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আজিজুল হক, আল উদ্দিন আল আজাদ, আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, ফজর শহাবুদ্দীন, সৈয়দ শামসুর হক, শহীদ কাদরী, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, দিলওয়ার, রতিফা হিলালী, আবু বকর সিদ্দিক, জিয়া হায়দার প্রমুখ।
পঞ্চাশের প্রথম পর্যায়ের কবিরা মূলত : বাস্তববাদী- তাঁদের কবিতায় নারী ও নির্সগ তেমনি ভাবে আচমিত হয়নি। সে তুলনায় দ্বিতীয় পর্যায়ে কবিয়া অনেক বেশী রোমন্টিক ও আধুনিক। শাসসুর রাহমান শহরে মধ্যাবিত্তের সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনাকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন নাগরিক ভাষাার বাক্ভংগিতে, শাহীদ কাদরীর কবিতায় নাগরিক মন:সমিকরনের সমস্ত দ্বন্দ্ব ও উল্ল্যাস আধুনিকতায় উপস্থাপিত হয়েছে। সাবলিল-সচল-রোমান্টিক-বিরল প্রত্যয় হয়ে প্রকাশ পেয়েছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায়। নারীও প্রকৃতি ¯্রােতে ভেসে উপস্থাতি হতে দেখা যায় ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতায়া এবং শারীরি প্রেম ক্রমগত মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর কবিতাবলী। মনিরুজ্জমানের ব্যক্তিত পৃথি বী ও পরিপার্শ্বে ছন্দময় প্রকাশ হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়। পূঁথির নবরূপ পরিগ্রহন করেছে আবদুল রশীদ ওয়াসেকপুরী ও আবদু রশীদ খান এর কবিতা । নিরীক্ষা প্রবন হয়ে সৃষ্টিশীলতায় অস্থির থেকেছেন সৈয়দ শামসুল হক। স্থান-কাল-ব্যক্তির উপস্থিতিতে প্রাতিস্বিক দালিনিকতা অমরা লক্ষ্য করি ওমর আলীর কবিতায়। অতি সমাজ চেতনায় অগ্নিময় উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ছিল দিলওয়ারের কবিতায়। আল ম্হমুদের কবিতার বিবেচনা উপস্থাপনা কবিতার চি ত্রে উন্মেচনে আগে আরও একটু সমকালিন কাব্য চরিত্রকে দৃশ্যো আনতে হবে। হাসান হাফিজুর রহমান পঞ্চাশের প্রথম প্রকৃত সমাজ সচেতন কারি। তীর্যক-দৃঢ়-নির্বস্তক ভাবে আমরা লক্ষ্য করি তাঁর কবিতায়। আর সাইয়িদ আতিকুল্লাহর কবিতায় নির্বস্তুক-বন্তুময়তা প্রকাশ গেয়েছে সম্পষ্ট ভাবে। আর প্রত্যক্ষ কর পাঠক আজীজুল হকের কবিতায় ব্যক্তি বিশ্বের কারুময় উপস্থিতি। আদিবাসী ও আরব বিশ্বের কাব্য সৌন্দর্য আমরা প্রত্যক্ষ করি আবদুস সাত্তারের কবিতায়। সমাজ সচেতনতা ও রোমান্টিকতার জ্বল জ্বলে প্রকাশ আলা উদ্দিন আজাদের কবিতায় । গন মানুষের অধিকার ও হাহাকার আবু বকর সিদ্দিকের কবিতায় উঠে এসেছে।
বাংলা কবিতার এ বিশাল কাব্য যাত্রার পঞ্চাশের কবিতার পাঠক পু:ধারায় বিভক্ত হয়ে ওঠে। নগর কেন্দ্রীক নাগরিক উল্লম্ফপ যেভাবে কবি শাসসুর রাহমান কেন্দ্রীক আববর্তি হয়েছে, তে¤িœ আবহমান বাঙলার চিরায়ত রূপ, এর মাঠি ও মানুষের সুখ-দু:খ আনন্দ-বেদনা লোকজ উপাত্তে ঐতিহ্যম-িত হয়ে আধুনিক হয়ে উঠেছে আল মাহমুদকে কেন্দ্র করে। আর আলমহমুদ , হাসান হাফিজুর রহমান ও ওমর আলীর কবিতা অনেক বেশি মৃত্তিকা স্পর্শ হয়ে ওঠে এ সময়ে।
তাই কবি সমালোচক মান্নান সৈয়দ কবি আল মাহমুদকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে।…. ‘কাব্য মূল্যায়নে প্রথমবোদি নারী ও নিসর্গের সম্মোহ দেখা গেছে। তার গ্রামীনতার সঙ্গেঁ তখনই উপস্থিত আধুনিক মনসতা। প্রকরণে কোনো পরীক্ষা বা অভিনয়ত্ব নেই, অনেকখানি প্রচল নির্ভর, কিন্তু তার মধ্যেই আল মাহমুদ গভীয় সঞ্চারী কষ্ট উৎকীর্ণ হয়েছে-তার শক্তিঅনেক খানি তাঁর কবিতায় গভীরতায় ও আন্তরিকতায়, এবং সমস্ত উচ্চারণকে একটি নিবিবড় শিল্পে ম-িত ও উত্তীর্ণ করে দেওয়ার।
৪.
পঞ্চাশের কবিতাকে অনেক খানি প্রভাবিত করেছে বিশ্বকবিতাও তাদের অনূদিত বিশ্বভূঘোল একটু উন্মোচল করলে তার একটি রূপ পাঠকের কাছে পষ্ট হয়ে ওঠে। এর সাথে যদি পশ্চেম বঙ্গের পঞ্চাশে বাকিদের একটি তুলনা মূলক বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশের কবিতার আলাদা স্বাতন্ত্র। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চাশের কবিতার দুটি চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। এক. বামপন্থী সমাজ চেতন ধারা, দুই. বাঁধন ছাড়া রোমান্টিকতা। অন্যদিকে বাংলাদেশের কবিতার পঞ্চাশের দশেকে এসছিল পাকিস্তাবাদ ও বামপন্থী কমিউনিস্ট ধারার বিপরীতে দেশত্ববোধক রোমান্টিতা। বাংলাদেশের পঞ্চাশের কবিয়াই সমাজ সচেতনার সঙ্গে নান্দনিকতার একটি মিশেল ঘটাতে পেরেছিলেন, এরাঁ কবিতাকে ফিরিয়ে এনছিলেন রোমান্টিকতার কাছে। এ দশকে, বিশেষ করে আলমহমুদ-হাসান হাফিজুর রহমান ও ওমর আলীর কবিতা দেশ-মা-মাটি প্রত্যয়ে অভিন্ন প্রতীক হয়ে উপমা-উৎসেক্ষার সমন্বিত শিল্পভাষ্য হয়ে উঠে । আর একক ভাবে আল মাহমুদ- শুধু কবিতাকে ভালোবেসে এগিয়ে নিয়ে গেছন বাংলা কবিতার সোাদা মাটি গান্ধী শিল্প বৈভব। একে একে রচনা করেছেন: লোক-লোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্না বান্না, বখতিয়ারের ঘোরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহারান্তরে পাশফেরা, একচক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল,আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা, পাথির তাছে ফুলের কাছে, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, নদীর ভেতরে নদী, উড়াল কাব্য, বিরামপুরের যাত্রী, তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, বারুদগন্ধী মানুষের দেশ, তুমি তৃষা তুমি ই পিপাসার জল, সেলাই করা মুখ, তোমার রক্তে তোমার গন্ধে,তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে ’ সহ তেইশ টি কাব্যগ্রন্থ।
৫.
বাংলা কবিতার এ স¦াতন্ত্রকে বিশিষ্ট চিন্তুক হুমায়ুন কবির চিহ্নিত করেছেন এভাবে:
পশ্চিম বাঙ্গলার প্রকৃতি তাই বাঙ্গালীর কবিমনসকে যে রূপ দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে লোকতীত রহস্যের আভাস। অনির্বচনীয়ের আস্বাদে অন্তর সেখানে উম্মুখ ও প্রত্যাশী, জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তি মধ্যে আত্মবিস্মরণ। বাঙ্গলার পূর্বাঞ্চলের প্রকৃতি ভিন্নধর্মী। পূর্ব বাংলার নির্সগ হৃদয়কে ভাবুক করেছে বটে, কিন্তু উদাস করেনি। দিগন্ত প্রসারিত প্রান্তরের অভাব সেখানেও নাই, কিন্তু সে প্রান্তরে রয়েছে অহোরাত্র জীবনের চঞ্চল লীলা । পদ্মা -যমুনা-মেঘনার অবিরাপম ¯্রােতধারায় নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস।( বাংলার কাব্য-১৩৫৪)
আল মাহমুদের কবিতায় চিরকালের অনন্য চরিত্র হচ্ছে তার দেশজতা, মাটি ও মানুষ একসাথে যুথবদ্ধ সমম্বয় সাধন। জনপদ ও জনতা এক সাথে উঠে এসেছে তার কবিতায়। নারী প্রেম ও দেশপ্রেম একটি ভিন্ন রেখায় এসে মিলেছে আল মাহমুদের কবিতায়। একটি সুহাসিনী বোনের জন্য কবিতার শেষ স্তবকে দেশ আর প্রিয়তমা নারী এক হয়ে গেছে।
কৃষ্ণা সে। কিন্তু আমার দেশ তা যত কালোই হোক।
কেশদাম কি উদ্দাম আর রুক্ষ সে। হোক, তবুও উত্তর বাঙলায়
গুল্মের মতই সে পানির পিয়াসী, বৃষ্টি প্রার্থিনী দেশ আমার ।
কী শীতল পয়োধরা সে। তবুও এই পর্বত আর পাথরহীন প্রান্তরে
তার উপত্যকাই তো শত সন্তানের আশ্রয়।
তার কক্ষস্থল বিপ্লবের ধাত্রী।
যে কবি কবিতরি কুহলি পাখি পিছু পিছু ছুটতে গিয়ে নগন জঙ্গমে পৌর ভাগারেরপণ্য ভাগাভাগি করতে চেয়েছেন, কিন্তুঅলক্ষে বার বার ফিরে এসে খড়ের গম্বুজের কাছে।কারণ:
‘মহানগরের ভদ্রবেশী বেশ্যা,লম্পট, হিরোইনসেবী ও ছিনতাইকারীর
প্রত্যহ পাপের দেনায় আমরা অতিষ্ঠ,
এর সাথে যোগ দিয়েছে াবশ্ববিদ্যালয়ের মহানপ-িতেরা…
(কদররাত্রির প্রার্থনা: একচক্ষু হরিণ)
এই যে প্রত্যার্বতন, শিশিরে পাজামা ভিজে যাওয়া, শীতের বিন্দু জমতে জমতে র্নিলজ্জেরে মতোন লাল র্সূয ওঠা, জলের দিকে বকের ঝাব উড়ে যাওয়া, দীর্ঘ পাতাগুলো না না বলে কাঁপা, বাবার নিচু গলায় পড়তে থাকা …ফাবি আইয়ে আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান…। এ প্রত্যার্বতন পুরো বাংলা কবিতার শেকড়ের দিকে ফেরা। আর ‘সোনালি কাবিন’ থেকে ‘ তোমার গন্ধে ফুল ফটেছে’ হলো মাকে জড়িয়ে ধরে প্রত্যার্বতনের লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলা।
যখন কবি আল মাহমুদ বলে ওঠেন:
‘তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার
কুরুলিয়ার পুরোনো কই ভাজা;
কাউয়ার মতো মুন্সি বাড়ির দাওয়ায়
দেখবো বসে তোমার ঘষা মাজা
বলবে নাকি; এসেছে কোন গাঁওয়ার?
ভাঙ্গলে পিঠে কেিলা চুলের ঢেউ
আমার মতো বোঝেনি আর কেউ
তবু যে হাত নাড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায়
শহরের পথ দেখিয়ে দিয়ে যওিয়ায়।
(তোমার হাতে: সোনালি কাবিন)
হ্যা, নাগরিক জীবনের অনির্বায্যতাকে মেনে নিয়েও বাংলা কবিতাকে শেকড়ের দিকে ফেরানোর অনির্বায্যতা আল মাহমুদের মতো আর কেউ বোঝেন নি এমন করে।