ইতিহাসের পাতা থেকে চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলা

চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘির পাড়ে আজ অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলী খেলা। এবার দাঁড়িয়েছে ১০৯ তম পর্বে। শিশু-কিশোর আর বৃদ্ধ মিলে এবার লালদীঘি মাঠে এ বলী খেলায় অংশ নেবেন দুশতাধিক বলী। এসব বলীরা ফাইনাল বাউট পর্যন্ত নিজেদের বলীয়ান হিসেবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত আয়োজকরা চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ আয়োজনের ১০9তম পর্ব শেষ করবেন আজ ।
জব্বারের এ বলী খেলাকে ঘিরে গ্রামীণ কুটির শিল্পে তৈরি পণ্য ও তৈজসপত্র নিয়ে মেলার আয়োজন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ মেলাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারাও ইতোমধ্যে পসরা সাজাতে শুরু করেছে। এদিকে, মেলা ও বলী খেলার আয়োজনকে সুশৃঙ্খল রাখতে সিএমপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও শারীরিকভাবে সক্ষম করে তুলতে ১৯০৯ সাল অর্থাৎ ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ বলী খেলার সূচনা হয়। আন্দোলনের কৌশলী সংগঠক চট্টগ্রাম নগরীর বদরপাতি এলাকার সওদাগর আব্দুল জব্বার এ বলী খেলার আয়োজন করেন। ঐতিহ্যবাহী এ খেলার উদ্যোক্তা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে চট্টগ্রামবাসী। জব্বারের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা এ খেলা চালু রাখেন। তারপর থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা উপমহাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক বাহকে পরিণত হয়েছে।

বলীখেলা কী

 

জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ই বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহনকারীদেরকে বলা হয় বলী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বলীখেলা নামে পরিচিত। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন।  তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।

ইতিহাস
ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
পেছনের ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, বলী খেলার শ্রেষ্ঠ সময় ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত আয়োজন করা হতো বলী খেলা। তখন ওই অঞ্চলের অনেকেই ছিলেন ইয়াংগুন তথা মিয়ানমার প্রবাসী। তাঁদের বলা হতো রেঙগুইন্যা। রেইঙগুইন্যাদের হাতে ছিল প্রচুর অর্থ। তারাই পৃষ্ঠপোষকতা করত বলী খেলার। পরে অন্য অনেকেই এ খেলা আয়োজনে এগিয়ে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে বলী খেলার আয়োজন করতেন। পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী একে খানও যৌবনে বলী খেলতেন বলে জানা যায়। ঢাকার নবাব আবদুল গনিও ছিলেন বলী খেলার পৃষ্ঠপোষক।

মল্ল পরিবার ও বলীখেলা

চট্টগ্রাম বলির দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাসের ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।

 

বর্তমানে
এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে।

জব্বারের বলী খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলী খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলী খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলী খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী খেলা এখনও কোনরকমে বিদ্যমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.