উইন্ডোজের তিন দশক

১৯৮৫ সালের ২০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে আসে মাইক্রোসফটের প্রথম অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ। অপারেটিং সিস্টেমের কল্যাণেই মাইক্রোসফট পরবর্তীকালে প্রযুক্তি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দীর্ঘ ৩০ বছরের পরিক্রমায় মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস হয়ে ওঠেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। মাইক্রোসফটের প্রথম অপারেটিং সিস্টেমটির নাম ‘উইন্ডোজ ১.০’। কম্পিউটারের সোনালি সময় মূলত এই উইন্ডোজ দিয়েই শুরু। উইন্ডোজের ৩০ বছরের সফলতার গল্প নিয়ে লিখেছেন আহমেদ ইফতেখার

গত ২০ নভেম্বর ৩০ বছর পূর্ণ করল মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ। ১৯৮৩ সালে এই অপারেটিং সিস্টেমের ঘোষণা দিলেও এর দুই বছর পর ১৯৮৫ সালের ২০ নভেম্বর বাজারে ছাড়া হয় উইন্ডোজ ১.০। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৭৫ শতাংশ ডেস্কটপ কম্পিউটারেই ব্যবহার হচ্ছে উইন্ডোজ। এ অপারেটিং সিস্টেম দিয়েই প্রতিটি পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে মাইক্রোসফট।
কিছু দিন আগেও প্রযুক্তি আজকের মতো এতটা অগ্রসর ছিল না। তখন টাইপরাইটারেই লেখালেখির কাজ চলত। কোনো লেখা কপি করতে হলে ব্যবহার করা হতো কার্বন পেপার। এই পেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল মাইক্রোসফট নামে এক প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। পল ও বিল নামে দুই বন্ধু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা থেকেই নিজেদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তারা তৈরি করেন উইন্ডোজ নামে এক জাদুকরী সফটওয়্যার। তাদের অব্যাহত চেষ্টার ফলে আজ মাইক্রোসফট প্রযুক্তি বিশ্বে রাজত্ব করে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে বিল গেটস ও পল অ্যালেনের প্রতিষ্ঠান। আর এর মূলে রয়েছে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া এই উইন্ডোজ।

উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের পথচলা
১৯৮৩ সালে মাইক্রোসফট প্রথম অপারেটিং সিস্টেম বাজারে আনার জন্য কাজ শুরু করে।

উইন্ডোজ ১.০
গ্রাফিক্যাল অপারেটিং সিস্টেমের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে ডস বা ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেমের বাড়তি সুবিধা হিসেবে পরিপূর্ণ উইন্ডোজ ১.০ বাজারে আনে। উইন্ডোজ ১.০-তে ২৫৬ কিলোবাইটের মেমোরি ও গ্রাফিক্স কার্ডের দু’টি ফ্লপি ডিস্ক ছিল। অনেকগুলো প্রোগ্রাম একত্রে চালাতে ব্যবহারকারীকে হার্ডডিস্কসহ ৫১২ কিলোবাইটের মেমোরি সংযোজন করার দরকার পড়ত। মাত্র ২৫৬ কিলোবাইটের মেমোরি দিয়ে তেমন কিছুই করা যেত না। কিন্তু ওই সংস্করণের ভিত্তিগুলোই ছিল শুরু।

উইন্ডোজ ২.০
এটি উইন্ডোজ ১.০-এর পরবর্তী সংস্করণ। উইন্ডোজ ২.০ মাইক্রোসফটের গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস-ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম। এতে অ্যাপ্লিকেশন উইন্ডোগুলোকে একটির ওপর আরেকটি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। উইন্ডোজের এই সংস্করণে উন্নততর কি-বোর্ড শর্টকাটের ব্যবস্থা ছিল। এতে ম্যাক্সিমাইজ ও মিনিমাইজ শব্দগুলো প্রথম ব্যবহার করা হয়।

উইন্ডোজ ৩.০
এই অপারেটিং সিস্টেম এককভাবে কাজ করত না। এটি এমএস-ডসের গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এতে গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেসটি ঢেলে সাজানো হয়। এটি ইন্টেলের ৮০২৮৬ ও ৮০৩৮৬ প্রসেসরের মেমোরি ম্যানেজমেন্ট সুবিধাগুলো কাজে লাগায়। এতে ডসের জন্য লেখা টেক্সট মোডের প্রোগ্রামগুলো উইন্ডোর মধ্যে চালানো যেত। এটি একসাথে একাধিক প্রোগ্রাম চালাতে সক্ষম ছিল। উইন্ডোজ ৩ সংস্করণ থেকে বিভিন্ন রকম অ্যাপ্লিকেশন জুড়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লেখালেখির জন্য নোটপ্যাড, ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের জন্য রাইট, আঁকাআঁকির জন্য পেইন্ট এবং হিসাব করার জন্য একটি ক্যালকুলেটর। এ ছাড়া রিভার্সি খেলাটির সাথে এখানে যোগ করা হয় বহুল জনপ্রিয় সলিটেয়ার গেমটি।

উইন্ডোজ ৩.১
১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল প্রিন্টযোগ্য ফন্ট যোগ করে উইন্ডোজ ৩.১ উন্মুক্ত করে। একই বছরের নভেম্বর মাসে মাল্টিমিডিয়া সংস্করণ বের হয়, এতে ভিডিও দেখার সুবিধা যোগ করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল সিডি-রমের মাধ্যমে শব্দ ও ভিডিও চালু করা।

উইন্ডোজ ৯৫
গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস সংবলিত এই অপারেটিং সিস্টেম ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট মুক্তি পায়। মাইক্রোসফটের আগের অপারেটিং সিস্টেম থেকে উইন্ডোজ ৯৫ অনেক ব্যতিক্রমী ছিল এবং বাজারে আসার পর বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অপারেটিং সিস্টেমটি নির্মাণের সময় এর নাম দেয়া হয় উইন্ডোজ ৪.০ বা ‘শিকাগো’। এতেই প্রথম ফাইলের নাম ২৫৫ অক্ষরে রাখার সুবিধা দেয়া হয়।

উইন্ডোজ ৯৮
উইন্ডোজ ৯৮ গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস অপারেটিং সিস্টেম। ১৯৯৮ সালের ২৫ জুন উইন্ডোজ ৯৮ অপারেটিং সিস্টেম উন্মুক্ত করে মার্কিন সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। এটিই প্রথম উইন্ডোজ ওএস, যা সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে ব্যবহার উপযোগী করে নকশা করা হয়। পাশাপাশি উইন্ডোজ ৯৮ ছিল প্রতিষ্ঠানটির এমএস-ডসভিত্তিক শেষ অপারেটিং সিস্টেম।

উইন্ডোজ মিলেনিয়াম
এই অপারেটিং সিস্টেমের সাথে ছিল ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৫.৫ ও নতুন মুভি মেকার সফটওয়্যার উইন্ডোজ মিডিয়া প্লেয়ার। এতে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস আরো উন্নত করে জুড়ে দেয়া হয়। উইন্ডোজ এমই-তে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৬ ও ৭, আউটলুক এক্সপ্রেস, মিডিয়া প্লেয়ার ৯-এ আপডেট করা যেত।

উইন্ডোজ ২০০০
উইন্ডোজ ২০০০ এমন এক অপারেটিং সিস্টেম, যা ব্যবহারকারী ও সার্ভার উভয় কম্পিউটারে ব্যবহার করা যেত। এটির চারটি সংস্করণ ছাড়া হয়। এগুলো হলো প্রফেশনাল, সার্ভার, অ্যাডভান্সড সার্ভার এবং ডেটা সেন্টার সার্ভার। উইন্ডোজ ২০০০ সার্ভারের বাড়তি বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাক্টিভ ডিরেক্টরি সেবা, বণ্টিত ফাইল ব্যবস্থা এবং অনাবশ্যক স্টোরেজ ভলিউমের ভুল ধরা ইত্যাদি।


 

শীর্ষস্থানে উইন্ডোজ
ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে বিশ্বে এখনো শীর্ষস্থানে রয়েছে উইন্ডোজ। চলতি বছরের জুন মাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখনো জনপ্রিয়তার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে উইন্ডোজ ৭। বিশ্বের ৬১.০ শতাংশ ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে ইন্সটল রয়েছে উইন্ডোজ ৭। উইন্ডোজ ৮.১ ও ৮ অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহারকারীর ১৬ শতাংশ।
বহুল জনপ্রিয় উইন্ডোজ এক্সপি ও কম জনপ্রিয় উইন্ডোজ ভিস্তার ব্যবহারকারী যথাক্রমে ১১.৯৮ ও ১.৬২ শতাংশ। আর এর বিপরীতে অ্যাপলের ম্যাক ওএস ব্যবহারকারী ৭.৫ শতাংশ ও লিনাক্স ব্যবহারকারী ১.৬ শতাংশ। উইন্ডোজ অন্য আপারেটিং সিস্টেমগুলো ১৩.৮ শতাংশ দখলে আছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের মন কতটা দখল করে আছে।


 

উইন্ডোজ এক্সপি
এই অপারেটিং সিস্টেম বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। মাইক্রোসফট ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর উইন্ডোজ এক্সপি উন্মুক্ত করে। এ যাবৎকালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বেশি বিক্রীত পণ্যগুলোর মধ্যে উইন্ডোজ এক্সপি অন্যতম। অপারেটিং সিস্টেমটির নকশা গ্রাহকবান্ধব হওয়ায় উন্মোচনের অল্প সময়েই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে। এ ছাড়া ওএসটির বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ও মেমোরি ব্যবস্থাপনায় যোগ করা হয়েছিল উন্নত প্রযুক্তি। এখনো বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ পার্সোনাল কম্পিউটারেই উইন্ডোজ এক্সপি ব্যবহার করা হচ্ছে।

উইন্ডোজ ভিস্তা
২০০৫ সালের ২২ জুলাই যখন ভিস্তার কাজ শুরু হয় তখন তা ‘লংহর্ন’ নামে পরিচিত ছিল। ২০০৬ সালের ৮ নভেম্বর ভিস্তার নির্মাণ শেষ হয়। এর পরের তিন মাসে অপারেটিং সিস্টেমটি পর্যায়ক্রমে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক ক্রেতা এবং সাধারণ গ্রাহকদের জন্য বাজারে আনা হয়। ২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ভিস্তার বাজারজাতকরণ শুরু হয় এবং সাধারণের হাতে চলে আসে। কিন্তু নিত্যনতুন ফিচার যুক্ত করা হলেও ধীরগতি বা নানা বাগ থাকার কারণে জনপ্রিয়তা পায়নি এই অপারেটিং সিস্টেম।

উইন্ডোজ ৭
ভিস্তার পর নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মাইক্রোসফটকে। তাই ২০০৯ সালে এটি বাজারে আনে উইন্ডোজ ৭। ৩২ বিট ও ৬৪ বিটের দুই রকমের সংস্করণে এটি বাজারে আনা হয়। এটি ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর সারা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
উইন্ডোজ ৭-এ নানা নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্পর্শ সুবিধা য্ক্তু করা, হস্তরেখা পরিচিতি, ভার্চুয়াল হার্ডডিস্ক সমর্থন, মাল্টিকোর প্রসেসরের উন্নতি, বুট সুবিধার উন্নতকরণ, রিমোট অ্যাক্সেসের ক্ষমতা ও কার্নেলের উন্নত সংস্করণ।

উইন্ডোজ ৮ ও ৮.১
উইন্ডোজ ৮ সংস্করণে আগের সংস্করণগুলো থেকে অনেক পরিবর্তন আনা হয়। বিশেষ করে এতে টাচস্ক্রিন ইনপুটের জন্য ডিজাইনকৃত নতুন একটি স্টার্টস্ক্রিন যোগ করা হয়, যা গতানুগতিক স্টার্ট মেনু থেকে আলাদা। তবে তা গ্রাহকপ্রিয়তা পায়নি। পরবর্তীকালে উইন্ডোজ ৮.১ উন্মুক্ত করা হয়। তবে এটিও জনপ্রিয়তা পায়নি।

উইন্ডোজ ১০
এতে মাইক্রোসফটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই অপারেটিং সিস্টেম একই সাথে কম্পিউটার, ট্যাব ও স্মার্টফোনে কাজ করে। পুরনো ব্যবহারকারীরা যাতে ঝামেলায় না পড়েন, সে জন্য এতে থাকছে চিরচেনা স্টার্ট মেনু। এ ছাড়া এতে থাকছে মেট্রো মুড, ভার্চুয়াল ডেস্কটপ, নতুন নোটিফিকেশন অপশন, টাচস্ক্রিনের মতো চমৎকার সব ফিচার।

উন্মুক্ত হয়নি যেসব উইন্ডোজ
উইন্ডোজ এক্সপি উন্মোচনের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মাইক্রোসফটকে। ৩০ বছরের পথচলায় মাইক্রোসফটের বেশির ভাগ অপারেটিং সিস্টেম সবার কাছেই কম-বেশি পরিচিত। কিন্তু এমন তিনটি উইন্ডোজ সংস্করণ আছে, যেগুলো উন্মুক্ত করা হয়নি। এগুলো হলোÑ উইন্ডোজ ন্যাশভিল, উইন্ডোজ কায়রো ও উইন্ডোজ নেপচুন।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.