এজোলা আনতে পারে কৃষি বিপ্লবে নতুন দিগন্ত
ডা. আলমগীর মতি ।
এজোলা (Azolla anabaenae) এক ধরনের জলজ ফার্ণ। এটা ধানক্ষেত, ছোট ছোট পুকুর, ডোবা, খাল ও নদীর পানির উপরিতলে জন্মায়। এটা ধান ও অন্যান্য ফসলের ছায়ায় সুসজ্জিতভাবে অবস্থান করলেও ফসলের কোনো ক্ষতি করে না। উপরন্তু এটা পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সরবরাহ করে।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই সার হিসেবে এজোলা ব্যবহূত হয়ে আসছে। নাইট্রোজেনের সবচেয়ে সহজলভ্য উত্স হিসেবে এজোলোকে প্রথম আবিষ্কার করে চীন। রেকর্ড আছে যে, ১৭শ শতাব্দীর প্রথম দিকে চীন এবং ভিয়েতনামের ভালো সবুজ সার হিসেবে এজোলা ব্যবহূত হতো। এমনকি ছোট নাইট্রোজেন সার কারখানায়ও এজোলা ব্যবহূত হতো। ১৯৮০ সালের প্রথমদিকে ফিলিপাইনে সবুজ সার হিসেবে এটি ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তবে ভারত উপমহাদেশে এর ব্যবহার খুবই সীমিত। কিন্তু বর্তমানে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হচ্ছে।
এজোলা প্রধানত সার হিসেবে ধান ও গম ক্ষেতে বা কফি বাগানে ব্যবহূত হয়। ধান গাছ বন্যার পানি থেকে সরাসরি পুষ্টি নিতে পারে না। এজোলা বন্যার পানি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে এবং পচে মাটিতে মেশার পর ধান গাছ তা গ্রহণ করে।
এজোলা খুব দ্রুত পচে মাটিতে NH4+H রূপে খনিজ পদার্থে পরিণত হয় যা খুব অল্প সময়ের মধ্যে ধানসহ অন্যান্য গাছ সহজেই গ্রহণ করতে পারে। এই ফার্ণ পটাশও জমা করে রাখতে পারে যা প্রয়োজন অনুযায়ী গাছ পাঁচবার পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া ধান ক্ষেতে যে বন্যার পানি থাকে এজোলা তা থেকে এমোনিয়া গ্রহণ করে ক্ষারীয় হতে বাধা দেয়।
এজোলা পানির উপরিভাগ ঢেকে রাখে ফলে সূর্যের আলো পানির নীচে প্রবেশ করতে পারে না, যার কারণে পানিতে বিদ্যমান আগাছা জন্মাতে পারে না। সুতরাং দেখা যায় যে, এজোলা ধানের জমিতে জন্মানো আগাছা কমাতে সাহায্য করে।
বর্তমান বিশ্বে কৃষকগণ উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের উত্স হিসেবে জৈব সার, সবুজ সার ও অন্যান্য জৈব পদার্থ ব্যবহার করছে। কারণ ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটি তার উর্বরতা হারাচ্ছে।
সারকারখানাগুলো ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ করলেও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক চিন্তা করে জৈব নাইট্রোজেন আবদ্ধ অধিক পছন্দনীয় এবং এই পদ্ধতিই ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এক হেক্টর জমিতে ৭৫ দিনে উত্পাদিত এজোলা তিন স্তর সবুজ সার উত্পাদন করতে পারে, যা প্রতি হেক্টর জমিতে ২৫ কেজি নাইট্রোজেন সংবন্ধনের সমান পরিমাণ।
এছাড়া কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড় ও আগাছা দমনে এজোলার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ফার্ণ এখন পৃথিবীতে শুধু অল্প কিছু জায়গায় পাওয়া যায় এবং ক্রমে তা বিরল প্রজাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত এখনই এই গুরুত্বপূর্ণ এজোলা নিয়ে গবেষণা করা। গবেষণার দিকগুলো হতে পারে নিম্নরূপঃ * এজোলার বীজাণু (germplasm) সংগ্রহ ও সংরক্ষণ * বিভিন্ন প্রজাতির এজোলার নাইট্রোজেন আবদ্ধ পরিমাণ নির্ণয় * এজোলা উত্পাদনের জন্য আদর্শ পরিবেশ নির্ণয়। * এজোলার স্পোর অঙ্কুরোদগমের (germination) জন্য উন্নত কৌশল উদ্ভাবনা। * আলাদা, আলাদা (Anabaena azolla)-এর গোত্র নির্ণয়ের জন্য কৌশল উদ্ভাবন।
আমরা আশা করতে পারি, সামনের দিনগুলোতে বৈজ্ঞানিক ও পরিকল্পনাবিদগণ চাষিদেরকে পরিবেশ বান্ধব জৈব সার হিসেবে এজোলার গুরুত্ব বোঝাতে পারবেন এবং ফসল উত্পাদনে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সরবরাহের জন্য এজোলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন।
লেখক : বিশিষ্ট হারবাল গবেষক ও চিকিত্সক