ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস

আজ ২ মার্চ। ১৯৭১ সালে এই দিনেই পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। উনসত্তরের গণআন্দোলনের পর দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আবারও অননতি ঘটে, এরসাথে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির অত্যাচার  আরও বেড়ে যায়, সত্তরের নির্বাচনের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় জনতা তখন স্বাধীনতার কথা ভাবতে থাকে, ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে সেদিন সাড়া দিয়েছিলেন আমজনতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বোনা হয়েছিলো।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ আ. স. ম. আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে বটতলায় এক ছাত্র সমাবেশে বাঙালি জাতির স্বপ্নের লাল-সবুজের পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করেন।

এর আগে ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের অংশগ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের নিয়ে একটি জয় বাংলাবাহিনী গঠন করা হয়। সেসময় ছাত্র বাহিনীরা একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৭০ সালে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ. স. ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসূফ সালাউদ্দিন আহমেদ।

এ সভায় কাজী আরিফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। এরপর ইউসূফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে হল (বর্তমান তিতুমীর হল) ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র।

এই ২ মার্চকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বাংলদেশে জাতীয় পতাকা দিবস পালিত হয়। এবং তার পরের দিন ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মোহাম্মদ শাজাহান সিরাজ। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ধানমন্ডিতে, তার নিজ বাসভবনে। বিদেশের মাটিতে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ সাল ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় একই রকম দেখতে এক পতাকা ব্যবহার করা হতো, যেখানে মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়। মানচিত্রটি পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার সমস্যার কারণে পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়।

বাংলাদেশের পতাকা সকল দিবসে সাধারণ মানুষের উত্তোলন করা আইনত অপরাধ। তবে জাতীয় প্রতীক যে সকল দিবসে উত্তোলন করা যাবে তা হলো স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবসসহ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত অন্য যে কোনো দিবসে।

যে কোনো দিবসে এই প্রতীক ব্যবহারের অধিকারী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তবে বাংলাদেশের পতাকা ১৫টি বাসভবনে উত্তোলন করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, বিদেশে বাংলাদেশের কূটনীতিক এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।

ব্যক্তিগত গাড়ি, জলযান ও বিমানে যারা জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন তারা হলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রীর মর্যাদা সর্ম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, বিদেশে নিযুক্ত কূটনীতিকগণ।

জাতীয় পতাকা যে সকল দিবসে অর্ধনমিত থাকে তা হলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস), ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকার কর্তৃক অন্য যে কোনো দিবসে।

জাতীয় পতাকার বিধিমালা ১৯৭২ অনুযায়ী জাতীয় পতাকা মাপের সুনির্দিষ্ট বিবরণ হলো, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:০৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লালা বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। পতাকার দৈর্ঘ্যের নয়-বিংশতিতম অংশ অঙ্কিত উলম্ব রেখা এবং পতাকার প্রস্থের মধ্যবর্তী বিন্দু হতে অঙ্কিত আনুভূমিক রেখার পরস্পর ছেদ বিন্দুতে বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু হবে। অর্থাৎ পতাকার দৈর্ঘ্যের বিশ ভাগের বাম দিকের এবং নয় ভাগের শেষ বিন্দুর ওপর অঙ্কিত লম্ব এবং প্রস্থের দিকে মাঝখান বরাবর অঙ্কিত সরল রেখার ছেদ বিন্দু হলো বৃত্তের কেন্দ্র। পতাকার সবুজ পটভূমি হবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়াল্ট গ্রিন এইচ-২ আর এস ৫০ পার্টস এবং লাল বৃত্তাকার অংশ হবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ এইচ-২ আর এস ৬০ পার্টস।

পতাকা ব্যবহারে বাংলাদেশ সর্বশেষ বিশ্বরেকর্ড করেন ২০১৩ সালে ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন বাংলাদেশের ৪৩তম বিজয় দিবসে ২৭ হাজার ১ শত ১৭ জন লোক লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে মানব-পতাকা তৈরি করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থানলাভ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.