কণ্ঠসাধক আবদুল আলীম ও তার অবদান
কণ্ঠসাধক আবদুল আলীম ও তার অবদান

আবদুল আলীম বাংলা গানের ইতিহাসে এক অমর, অপরাজেয় নাম। আধ্যাত্মিক গান, ইসলামী গান, মরমী গান, ভাটিয়ালি গান ও পল্লী গানের ক্ষেত্রে তিনি এমন এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, যে উচ্চতাকে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী শিল্পীদের কেউই স্পর্শ করতে পারেননি। এদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একশটি চলচ্চিত্র সমৃদ্ধ হয়েছে তার গানে। গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে প্রকাশ হয়েছে তার প্রায় ৫০০ গান। বেতার ও টিভিতে গেয়েছেন তিনি অসংখ্য গান।
অমর এই শিল্পী আবদুল আলীমের আজ ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রকাশ পেয়েছে তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড। ওস্তাদ মমতাজ আলী খান ও মোহাম্মদ হোসেন খসরুর সান্নিধ্যে তিনি তার কণ্ঠসাধনাকে ক্রমাগত এক উচ্চতর সাধনার দিকে নিয়ে গেছেন। মাত্র ১১ বা ১৩ বছর বয়সে কলকাতার এক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের। ওই অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় গান পরিবেশন করেছিলেন তিনি। তার বড় ভাই তার অজান্তেই আয়োজকদের স্লিপ দিয়েছিলেন। নাম ঘোষণা হবার পর তিনি ধীর পায়ে মঞ্চে গিয়ে পরিবেশন করেছেন গান। উপস্থিত শ্রোতারা মোহমুগ্ধ হয়ে পড়েছিল তার গান শুনে। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। কিশোর আবদুল আলীমকে সেদিন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা শেরে বাংলা যে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন সেটিও ছিলো অপূর্ব ঘটনা। অনুষ্ঠান শেষে শেরে বাংলা এই কিশোর শিল্পীকে নিয়ে যান কোন এক মার্কেটে এবং কিনে দেন মূল্যবান সব উপহার সামগ্রী। পেছনে ফেরার আর কোন পথই ছিল না আবদুল আলীমের। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে ৫ই আগস্ট ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি গান গেয়েছেন।
আবদুল আলীমের কণ্ঠ আজও ধ্বনিত হয় বাংলার এ প্রান্তর থেকে তেপান্তরে। আজও তার গান বেজে উঠলে সব প্রজন্মের শ্রোতাই তন্ময় হয়ে শোনেন। আবদুল আলীমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সোহরাব হোসেন। তিনি মনে করেন, আবদুল আলীমের কণ্ঠ সত্যিকার অর্থেই অবাক করার মতো। বিচিত্র ধরনের গান আবদুল আলীম গেয়েছেন। যখনই তিনি যে গান গেয়েছেন সে গানে ঢেলে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, তার নিবেদন ছিলো সম্পূর্ণ অকৃত্রিম। এক অপূর্ব কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি। এই কণ্ঠই তাকে নিয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের একেবারে কাছাকাছি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর আবদুল আলীম চলে আসেন ঢাকায়। যোগদান করেন পাকিস্তান রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে। মেঘনার কুলে, আর কত কাল, ও পদ্মা নদীরে, আমার প্রাণের প্রাণ পাখি, আল্লাহু আল্লাহু, নবী মোর পরশ মণির মতো অসংখ্য গান তিনি করেছেন যা কোনদিন হারিয়ে যাবার নয়। শুধু এ কটি গান কেন আবদুল আলীমের গাওয়া এমন শত শত গান হারাবার মতো মনে হয় না। পাকিস্তান রেডিওতে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবি জসীম উদ্দীন, কানাইলাল শীলসহ বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। সব স্তরের, সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মনে তিনি এমন এক স্থান লাভ করেছেন যা শুধুমাত্র আববাস উদ্দীন আহমদের ভাগ্যে ঘটেছিল। সে কারণে আজও আববাস উদ্দীন ও আবদুল আলীমের নাম জোড়া পাখির মতোই সর্বত্র উচ্চারিত হয়। আবদুল আলীম ১৯৭৪ সালে চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করার জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বহু পদক-পুরস্কার লাভ করেছেন, হয়েছেন বহু অভিধায় ভূষিত। যে চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার তিনি পেয়েছেন সেটি ছিলো খান আতাউর রহমান পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র সুজন সখি। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করেন।
আবদুল আলীম এমন এক মহা সাধক যে তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রেডিও থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ইতিহাস এখন আর কেউ উল্লেখও করেন না। ঘটনাটি বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত পরিচালক আবদুল আহাদের আত্মজীবনী আসা-যাওয়ার পথের ধারে গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। বইটি ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করেছে জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি। আফসোসের ব্যাপার এই যে, এই মহান কিংবদন্তি শিল্পীকে জাতি আজও যথাযথ সম্মান জানাতে পারেনি। নির্মিত হয়নি তাকে নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র, হয়নি কোন পূর্ণাঙ্গ গবেষণা, অনুসন্ধানের বাইরে রয়ে গেছে তার জীবন ও সাধনার নানা দিক। তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হতে পারে। হয়নি আজও তেমন কিছু। হবে কি না ভবিষ্যতে কে বলতে পারে সেই সম্ভাবনাময় কথা!
গীতিকার, সুরকার ও তরুণ লেখক