কুয়াশা মোড়ানো শীতে ধোয়া উঠা ঐতিহ্যের ভাপাপিঠা

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)

শীত এলেই যেন হরেক পদের সুস্বাদু পিঠার বাহারী আয়োজন। কুয়াশা মোড়ানো শীত; হিমেল হাওয়ায় ধোয়া উঠা ‘ভাপা’ পিঠার স্বাদ না নিলে যেন বাঙালির অতৃপ্তি কাটেই না। নিজেদের আদি ঐতিহ্য অব্যাহত রাখতে ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে পিঠা তৈরী ও থাওয়ার ধুম। এছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদার কারণেই বিভিন্ন জনবহুল স্থানে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ভাপা পিঠার পাশাপাশি চিতই পিঠা, তেল পিঠার দোকান নিয়ে বসেছেন। শীতের সকাল কিংবা সন্ধ্যায় হাওয়ায় ভাসছে এসব পিঠার ঘ্রাণ।

নতুন খেঁজুরের গুড়, আর নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় এসব পিঠা। গরম পানির ভাপে এ পিঠা তৈরি হয় বলে এর নাম হয়েছে ভাপা পিঠা। পিঠাকে মুখরোচক করতে গুড় আর নারিকেলের সাথে সামান্য পরিমাণ লবন মেশানো হয়। এতেই স্বাদ বাড়ে বলে জানিয়েছেন দোকানীরা। ভাপা পিঠা তৈরিতে সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, মাটির হাঁড়ি ও মাঝ বরাবর বড় ছিদ্র করা মাটির ঢাকনা। হাঁড়িতে ছিদ্র করা ঢাকনা লাগিয়ে আটা গুলিয়ে ঢাকনার চারপাশ ভালোভাবে মুড়ে দিতে হয়, যাতে করে হাঁড়ির ভেতরে থাকা গরম পানির ভাপ বের না হতে পারে।

এমন সময় গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে মেয়ে-জামাতা, বিয়াই-বিয়াইনসহ বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন এবং দূর দূরান্তে অবস্থান করা পরিবারের সদস্যদের মাঝে এক অঘোষিত পিঠার নিমন্ত্রণের রব পড়ে যায়।

তেরশ্রী গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ হাজেরা বেগম বলেন, শীতের পিঠা খাওয়াতে তিন মেয়ে ও জামাতাদের দাওয়াত করে এনেছি। একমাত্র ছেলে চাকরি সূত্রে সপরিবারে থাকে গাজীপুরে। তাদেরকেও ফোন করে বাড়িতে এনেছি। সবাই মিলে একসাথে পিঠা না খেতে পারলে মনটা আনচান করে।

মানিকগঞ্জের ঘিওর বাসস্ট্যান্ডের অস্থায়ী পিঠা বিক্রেতা রাহিমা বেগম জানান, ছোট গোল বাটি জাতীয় পাত্রে চালের গুঁড়া খানিকটা দিয়ে তারপর খেঁজুর অথবা আখের গুড় দিয়ে আবার কিছু চালের গুঁড়া দিয়ে বাটিটি পাতলা কাপড়ে পেঁচিয়ে ঢাকনার ছিদ্রের মাঝখানে বসিয়ে দেয়া হয়। ২/৩ মিনিট ভাপে রেখে সিদ্ধ হয়ে তৈরি হয় মজাদার ভাপা পিঠা। প্রতিটি ভাপা পিঠা বিক্রি হয় ৫ থেকে ১০ টাকায়।

অনুরূপভাবে চালের গুড়ার আটা গুলিয়ে তাওয়ায় বসিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় মজাদার চিতই পিঠা। চাটনি, ধনে, কাঁচা মরিচ, সরিষা বাটা ও গুঁড় দিয়ে দোকানীরা পরিবেশন করেন বলে জানালেন মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পিঠা বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন।

আকার এবং প্রকারন্তে প্রতিটি বিক্রি হয় ৫, ১০ ও ২০ টাকায়। তেল পিঠা তৈরিতে নতুন চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে তেলে ভেজে নিয়ে তৈরি করা হয় তেল পিঠা। যা বিক্রি হয় ৫ টাকায়। কম পুঁজিতে যে কোন স্থানে সহজে বাজারজাত করা যায় বলে অনেক ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এসব পিঠার দোকান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এই পিঠা বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতদিন প্রকৃতিতে শীত থাকবে ততদিন দেখা মিলবে ভাপা, চিতই আর তেল পিঠার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.