কেন করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে পরামর্শ মানছে না মানুষ

শরীরে নভেল করোনাভাইরাস রয়েছে কিন্তু বুঝতে পারার মতো উপসর্গ দেখা দেয়নি বলে যারা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের কারণে একটি পুরো কমিউনিটি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জোর প্রচার চালানো হলেও মানুষ খুব একটা কেয়ার করছে না। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পার্ক, সমুদ্র সৈকত বা বিভিন্ন পর্যটন স্পটে জড়ো হচ্ছেন। অথচ এ ধরনের উদাসীনতা ও অসচেতনতা তাকে সপ্তাহখানেকের জন্য হাসপাতালের বেডে নিয়ে ফেলতে পারে অথবা ভেন্টিলেটরে গিয়ে হাঁসফাঁস করতে হতে পারে!

এমন সংক্রামক ব্যাধির মহামারির সময় সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ সচেতনতা ও সতর্কতা খুব জরুরি। এখনই যদি আমরা সংক্রমণের কার্ভটিকে আনুভূমিক করে ফেলতে না পারি তাহলে এটি আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, যা বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তখন চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাছাই করার মতো নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

কিন্তু এখনো সারা বিশ্বেই বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে অস্বীকার করছেন। তারা চুল কাটাতে, শেফ করতে বা চুলে রঙ করতে সেলুনে যাচ্ছেন, কেউ যাচ্ছেন সমুদ্র সৈকতে, কেউ আবার বাড়িতে পার্টি দিচ্ছেন। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে।

নাগরিকদের এমন বেপরোয়া আচরণের কারণে বার্লিন পুলিশ ৬৩টি বার ও ক্লাব বন্ধ করে দিয়েছে। নিউইয়র্কের মেয়র জিমে যাওয়া বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ভারত পুরো দেশ লকডাউন করার কথা ভাবছে।

বিশ শতকের শুরুর দিকে মাত্র একজন নারীর কাছ থেকে ব্যাপকভাবে টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। ওই নারী ‘টাইফয়েড মেরি’ নামে ইতিহাসে ‘কুখ্যাত’ হয়ে আছেন। ওই নারীর শরীরে কখনোই টাইফয়েডের লক্ষণ দেখা যায়নি। এখন এমন হাজার হাজার ‘করোনা চাঁদ’ বা ‘করোনা কামিলা’ রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিনা কে জানে! তাদের কারণেই মহামারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগেও কেন মানুষ করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক জীবাণু সম্পর্কে উদাসীন থাকছে। এমন জরুরি অবস্থাতেও মানুষ কেন নিয়ম মানতে নৈতিক বাধ্যবাধকতার ধার ধারছে না?

এর চারটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন মনোবিজ্ঞানীরা-

প্রথম কারণটি খুবই সাধারণ- অজ্ঞতা। আমরা যারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ভয়াবহ সঙ্কট নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং প্রতিনিয়ত এ সংক্রান্ত সংবাদ পড়ে, শুনে বা দেখে হালনাগাদ থাকছি তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছি দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এসবের ধারেকাছেও নেই। তারা নিয়মিত এসব খবর দেখছেন না। অথবা তারা টিভি, রেডিও বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অন্যকিছু দেখে সময় ব্যয় করছেন। তারাই মূলত জনস্বাস্থ্যের এই জরুরি অবস্থাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, বা কম গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা অবলীলায় বাজারে, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছেন। চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। তারা এ মহামারীর ভয়ঙ্কর পরিণতি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এটি না জেনে পাপ করার মতো ব্যাপার। তাদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে!

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হতে পারে স্বার্থপরতা। মামুলি কারণেও তারা বাইরে বের হচ্ছে কারণ প্রাপ্ত তথ্যউপাত্ত বলছে তাদের বয়সীদের মৃত্যুহার অত্যন্ত কম। এই তথ্যউপাত্তে বিশ্বাস করছে তারা। ফলে এদের কারণে অন্যরা ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে পড়ছে। চীন এবং ইতালি থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক উপাত্ত বলছে, গড়পড়তা তরুণরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তেমন ঝুঁকিতে পড়ছে না। সুতরাং বয়সের কারণে এ মহামারী থেকে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল এমন ভেবেই তরুণদের মধ্যে বেপরোয়াভাব দেখা যাচ্ছে। এটি নিখাত স্বার্থপরতা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোটেও অযৌক্তিক বলা যাবে না।

বিপুল সংখ্যক মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রাখার পরামর্শ মানছে না, এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে তারা আহ্বানকারীকে প্রত্যাখ্যান করছে বা তারা অন্যের লাভক্ষতিকে মোটেই কেয়ার করে না। বরং তারা এমন করছে কারণ তারা বুঝতে পারছে না তাদের কাজ বা তৎপরতা অন্যদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে। তারা আছে নিজের চিন্তায়। এই আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে তাদের আশেপাশে সারা বিশ্বে কী ঘটছে এবং এই পরিস্থিতিতে তার কী ভূমিকা বা করণীয় থাকতে পারে তা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।

তৃতীয় কারণ মানুষের নৈতিক চরিত্র। মানুষ সাধারণত চোখের সামনে ঘটে চলা ভোগান্তির জন্য ত্যাগ স্বীকার করে। কিন্তু সেটি যদি তাদের চোখের আড়ালে ঘটে বা সহজে দৃষ্টিগোচর না হয় তাহলে সেটি নিয়ে খুব একটা বিকার তাদের মধ্যে দেখা যায় না।

দার্শনিক পিটার সিঙ্গার এই প্রবণতা যাচাই করতে একটি অতি সাধারণ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেটি তিনি তার একটি বিখ্যাত গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, পার্কে হাঁটতে গিয়ে যদি কেউ একটি শিশুকে পুকুরে ডুবতে দেখে, তাহলে পরনের দামি ও প্রিয় পোশাকটি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও তাকে রক্ষা করতে তার ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যের বিপদে তুলনামূলক কম ক্ষতিস্বীকার করে সাহায্য সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতার বোধ কাজ করে।

সিঙ্গার এবার আরেকটি ভিন্ন দৃশ্য কল্পনা করেন। ওই শিশুটি যদি জীবনহুমকির মধ্যে থাকে এবং ধরা যাক এখন সে হাজার মাইল দূরে কোথাও আছে। পছন্দের একটি পোশাক কেনার সমান অর্থ দান করলে শিশুটি বেঁচে যেতে পারে। সিঙ্গার বলছেন, এক্ষেত্রেও তাকে সাহায্য করার নৈতিক বাধ্যবাধকতার বোধ কাজ করবে। তবে নিজের পছন্দের জিনিসটি কিনতে যে মূল্য লাগবে, দূরবর্তী ওই শিশুটির জীবনের মূল্য তার কাছে সমান মনে হবে। এবং ওই পার্কের পুকুরে ডুবতে থাকা শিশুকে রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো বাধ্যবাধকতার বোধ অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই আর দেখা যাবে না।

কভিড-১৯ এর এই সময়ের ব্যাখ্যায় পিটার সিঙ্গারের এই তত্ত্ব সমানভাবে ব্যবহার করা যায়। বারবার বলার পরও যারা ঘরে থাকতে রাজি হচ্ছেন না, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চাক্ষুস দেখছেন না। এমনকি তারা ভৌগলিকভাবে কাছাকাছি থাকলেও। এবং তারা হয়তো কখনোই বুঝে উঠতে পারবেন না যে, তাদের এই আচরণ অন্যদের জন্য কী ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। দূরত্বই তাদের এভাবে ‘বিবেকহীন নির্বিকার’ স্বার্থপর মানুষে পরিণত করছে।

হয়তো এ তিনটি তত্ত্বই সাধারণ মানুষের এই প্রবণতাকে অনেকখানি ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু পুরোটা বুঝতে তা যথেষ্ট নয়। সম্প্রতি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এক দল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বিশাল পার্টি করেছে। তাদের তো শিক্ষাদীক্ষার অভাব নেই। আবার অনেক বয়স্ক লোকও বাইরে এমনভাবে ঘোরাফেরা করছেন যেন কিছুই হয়নি। তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে তাদের কেউ এমনভাবে প্ররোচিতও করেনি। তাছাড়া যারা বারে যাচ্ছেন তাদের কিন্তু এটা বুঝানো কঠিন নয় যে তাদের কারণে তাদের কোনো প্রিয়জন মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে।

এ ধরনের প্রবণতাকে ব্যাখ্যায় আরেকটি তত্ত্বের কথা বলা হচ্ছে। আগের তিনটি তত্ত্বের মতো এখানে অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা বা ত্যাগের বিষয়ে নৈতিক বাধ্যবাধকতার কোনো বিষয় নেই; বরং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দিতে অভ্যস্ত সেদিকে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে।

যেমন, সবাই জানে বন্দুক একটা ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র। এখন কোনো অপরিচিতের মাথায় বন্দুক ঠেকাতে বললে মনের ভেতর থেকে তীব্র প্রতিবাদ আসবে। সিরিয়াল কিলার না হলে ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এমন একটা দুনিয়াতে বসবাস করি যেখানে পাড়ার টং দোকানির কাছ থেকে গরম চায়ের কাপটি ধরার সিদ্ধান্ত নেয়া বা খোশগল্প করার জন্য কোনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার মতো বিষয়গুলোর গভীর কোনো নৈতিক তাৎপর্য নেই। ফলে এই মুহূর্তে এসব কাজকর্ম বিপজ্জনক কিনা তা নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন একটা ভাবনা হচ্ছে না। বা মানুষ এগুলোকে একেবারে নির্দোষ বলে মনে করছে।

ফলে বলা যায়, আমাদের নৈতিক প্রেরণা এমন একটি অসম্ভব সঙ্কটময় সময়ে এসে আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারছে না। এই ধরনের সাধারণ কার্যক্রম বা অভ্যাসের (হাত মেলানো, কোলাকুলি করা, মেলামেশা, গল্পগুজব করা ইত্যাদি) কারণে প্রাণহানির ঝুঁকি তৈরি হবে- এমন সতর্কবার্তা মানুষের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিতে খুব একটা আবেদন তৈরি করতে পারছে না।

মানুষ কেন জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শগুলো উপেক্ষা করছে তা ব্যাখ্যা করতে এসব তত্ত্ব সহায়তা করতে পারে। তবে এমন ব্যাখ্যাই কিন্তু এ ধরনের সঙ্কটমুহূর্তে নিয়ম না মানার অজুহাত হতে পারে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আপাত নির্দোষ কাজকর্মও কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টানার সমান হতে পারে।

সুতরাং নিজের, সমাজের ও বিশ্ব মানবতার স্বার্থে এই মুহূর্তে সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রাখাটা সবার জন্য জরুরি। এখানে সাধারণ প্রবৃত্তি বা স্বার্থপরতার পিছে দৌড়ালে অন্যদের তো বটেই নিজের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

ভাষান্তর : জাহাঙ্গীর আলম
তথ্যসূত্র: দ্য আটলান্টিক, দ্য হিল
বণিক বার্তা অনলাইন