কোরবানির অর্থনীতি
কোরবানির অর্থনীতি
মামুন রশীদ | ২০১৫-০৯-২৩ ইং
বাংলাদেশে দিন দিন কর্মোদ্দীপনা বাড়ছে। অনেক মানুষ একটির জায়গায় দুটি কাজ করছেন। বেশি সময় ধরে অফিসে থাকছেন। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে সপ্তাহান্ত কিংবা দীর্ঘ ছুটি কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষের উত্তর আমেরিকার মতো কর্মকাণ্ড বাড়ছে। বিশেষ করে রোজা ও কোরবানির ঈদ উপলক্ষ করে প্রচুর লেনদেন হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করেও বিপুল লেনদেন হচ্ছে। কোরবানির ঈদের সময় গবাদিপশু ক্রয়, কোরবানি ও মাংস রান্নার সঙ্গে সম্পর্কিত উপকরণের বিকিকিনি হয়। এতে আর্থিক লেনদেন বাড়ছেই। এছাড়া আছে জাকাত কিংবা দান-খয়রাত। একে কেন্দ্র করেও মানুষের লেনদেন দিন দিন বাড়ছে।
কোরবানির ঈদে বাংলাদেশে ৬০ থেকে ৮০ লাখ গবাদিপশু জবাই করা কিংবা কোরবানি দেয়া হয়। তার মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ লাখ হলো গরু ও মহিষ। আর বাকিটা খাসি বা ছাগল। যদিও কারো কারো মধ্যে ইদানীং উট কিংবা দুম্বা কোরবানি দেয়ার তত্পরতাও দেখা যাচ্ছে। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৭৮ লাখ গরু ও ছাগল কোরবানি হয়েছিল। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৩০ লাখ গরু ও ৫৫ লাখ ছাগল কোরবানি করা হয়। একই সময়ে ২০ লাখ গরু আমদানি হয়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) মতে, ২০১৪ সালে ৩৫ লাখ গরু ও ৫০ লাখ ছাগল বা খাসি কোরবানি দেয়া হয়। ২০১৫ সালে কোরবানির পশুর সংখ্যাটি প্রায় এক কোটিতে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বছরে ১৫-২০ লাখ গরু কিংবা মহিষ আসে নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। তার মধ্যে ১০-১৫ লাখ গরু-মহিষ আসে শুধু কোরবানির সময়ে। ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হওয়ায় সেখানে যেহেতু গরু পূজনীয় পশু, সেহেতু দেশটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গরু রফতানি উত্সাহিত করে না। তার পরও দেখা যায়, ভারতের ওডিশা, বিহার, অন্ধ্র প্রদেশ তথা দক্ষিণ ভারত গরুতে উদ্বৃত্ত হওয়ায় দুধটা তারা পরিভোগ করছে, কিন্তু ধর্মীয় কারণে মাংসটা পরিভোগ করছে না। আবার সেখানে প্রক্রিয়াজাত করে মাংসটা যে বাইরে রফতানি করবে, সে ধরনের ব্যবস্থাও পরিপূর্ণভাবে এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে ভারতীয় গরুর মালিকের কাছে একটা বড় ব্যাপার ছিল— পরিশেষে হালের গরুটি কী করবে? সেক্ষেত্রে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে গরু কিংবা গো-মাংস রফতানি উত্সাহিত না করলেও বিপুল সংখ্যক গরু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসে। ভারত থেকে গরু এনে বাংলাদেশে মাংসের চাহিদা না মেটালে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৫০০-৬০০ টাকা হতো বলেও একটি ধারণা প্রচলিত আছে। সেক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত সত্য, ভারত থেকে সহজলভ্যভাবে গরুর মাংস খেতে পারছে মানুষ এবং কোরবানির সময় অনেক গরু আসছে। এবার ভারত থেকে অনানুষ্ঠানিক পথে গরু আমদানির ক্ষেত্রে কলকাতার এক সমাবেশে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে যখন বাংলাদেশে আর গরু রফতানি করা যাবে না এমন বলেছিলেন, তখন একটু সন্দেহ দেখা গিয়েছিল। যদিও আমরা মনে করেছিলাম, পরবর্তীতে এটি ধরে রাখা যাবে না। অনেক সময় বাংলাদেশের মতো ভারত সরকারও অনেক নীতি প্রণয়ন করে ব্যক্তি কিংবা মাঠ পর্যায়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে না। সেক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত ছিলাম, গরু রফতানির নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে যাবে। গণমাধ্যমেও বলেছিলাম, সমস্যাটি হয়তো থাকবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোরবানির ঈদে ইদানীং ১৫-২০ লাখ গরু কিংবা মহিষ আমদানির দরকার হচ্ছে। এনজিও বা কৃষিঋণের সহায়তা নিয়ে গবাদিপশু পালনে শিল্পটি বেশ এগিয়েছে এবং আমরা মনে করছি, আলোচ্য সংখ্যার মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ গরু কিংবা মহিষের চাহিদা মেটাতে পারবেন আমাদের কৃষকরাই। এর সঙ্গে রয়েছে মিয়ানমারের গরু বা মহিষ। আমরা মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি করি না, করলেও খুব কম। সেক্ষেত্রে গরু আমদানির ক্ষেত্রে আমরা মিয়ানমারকে বেছে নিতে পারি, নেপালকে বেছে নিতে পারি। নেপাল থেকে আনাটা একটু কঠিন হবে, কিন্তু মিয়ানমার থেকে সহজ। তবে এরই মধ্যে শুনতে পেয়েছি, ভারত থেকে আবার গরু আনা শুরু হয়েছে। এই সরবরাহ সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে, গেল বছরগুলো থেকে ধীরে ধীরে গরুর গড় দাম বাড়ছে। ৩০ থেকে ৪০ লাখ গরু যে কোরবানি দিই, এর মধ্যে অনেক সংখ্যক জাকাত বা দান হিসেবে দেয়া হয়, আবার অনেকগুলো ভাগাভাগিতে কোরবানি দেয়া হয়। এজন্য কোরবানির মাধ্যমে উপকৃত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাত কোটির কাছাকাছি। তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেকেই গ্রামাঞ্চলে কোরবানি দেন না। কোরবানির সময় শহরে চলে আসেন। মাংস সংগ্রহ করে গ্রামে নিয়ে যান। শহরের বড় বড় ব্যবসায়ী ও বিত্তবানরা আবার গ্রামেও একটি কোরবানি দেন এবং গরিবদের মধ্যে মাংস বিতরণ করেন, এতিমখানায় বা মাদ্রাসায় বিতরণ করেন। আবার বিভিন্ন জাকাত ফান্ডে টাকাও দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে কোরবানির সময় তিনটি বিষয় ঘটে। এক. গরু, মহিষ, ছাগল বা বকরি যে কোরবানি দিচ্ছে, তার বাজারটা কতটুকু; দুই. আমাদের চামড়া শিল্পেরও প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ কিন্তু সংগ্রহ করা হয় কোরবানি ঈদের সময়ে। এর কিছুটা চামড়া অন্যান্য সময়েও যাচ্ছে ট্যানারিগুলোয় এবং তিন. টাকার লেনদেন। এই তিন বিষয় ঘিরে সাধারণত আমরা দেখতে পাচ্ছি কোরবানির অর্থনীতিটা পরিচালিত হচ্ছে।
এক্ষেত্রে প্রতিটি গরু বা মহিষের গড় দাম ২০ হাজার ধরে ৪০ লাখ গরু বা মহিষের কথা চিন্তা করলে কোরবানি বাবদ আমাদের খরচ হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আবার প্রতিটি খাসি কিংবা ছাগলের গড় দাম ১০ হাজার টাকা ধরে ৫০ লাখ খাসি কিংবা বকরি চিন্তা করলে আমাদের খরচ হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কোরবানি উপলক্ষে চামড়া সংগ্রহ বাবদ বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে থাকে। কোরবানির ঈদ কেন্দ্র করে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণ দেয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রদান করে ৮০-১০০ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে এ পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা বেশ খারাপই বলা যায়। কারণ আমাদের চামড়াজাত পণ্য রফতানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেলেও ঋণটা যাচ্ছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। অবশ্য এখন সময় এসেছে ওই ঋণের কিছু গবাদিপশু যারা পালন করছেন, তাদের দেয়া যায় কিনা চিন্তা করার। আমরা প্রায়ই দেখি, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ট্যানারি মালিকের দিক থেকে চামড়া কম দামে কেনা হয়। যদিও আমরা জানি, এ চামড়া বিক্রির টাকার প্রায় সবটাই যায় শহর ও গ্রামের এতিমখানা, মাদ্রাসা, স্কুল এবং অন্যান্য অনাথ ফান্ড তথা গরিবদের কাজে। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. চামড়ার দাম বৃদ্ধি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। দুই. চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পে যে কিছু ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে, তাদের ঋণটা ফেরত আসছে না। অগ্রণী, সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, চামড়া খাতে সম্প্রসারিত ঋণের প্রায়ই ৩০-৩৫ শতাংশ শ্রেণীবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটি ভালো দিক নয়। আরেকটি বিষয়, আমরা এখনো চামড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাটি উন্নত করতে পারিনি। এ কারণে রফতানিকারক, উত্পাদক ও সংগ্রাহকরাও চামড়ার সঠিক মূল্য পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। কোরবানির ঈদের সময় আরেকটি বিষয় ইদানীং বেশি দেখা যাচ্ছে সেটি হচ্ছে, জাকাত বা দান-খয়রাত। এ ঈদ কেন্দ্র করে কত লোক জাকাত দেয়, জাকাত প্রদানে কত লোকের সক্ষমতা আছে, এটা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুমান রয়েছে। এ অনুমানগুলোর কারণ হচ্ছে, প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জাকাত দেয়ার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। আগে যেমন জাকাত দেয়া হতো অনেকটা সদকায়ে জারিয়ার মতো। এখন যারা জাকাত দিচ্ছে, তারা খেয়াল করছে এর অর্থটা যথাযথভাবে কাজে লাগছে কিনা। এজন্য ইদানীং মাংস ও শাড়ি বিতরণ কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিংবা অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে, যারা কিছুটা নিজেদের গরিব আত্মীয়স্বজন বা গ্রামবাসীকে সহায়তা করতে চান। জাকাত বা ঈদ উপলক্ষে সহায়তা বা মাংস বিতরণের সঙ্গে রাজনৈতিক সাফল্য, মন্ত্রী-এমপি হওয়ার মতো বিষয়গুলোও সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে।
আগেই বলেছি, জাকাতে সনাতনী ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেকেই স্কুলে, এতিমখানায়, মাদ্রাসায় টাকা দেয়া, কম্পিউটার কিনে দেয়া, বই কিনে দেয়া, লাইব্রেরি করে দেয়া এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে জাকাতের অর্থ প্রদানের ব্যাপারে চিন্তা করছেন। এমনকি কাউকে দুগ্ধবতী গাভী কিনে দিচ্ছেন, যাতে স্থায়ীভাবে তার দারিদ্র্য কমে যায়, প্রতিনিয়ত কিছুটা দুধ তার পরিবারের জন্য নিতে পারেন, কিছুটা দুধ বাজারে বিক্রি করে দিতে পারেন। এর মাধ্যমে আমরা গ্রামাঞ্চলে কিছুটা হলেও পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, জাকাতের আকার কত বড়? আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আমাদের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার আয়করের মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশ হচ্ছে জাকাত, যেটি কিনা ব্যক্তি প্রদত্ত আয়করের প্রায় সমান। রোজা কিংবা কোরবানি ঈদ কেন্দ্র করে আলোচ্য পরিমাণ জাকাত ব্যয়িত হয় গরিব মানুষের জন্য। তবে এটি সত্যিকারের গরিব মানুষের কাছে যাচ্ছে কিনা, সেটা নিয়ে বাদানুবাদ থাকতে পারে। অবশ্য ব্যক্তিগত আয়করের সঙ্গে জাকাতের মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বেশ জটিল। নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান একাধিক ব্যক্তি সরকারকে কর দেয়ার কথা উঠালে মুখ ভার করে বসে থাকেন। কাউকে কাউকে কর ফাঁকি দেয়ার ফন্দিফিকির আঁটতেও শুনেছি। কিন্তু তাদের কোনো দিন দেখা যায়নি জাকাত প্রদানের ব্যাপারে আপস করেছেন কিংবা পিছিয়ে থাকছেন।
আমরা সবাই জানি, ধনীর সম্পদের যে অংশ ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায় সমাজে বণ্টন করতে হয়, সেটাই জাকাত। এটা সাধারণত গরিব আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীর মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। তবে জাকাত প্রদানের মূল উদ্দেশ্য এবং আমাদের দেশে জাকাত প্রদানের পদ্ধতির মধ্যে কতটুকু সঙ্গতি রক্ষিত হচ্ছে, সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে। যতটা আমরা বুঝতে পারছি— জাকাত এমনভাবে দেয়া উচিত, যেন উপার্জন সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে অভীষ্ট ব্যক্তিদের দারিদ্র্যের দুর্দশা থেকে মুক্ত করা যায়। আমাদের দেশে গণহারে প্রদত্ত শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল, এমনকি ইদানীং কিছু ক্ষেত্রে মশারি প্রত্যক্ষভাবে গরিব মানুষের আয়ের জোগান দিচ্ছে বলে মনে হয় না। এর মাধ্যমে কমছে না দারিদ্র্য, সমর্থিত হচ্ছে না গরিব মানুষের উঠে দাঁড়ানোর গল্প। সেজন্য জাকাত বণ্টনের কার্যকর কাঠামোগত পদ্ধতি থাকতে হয়। সেটিও নেই আমাদের বাংলাদেশে। এর স্থানীয় কিছু রীতি দাঁড়িয়ে গেছে দেশে যে, রোজার মোটামুটি ১০-১৫ দিনের মধ্যেই সব ব্যক্তি জাকাতের কাপড়-চোপড় হয় নিজে কেনেন অথবা কাউকে দিয়ে ক্রয় করান। আবার কোরবানির সময় দেখা যাচ্ছে, জাকাত বাবদ যতটা না শাড়ি দেয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দেয়া হচ্ছে অন্যান্য সাহায্য। রোজার ঈদের উত্সব যেমন আমাদের সমাজজীবনে ব্যাপকভাবে গেড়ে বসেছে, তেমনি কোরবানির ঈদের ক্ষেত্রেও একটি নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ড দাঁড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে আমাদের অন্যতম নবী হজরত ইব্রাহীম (আ.) প্রদর্শিত প্রিয়জনকে ত্যাগ করে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশনা পালনের অঙ্গীকারটা কতটুকু পালিত হচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। এর দুটি কারণ আমি মনে করছি। এক. আমাদের আনুষ্ঠানিকতা বেড়ে যাচ্ছে। যত আনুষ্ঠানিকতা বাড়ছে, তত সত্যিকার ধর্ম পালনের রীতিনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ অনেকটা লোক দেখানোর জন্য অনেক টাকা খরচ করছে। এটি শুধু যে বাংলাদেশে ঘটছে তা নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও উত্সবকেন্দ্রিক সামাজিকতা বাড়ছে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, এটা কীভাবে ভালোভাবে পালন করা যায়। সেক্ষেত্রে আমরা সত্যিকারের ধর্মচর্চাকে আরেকটু বাড়াতে পারি। ধর্মীয় অনুশাসনগুলো আরেকটু মেনে চলার চেষ্টা করতে পারি। ভুল লোকের কাছে টাকা চলে যাওয়া কিংবা ভুল লোককে টাকার জোরে রাজনীতিতে টেনে আনায় প্রবণতা কমানো যায়, তবেই উত্সব-পার্বণের আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত. লক্ষণীয়, ঈদ বোনাসের মতো নতুন বেতন কাঠামোয় সরকারি কর্মচারীদের ২০ শতাংশ নববর্ষ ভাতা দেয়া হবে, কারণ পহেলা বৈশাখ বিরাট সামাজিক উত্সবে রূপান্তর হয়েছে। এটা ঘোষণা করা হয়েছে যতটা না আলোচ্য উত্সবের সামাজিকতার জন্য; তার চেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রণোদনা সৃষ্টিতে সরকারের একটা চেষ্টা আছে। এক্ষেত্রে আমরা চামড়া শিল্পকে যেমনটা উত্সাহিত ও কোরবানির পথ আরো প্রশস্ত করব, তেমনি সস্তায় গরু সরবরাহ যাতে বাড়ানো যায়, এমনকি স্থানীয়ভাবে গরু উত্পাদন পদ্ধতিকে কীভাবে আরো উত্সাহিত করা যায়, সেটাও ভাবতে হবে। গড়ে তুলতে হবে কামার, চাটাই, ছুরি কিংবা চাপাতি এবং মসলা শিল্পকেও। সেক্ষেত্রে কীভাবে স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ, কৃষিঋণ আরো ভালোভাবে বিতরণ করে গবাদিপশু পালনের পথ সুগম করা যায়, সেটিও চিন্তা করতে হবে। স্থানীয় গবাদিপশু সরবরাহ, চামড়ার সঠিক মূল্য প্রদান, চামড়া শিল্পে প্রদানকৃত ঋণের পরিমাণ বাড়ানো এবং কোরবানির ক্ষেত্রে অপচয় কমাতে হবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যত কম আনুষ্ঠানিকতা আনা যায়, যত লোক দেখানো ব্যাপারটি কমানো যায়, তত ভালো এবং সে ব্যাপারেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বণিক বার্তা ।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান