অলৌকিক – রেজাউল করিম খোকন
রাঙ্গামাটি শহরের বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি থেকে নামতেই সোহানা খানিকটা নার্ভাস হয়ে যায়। ঢাকা থেকে এসেছে সে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত দারুণ স্মার্ট মেয়ে সোহানা ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের ওপর ডিপ্লোমা নিয়েছে দু’বছর আগে। ঢাকা শহরের বড় হয়েছে সে। এখন চাকরি করছে একটা বড় আর্কিটেস্ট ফার্মে। চাকরিসূত্রে ঢাকা থেকে রাঙ্গামটিতে আসা। মাস ছয়েক থাকতে হবে। কারণ এখানে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির নতুন হোটেলের ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের প্ল্যান ডিজাইন এবং সে অনুযায়ী পুরো কাজের তত্ত্বাবধান করতে হবে সোহানা শারমিনকে।
বয়স তার পঁচিশ- ছাব্বিশ হবে। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও এক ধরনের স্নিগ্ধ লাবণ্যময় ভাব জড়িয়ে আছে তার অবয়বে যা যে কাউকে মুগ্ধ করে। রাঙ্গামাটি শহরে সোহানার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। চেনাজানা বন্ধুবান্ধবও নেই। এই ছয় মাস কারো বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার প্ল্যান নিয়েই এসেছে সে। প্ল্যান অনুযায়ী পত্রিকায় দেয়া বিজ্ঞাপন দেখে কয়েকটি পরিবারের সাথে আগেই টেলিফোনে যোগাযোগ করে একটির সাথে পাকা কথা বলে রেখেছে। খ্রিস্টান এই পরিবারটির সাথেই পেয়িং গেস্ট হিসেবে রাঙ্গামাটি থাকবে- এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে সোহানা। বাসস্ট্যাণ্ড থেকে স্কুটার নিয়ে কিছুদূর যেতেই পৌঁছে যায় সে একটি ছিমছাম গোছানো সুন্দর বাড়ির সামনে। এলাকাটা বেশ নীরব সুনসান। রাস্তাঘাটে লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। পার্স থেকে কাগজের টুকরোটা বের করে বাড়ির নম্বর এবং নাম নেমপ্লেট-এর সাথে মিলিয়ে নেয় সে। জনসন রোজারিও, মনিকা কটেজ, ১১/৩ হিল টাউন রোড, রাঙ্গামাটি। হ্যাঁ, এ বাড়ির লোকজনের সাথেই তার টেলিফোনে কথা হয়েছে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার ব্যাপারে। গেটের কাছে কলিং- বেলের বোতাম টিপতেই ভেতর থেকে বয়স্ক এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে গেট খুলে দেন।
‘আমার নাম সোহানা শারমিন, ঢাকা থেকে এসেছি’- কথাটা বলতেই ভদ্রলোক তার দিকে কয়েকমুহূর্ত গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অস্বস্তিতে পড়ে সোহানা, এক সময় ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দেন ‘আমি জনসন, এই বাড়িটা আমার, বুঝেছি তুমি সোহানা। তোমার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছিলো আমার, এসো ভেতরে এসো’।
জনসনের পিছু পিছু সোহানা তার ব্যাগ- ব্যাগেজসহ বাড়ির ভেতরে ঢোকে। বাড়ির ঢুকতে গিয়ে তার কাছে অদ্ভুত নিস্তব্ধ মনে হয় পুরো জায়গাটি। হঠাৎ একটি নারী কণ্ঠের আর্তনাদ কানে আসে। ব্যাপারটা তার কাঝে রহস্যময় মনে হয়। এ নিয়ে বেশি চিন্তা করার সময় পায় না সোহানা। জনসনের স্ত্রী অর্থাৎ বাড়ির কর্ত্রী মনিকা ড্রইংরুমে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাঝবয়সী এই মহিলার সাথেও টেলিফোনে সোহানার আগে কথা হয়েছে। বুড়োবুড়ি একা বাড়িতে থাকেন, নিঃসঙ্গতা কাটাতে তাঁরা মাঝেমধ্যে পেয়িং গেস্ট রাখেন। এই মুহূর্তে মাহিলাকে দেখে বেশ চিন্তিত এবং অস্থির মনে হলো। সোহানার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হলেও এ নিয়ে কোন কথা বলল না। সামান্য কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর জনসন-মনিকা দম্পতি সোহানাকে তার জন্য নির্ধারিত ঘরটি দেখিয়ে দেন। মনিকা কটেজে রুম অনেকগুলো। অথচ লোকজন নেই। একপাশে একটি রুমের বন্ধ দরজা দেখতে পেল সোহানা, মনিকা এই রুমের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘সোহানা তোমাকে একটা অনুরোধ করব, তুমি কিন্তু কোনো সময়ও ঘরে ঢোকার চেষ্টা করো না, আশা করি কথাটা মনে রাখবে’।
কথাটা শুনতে ভালো লাগল না সোহানার। ‘জ্বি ঠিক আছে’ ঘাড় কাত করে বলল শুধু, পাল্টা কিছু জানতে চাইলো না কৌতূহলী হয়ে।
রাতে খেয়েদেয়ে মাত্র নিজের রুমে এসে শুয়েছে সোহানা। এমন সময় দূরে গির্জায় ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়। রাত বারোটা বেজেছে। হঠাৎ কাছেই কোথাও নারীকণ্ঠের আর্তনাদ শোনা যায়। ততক্ষণে তন্দ্রাভাবটা কেটে গেছে তার। বিছানায় উঠে বসে সে। আর্তনাদটা এই বাড়ির মধ্যে কোনো ঘর থেকে আসছে। কিন্তু কোন ঘর থেকে? আতংকে ভয়ে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে সোহানার।
আর্তনাদের উৎস জানতে কৌতূহলী হয়ে ওঠে সোহানা। কিন্তু আজ সে এই বাড়িতে নতুন এসেছে। এছাড়া সে একটা মেয়ে। এত রাতে নিজের রুম থেকে বাইরে বেরোনোটা কি ঠিক হবে? ভাবতে থাকে সে। আবার অর্তনাদটা শোনা যায়। খুব কাছেই একটা মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ভয়ে তার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায় আবার। ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে যায়। ভূতপ্রেতের আছর আছে নাকি এই বাড়িতে-ভাবতে থাকে সোহানা। হঠাৎ করে কাছেই কোনো ঘরের দরজায় করাঘাত শুনতে পায় সে। তার ভয় আরো বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর গ্লাস প্লেট ছোঁড়ার শব্দ শোনে। ঘটনাটা কি ঘটছে, জানতে সে কৌতূহলী হয়ে দরজার কী হোলে চোখ রাখে।
অন্ধকার বাড়িতে একটি ঘরে আলো জ্বলছে। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে পা টিপে টিপে এগোতে থাকে সে। উত্তেজনায়- ভয়ে তার সারা শরীর কেমন ছমছম করছে। ঘামছেও সে। কিন্তু কোনোভাবেই কৌতুহল দমন করতে পারছেন কিছুদূর যেতেই সোহানা দেখে, ঐ রহস্যময় নির্দিষ্ট ঘরেই আলো জ্বলছে। এখানে আসার পর এই ঘরের আশেপাশে না যাবার জন্য বলা হয়েছে তাকে। ঘরে আলো জ্বলছে, দরজাটা খোলা দেখেই সোহানা নিজের কৌতূহল দমন করতে পারে না। সাহস করে ঐ ঘরে ঢুকে পড়ে। ঢুকতে গিয়েই প্রথমে নিশ্চিত একটা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় সে। একটা কাঁচের গ্লাস ঠিক মাথা বরাবর ছুটে আসছে দেখে চট করে সরে যায় অন্যপাশে। সময় মতো মাথাটা সরাতে না পারলে ছুঁড়ে মারা গ্লাসের আঘাতে ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারতো, এটা নিশ্চিত।
মনিকা রোজারিও ঘরের মধ্যে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর অন্য পাশে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে সোহানার বয়সী এক যুবতী। মাথার চুল এলোমেলো, গায়ের কাপড়-চোপড়ও অবিন্যস্ত। অস্থির একটা ভাব তার মধ্যে। সে ই যে গ্লাসটা ছুড়ে মেরেছিলো, বুঝতে অসুবিধা হয় না সোহানার সারা ঘরে গ্লাসসহ আরো অন্যান্য জিনিসপত্র ছড়ানো। সোহানা ততোক্ষণে বুঝে নিয়েছে পরিস্থিতিটা। মানসিক ভারসাম্যহীন এই যুবতীই এসব করেছে। তাহলে তারই আর্তনাদ শুনেছিল সে খানিকক্ষণ আগে। কিন্তু এই বাড়ির রহস্যময় ঘরে এই যুবতী মেয়েটি কে? অনেক চিন্তা ঘুরপাক খায় সোহানার মাথায়। মেয়েটিও তাকে দেখে চমকে গেছে। তাকে আগে কখনো দেখেনি সে। সোহানাকে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে মেয়েটি। তারপর মনিকার দিকে তাকিয়ে অ™ভুত শান্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘ ওকে তো দেখিনি আগে, কে ও মাম্মি, বল না কে ও?’
মেয়েটির কথা শুনে সোহানা অনুমান করে, জনসন-মনিকা দম্পতির মেয়ে সে। অথচ তারা বলেছেন কোন সন্তান নেই তাদের, একাকী স্বামী-স্ত্রীই কেবল থাকেন বাড়িতে।
‘ওর নাম সোহানা, ঢাকা থেকে এসেছে, আমাদের এখানে থাকবে কিছুদিন’ মনিকার কথা শেষ হয় না, তার আগেই মেয়েটা এগিয়ে আসে সোহানার সামনে। শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে-‘আমি লিজা। এই বাড়ির মেয়ে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রোজারিও আমার বাবা- মা। জানো, ওরা আমাকে এ ঘরে আটকে রেখেছে। বাইরে কোথাও যেতে দেয় না। আমার আকাশ বারবার এসে ফিরে যাচ্ছে। ওর সাথে বাইরে যেতে পারি না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তুমি আমাকে এই বাড়ির বাইরে নিয়ে চল না প্লিজ। আকাশের সাথে আমার দেখা করা প্রয়োজন, অনেক জরুরি কথা আছে। বল তুমি আমাকে নিয়ে যাবে ওর কাছে ..।’
মেয়ের কথাগুলো মনিকাকে বিব্রত করছে বুঝতে পারল সোহানা। এছাড়া হঠাৎ এ ঘরে ঢুকে পড়ায় বেশ বিরক্তও হয়েছেন তিনি, চেহারা দেখেই বোঝা যায়।
‘ঠিক আছে তোমার সাথে কথা পরে হবে, তুমি এখন মায়ের কথা মতো খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, লক্ষ্মী মেয়ে লিজার কথা কাল শুনব’ কথাগুলো বলতেই লিজার মধ্যে এক ধরনের স্বস্তিভাব ফিরে আসে।
লিজার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ে সোহানা। শুয়ে শুয়ে মেয়েটার কথা ভাবতে থাকে। কোন রহস্য লুকিয়ে আছে মেয়েটার মধ্যে জানতে হবে।
পরদিন সকালে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যায় সে। দুপুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিতে থাকে। তখন মনিকা সোহানার ঘরে ঢুকে অনেকটা লজ্জিত হয়ে বলেন, ‘মেয়েটি পাগল হয়ে গেছে। তাই ওর কথা বলিনি তোমার কাছে, ওকে নিয়ে মহা যন্ত্রণার মধ্যে আছি। তুমি কিন্তু ওর কোনো কথা বিশ্বাস করো না। আবোল তাবোল কত কথাই বলবে সে তোমার কছে, যার কোনো ভিত্তি নেই’।
সন্ধ্যার পর আবার অফিসের কাজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির সামনে আসতেই অন্ধকারে মোটর বাইক নিয়ে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোহানা। হেলমেট পরিহিত চালককে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। লোকটি লিজাদের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছিলো আর ঘড়ি দেখছিলো। ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হলেও সোহানা কিছু না বলে ওর কাজে চলে যায়। কয়েক ঘন্টা পর ফিরে আসে। স্কুটার থেকে বাড়ির গেটের সামনে নামতে গিয়ে আবার দেখে সেই রহস্যময় মোটর বাইকসহ চালককে। হেলমেট পরা লোকটা গাছের নিচে অন্ধকারে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। এবারও সোহানা কোনো কথা না বলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। অযথা অচেনা- অজানা কোনো মানুষের সাথে কথা বললে যদি ঝামেলা হয়- এরকম চিন্তা করে কিছু বলে না সে লোকটিকে। তবে লোকটি মোটর বাইক নিয়ে কার জন্য অপেক্ষা করছে? তার মনে প্রশ্ন জাগে।
এভাবে প্রায় পঁচিশ দিন পেরিয়ে যায়। লিজার সাথে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে সোহানার। সে তার প্রেমিক আকাশের কথা বলেছে তাকে। আকাশের সাথে দেখা হয় না অনেকদিন। বেচারা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে তার জন্য। কতদিন এক সাথে বেড়াতে যাওয়া হয় না- ইত্যাদি। সোহানা বুঝে নিয়েছে, প্রেমিক আকাশের সাথে লিজা দেখা করুক এটা তার বাবা-মা কেউই পছন্দ করেন না। ফলে তার মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে।
বিকাল থেকেই আজ বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যার পর বৃষ্টি কমে আসতেই সোহানা অফিসের কাজে ঘর থেকে বেরোয়। জরুরি কাজ থাকলে রাতেও তাকে মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হয়। গেট পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতেই সোহানা মোটরবাইকসহ হেলমেট পরা রহস্যময় চালককে দেখতে পায়। মাঝখানে বেশ কয়েকদিন দেখা যায়নি লোকটিকে। আজ লোকটি নিজেই এগিয়ে এসে তার সাথে যেচে আলাপ করে, ‘মিস সোহানা শারমিন, আজ আপনি কোনো গাড়ি পাবেন না অফিসে যাবার জন্য। কারণ আজ রাঙ্গামাটিতে হরতাল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে একটা লিফট দিতে পারি’।
লোকটার প্রস্তাব শুনে চমকে ওঠে সোহানা। অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, লোকটির সাহস তো কম না। কোনো বদমতলব আছে লোকটির। মোটর বাইকে তুলে যদি জোর করে কোনো নীরব নির্জন জায়গায় নিয়ে…। কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় সোহানা লোকটির দিকে। কিছু বলে না। হাঁটতে থাকে। আজ এখানে হরতাল অথচ অফিসে যাওয়াটাও জরুরি। কিন্তু এখান থেকে এতোটা পথ একাকী হেঁটে যাবে কীভাবে? ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর পাশেই সেই রহস্যময় মোটর বাইক চালককে আবার দেখতে পায়। মিস সোহানা, আমাকে খারাপ মানুষ ভাববেন না প্লিজ, আপনার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই। আমার কথা বিশ্বাস করুন, মোটরবাইকে উঠে বসুন, আপনাকে অফিসের সামনে নামিয়ে দেব। ভয় পাবেন না’। মোটরবাইকচালক বিনয়ী ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে।
সোহানা হঠাৎ কি মনে করে মোটরবাইকের পেছনে উঠে বসে। লোকটি নিজের পরিচয় দেয় ‘আমর নাম আকাশ রড্রিক্স। এই শহরের ছেলে, আমাকে প্রায়ই লিজাদের বাড়ির সামনে দেখেন আপনি। আপনার অনেক কৌতূহলও জেগেছে নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে। আমি লিজাকে ভালোবাসি। ও নিশ্চয়ই বলেছে আমার কথা। মেয়েটার জন্য দুঃখ হয়, ওকে আমি সাথে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে চাইছি। অথচ ওর বাবা- মা বাধার প্রাচীর হয়ে আছে আমাদের দু’জনের মধ্যে’।
এরই মধ্যে সোহানার অফিসের সামনে এসে থেমে যায় মোটরবাইক। আকাশ চেনে তার অফিস। থামার জন্য বলে দিতে হয় না তাকে। ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হলেও, তেমন পাত্তা দেয় না। ‘থ্যাঙ্কস এ লট’ বলে নম্রতা তার অফিসের দিকে পা বাড়ায়। তিন ঘণ্টা পর রাত সাড়ে দশটায় অফিস থেকে বেরিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় সোহানা। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কোনো গাড়ি নেই। কীভাবে বাসায় ফিরবে সে? তখনই হঠাৎ ভোজবাজির মতো মাটি ফুঁড়ে যেন আবির্ভূত হয় সেই রহস্যময় মোটরবাইক চালক আকাশ রড্রিক্স। ওকে দেখে আশ্বস্ত হয় সোহানা। যাক বাঁচা গেল। এ যাত্রায় বাড়ি পৌঁছানো যাবে তাহলে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন সে। বাড়ির গেটে সোহানাকে নামিয়ে আকাশ আবার চলে যেতে উদ্যত হতেই সোহানা তাকে ভেতরে যেতে অনুরোধ জানায়, ‘মিষ্টার আকাশ, আমার সাথে চলুন, লিজার সাথে দেখা করিয়ে দেব আপনাকে। ওতো আপনার সথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে’।
‘না থাক, আজ নয় আরেকদিন যাব, আমি ওকে নিয়ে এই শহরে, এই লোকালয়ে থাকতে চাই না, অনেক অনেক দূরে চলে গেতে চাই’ বলেই মোটরবাইক নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সে।
সোহানা বাড়িতে ঢুকতেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে আজ এখানে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রোজারিওকে দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্তভাবে ড্রইংরুমে সোফায় বসে থাকতে দেখে সে। নিজে আগ বড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করে না কোনো বিষয়ে। চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। তার আগে লিজার রুমে গিয়ে একবার দেখা করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আর এগোয় না সে।
সকালে অফিসে যাবার আগে মনিকার মুখোমুখি হয়ে যায় সোহানা। মনিকা বিষণœ কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘শোনো, সোহানা, তুমি আমার মেয়ের মতো, তুমি হয়তো অনেক কথাই জানো না, তোমাকে জানানো দরকার সব কথা। কাল রাতে লিজা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো। ফ্যানের সাথে ফাঁসি ঝুলিয়ে মরতে চেয়েছিলো, আমরা একটু অসতর্ক ছিলাম বলেই মেয়েটা সেই সুযোগে ভয়ানক কাণ্ডটা করতে বসেছিলো। ভাগ্য ভালো ওকে ঠিক সময়ে দেখে ফেলেছিলাম। তা না হলে কী যে হতো’ – বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি। সোহানা বেশ বিব্রতবোধ করে মনিকার কান্না দেখে।
‘আচ্ছা আন্টি, লিজার সাথে ওর বয়ফ্রেন্ড আকাশের বিয়েটা দিচ্ছেন না কেন? তাহলেই তো মেয়েটা এমন পাগলামি করবে না, স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আকাশকে আপনারা পছন্দ করছেন না কেন। সমস্যাটা কোথায় বলুন তো। মেয়ের বিয়ে দিতে অনেক সময় অনেক সেক্রিফাইস করতে হয়। যদি আকাশের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকেও সেটা মেনে নিয়েই আপনার মেয়ে তাকে মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছে। ওরটা ওই বুঝবে’ – একটানা কথাগুলো বলে থামে সোহানা।
মনিকা উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। তাঁর দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। যন্ত্রণায় তাঁর বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে দেখেই বোঝা যায়।
‘আন্টি, বললেন নাতো আকাশের সাথে লিজার বিয়ে দিতে আপনাদের আপত্তিটা কোথায়? সোহানা মনিকার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলে।
‘শুরুতে আপত্তি থাকলেও আমরা আকাশের সাথে লিজার অ্যাফেয়ারটা মেনে নিই। পরে তার সাথে কথা বলে ভালো লাগে আমাদের। ওর সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে আমাদের তো কোনো আপত্তি ছিলো না’Ñ আর বলতে পারেন না. ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন মনিকা।
সোহানা বুঝতে পারে না তার কান্নার কারণ।
‘তাহলে বাধাটা কোথায় বলুন আন্টি? প্রশ্ন করে সোহানা।
‘আকাশ যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তো সমস্যা ছিলো না, সবকিছুই মিটে যেতো, আমার মেয়েটার জীবনে এত বড় বিপর্যয় ঘটবে ভাবতে পারিনি’ বলেই আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকেন মনিকা।
‘আকাশ যদি বেঁচে থাকতো মানে কি বলছেন আন্টি! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, অবাক হয়ে জানতে চায় সোহানা।
আকাশ মারা গেছে মোটরবাইক অ্যাকসিডেন্টে। তা এক বছর হতে চলল প্রায়। লিজার সাথে তার বিয়ের সব পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিলো। ছেলেটা চিটাগাং গিয়েছিলো কিছু কেনাকাটা করতে। মোটরবাইক নিয়ে একাকী ফিরছিলো। ঝড়বৃষ্টির রাতে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে লরির সাথে ধাক্কা লেগে পাহাড় থেকে অনেক নিচে ছিটকে পড়েছিলো মোটরবাইকসহ। তিনদিন পর মোটরবাইকসহ ওর মৃতদেহটা উদ্ধার করা হয়েছিলো। আমরা খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম দেখতে। লিজা আকাশের মৃত্যুটা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারেনি আকাশ মারা গেছে। সে নাকি প্রায়ই আকাশের মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পায়। ববি তাকে ডাকে, দূরে বহুদূরে তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়। আরো কতো কি বলে লিজা। কথাগুলো বলে থামেন মনিকা।
কথাগুলো শুনতে শুনতে সোহানার শরীর শিঁউরে ওঠে। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কী বলছেন মনিকা? আকাশ মারা গেছে একবছর আগে অথচ গত রাতে তার মোটরবাইকে চড়ে সে অফিসে গিছে এবং ফিরে এসেছেও। গত বেশ কিছুদিন ধরে রাতে এই বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে তাকে। হেলমেট পরা আকাশকে রাতে এই বাড়ির আশেপাশে দেখছে সে প্রায়ই। এটা কী করে সম্ভব? ব্যাপারটা দারুণ অবিশ্বাস্য মনে হয় সোহানার কছে। ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে নিচের দিকে। সারা শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। তার ঠোঁট কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। দৌড়ে সে নিজের রুমে চলে যায়। এতোক্ষন ধরে সে যা শুনেছে তা নিতান্তই অবিশ্বাস্য অলৌকিক গল্প বলে মনে হয় তার কাছে।
দুুপুরে লিজার খাবার নিয়ে ওর মা যখন ঐ ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন সোহানা তার হাত থেকে খাবারগুলো নিয়ে বলে, ‘আন্টি, আজ আমিই যাই ওর খাবার নিয়ে, গল্প করতে করতে খাওয়াবো। আপনি এই ফাঁকে ঘরের অন্য কাজকর্ম সেরে ফেলুন।
সোহানা লিজার ঘরে ঢুকে অবাক হয়। যে মেয়েটি গত রাতে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো তাকে এখন বেশ সহজ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সোহানাকে দেখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে লিজা বলতে থাকে, ‘ এই যে সোহানা, দেখ কাল রাতে আকাশ এসেছিলো আমার কাছে, আমাদের বিয়ের জন্য কেনা নেকলেসটা দিয়ে গেছে, দেখ না কত সুন্দর এটা, ওর রুচির প্রশংসা না করে পারা যায় না।’
লিজার কথাগুলো শুনে আবার ভয়ে শিঁউরে ওঠে সোহানা। আকাশ মারা গেছে একবছর আগে। অথচ কাল রাতে এই ঘরে সে তার প্রেমিকা লিজার জন্য নেকলেস নিয়ে এসেছিলো! এ ধরনের অবিশ্বাস্য ঘটনা এই পৃথিবীতে ঘটতে পারে তা তার জানা ছিলো না। প্রেতাত্মা, ভূত, অশরীরী আত্মা এসবের কোনো বিশ্বাস নেই সোহানার। তাহলে কি আকাশের প্রেতাত্মা এই বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়? মোটরবাইক নিয়ে হেলমেট পরা রহস্যময় মানুষটিকে প্রায়ই দেখছে সে এ বাড়ির সামনের রাস্তায় অন্ধকারে গাছের নিচে। ওটাই আকাশের প্রেতাত্মা বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু প্রেতাত্মারা তো অশরীরী হয়ে থাকে,বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে পড়েছে। অথচ আকাশের সাথে মোটরবাইকে চড়ে গত রাতে অফিসে যাওয়া-আসা করেছে সে। কথাও বলেছে, – ব্যাপারটা মনে হতেই সোহানার সারা শরীরের রক্ত জমে যেতে চায় ভয়ে আতংকে।
দু‘ তিনদিন পর জরুরি প্রয়োজনে রোজারিও দম্পতির একদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়। বাড়িতে সোহানার কাছে লিজাকে রেখে যান তারা। রাতের মধ্যে ফেরার কথা থাকলেও দুর্যোগময় আবহাওয়ার কারণে তারা ফিরতে পারেন না সেদিন।
রাত বাড়তে থাকলে সোহানার মনের মধ্যে চাপা ভয়টাও ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। লিজাকে ঠিকমত দেখে রাখতে হবে। প্রয়োজনে রাতে ঘুমানো যাবে না। সে রকম প্রস্তুতি নিয়ে লিজার ঘরে একটা চেয়ারে বসে সোহানা। লিজার সাথে গল্প করে সে অনেকক্ষণ ধরে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে লিজা। সোহানা একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে থাকে। হঠাৎ কাছেই একটা মোটরবাইকের শব্দ শোনা যায়। কান পাতে সোহানা ভালো করে। নাহ্ আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। এটা তার মনেরই ভুল-অনুমান করে ভয়ে জানালা খুলে বাইরে তাকায় না। অল্পক্ষণ পরে আবার শব্দটি শোনা যায়। তাহলে কী আকাশের প্রেতাত্মা আবার এসেছে বাড়ির সামনে? আতঙ্ক অস্বস্তিতে ঘামতে থাকে সোহানার সারা শরীর। কী করবে সে ভেবে পায় না। কাছের পুালশ স্টেশনে টেলিফোন করা যায়। কিন্তু কী বলবে তাদের কাছে। প্রেতাত্মা ও ভূতের কথা বললে পুলিশ তাকে পাগল মনে করতে পারে। হ্যাঁ, ডাকাতের কথা বলা যায়। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাতেই হতাশ হয় সোহানা। ডেড হয়ে আছে ফোনটা। তাহলে কী করা যায়। আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। চিৎকার করে কাউকে ডেকে আনাটাও সম্ভব নয়। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে এক সময় ক্লান্তি আর অবসন্নতায় ঢলে পড়ে ঘুমে। এভাবে কতক্ষণ সময় কেটে যায় সোহানা জানে না। হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙলে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখে ওখানে লিজা নেই। রুমের দরজা খোলা, ভয়ে আতংকে শিঁউরে উঠে সোহানা। তাহলে একটা অঘটন ঘটে গেছে। অজানা আশংকায় দুলে ওঠে মনটা। ছুটে দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় সোহানা।
সেই হেলমেট পরা রহস্যময় মোটর বাইক চালক, যার সাথে কয়েকদিন আগে এক রাতে অফিসে গিয়েছিলো এবং ফিরেছিলো, এই সেই আকাশ রড্রিক্স। গত এক বছর আগে অ্যাকসিডেন্টে যার মৃত্যু হয়েছে। মনিকা কটেজের সামনের রাস্তায় মোটরবাইক স্টার্ট দেয়া আছে। চালকের আসনে আকাশ বসে আছে, পিছনে লিজা তাকে দু’ হাতে জড়িয়ে ধরে। কয়েকবার মোটরবাইকটা চক্কর দেয় বাড়ির সামনের রাস্তায় দৃশ্যটা দেখে। সোহানা চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বিস্ময়ভরা চোখে নীরব পাথরের মুর্তির মত সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো দেখতে থাকে। অবিশ্বাস্য দৃশ্যগুলো একের পর এক ঘটতে থাকে চোখের সামনে অথচ তার কিছুই করার নেই। এক সময় মোটর বাইকটা সামনের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। অনেকক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সোহানা। সম্বিত ফিরে পেতেই চিৎকার করে জ্ঞান হারায় সে।
জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করে সোহানা। আশেপাশে পুলিশের লোকজন রয়েছে দেখতে পায়। মনিকা রোজারিও একপাশে আর্তনাদ করে কান্নাকাটি করছেন। কী হয়েছে লিজার, খবর কী তার, জানতে চায় সোহানা।
একজন অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলেন, ‘লিজা নিখোঁজ হয়েছে সেই রাত থেকে। পুলিশ তাকে খুঁজছে কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। সোহানার মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা। আকাশের মোটর বাইকের পেছনে চড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার দৃশ্যটা মনে পড়তেই আবার শিঁউরে ওঠে। আকাশের প্রেতাত্মা তাহলে লিজাকে নিয়ে গেছে অজানা গন্তব্যে! লিজাকে শেষ পর্যন্ত জীবিত খুঁজে পাওয়া যাবে কিন কে জানে।
পরদিন সকালে পুলিশের লোকজন এসে সোহানার জবানবন্দি নেয়। সে সব খুলে বলে। তখন সে জানতে পারে, বিশ কিলোমিটার দূরে এক পাহাড়ি খাদে লিজার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে। ওখানেই ঠিক এক বছর আগে আকাশ রড্রিক্স মোটর বাইক অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিলো। এই ঘটনায় কথা অনেকের কাছে খুলে বলেছে সোহানা। বেশিরভাগ মানুষই তার কথাটা ফালতু, অবিশ্বাস্য, গাজাখুরি, বানোয়াট কল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সোহানা নিজে তা অবিশ্বাস করে কীভাবে। কারণ পুরো ঘটনা তো তার চোখের সামনেই ঘটেছে।