গাজীপুরে এক দশকে ৭৯% বনাঞ্চল ধ্বংস
সাইদ শাহীন ও মেহেদী আল আমিন |
ছয় দশক আগে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে গাজীপুরের শালবন। আর বনটি রক্ষার পাশাপাশি সেখানকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ১৯৮২ সালে ভাওয়াল অরণ্যকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু সংরক্ষণ তো হয়নি, উল্টো গত এক দশকে উজাড় করা হয়েছে এ বনের প্রায় ৭৯ শতাংশ।
গাজীপুরে বনবিভাগের জমির পরিমাণ ৬৬ হাজার ৮০০ একর। এক দশক আগেও জেলার মোট জমির প্রায় ১৪ শতাংশই ছিল বনাঞ্চল। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৩ শতাংশে। মোট বনাঞ্চলের প্রায় ৭৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ অর্থাত্ ৫২ হাজার একরেরও বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে। সম্প্রতি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন সায়েন্স ও চিবা ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। মূলত দুই ধরনের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে ‘এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড কভার চেঞ্জ ইন গাজীপুর, বাংলাদেশ, ইন রিলেশন টু লোকাল ইকোনমি স্টাডিড ইউজিং ল্যান্ডস্যাট ইমেজেস’ শীর্ষক ওই গবেষণা চালানো হয়।
বনাঞ্চল দখল বাড়িঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বনবিভাগের তদারকির অভাব, দুর্নীতি ও অদক্ষতা, গাছ কাটা এবং রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতাই এ বন ধ্বংসের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমিদারিস্বত্ব থেকে সরকারের হাতে আসার পর গত ৬০ বছরে বনের আয়তন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পেছনে বড় কারণ হলো— প্রভাবশালীদের দখল, অবাধে বৃক্ষনিধন, অবৈধ কল-কারখানা স্থাপন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং সামাজিক বনায়ন।
আবার দখলদারীদের প্রতিরোধে অদক্ষতাও দেখিয়েছে বনটি রক্ষার দায়িত্বে থাকা বনবিভাগ। শালবন দখল করে ক্ষমতাধররা কারখানা, বসতবাড়ি বানালেও বনবিভাগ তা প্রতিরোধ করতে পারছে না। বনটির অস্তিত্বও এখন হুমকির মুখে। গত এক দশকে অন্তত ছয় হাজার মামলা হয়েছে গাজীপুরের বন আদালতে। এর মধ্যে ৫০০ দেওয়ানি মামলা শুধু বনবিভাগের জমি দখল-সংক্রান্ত, অন্যগুলো বন দখলের। এ মামলায় দখলদারদের গ্রেফতারের নজির নেই বললেই চলে। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলতেই থাকে। কোনোটির রায় হলে তার সুবিধাও যায় দখলদারদের পক্ষে।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সাবেক কর্মসূচি সমন্বয়ক এবং বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক সোবহান বণিক বার্তাকে বলেন, যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে, তাতে গাজীপুর অঞ্চলকে বনভূমি হিসেবে রাখা দুষ্কর হবে। শহরের কাছের জমির দাম এত বেশি যে, এখন সবার নজর এ বনাঞ্চলের দিকে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারিভাবেও বন দখলের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। যারা দখল করছে, তাদের ঠেকানোর মতো দক্ষতা বা ক্ষমতা বনবিভাগের নেই। ফলে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনে বনটি সরকারের হাতে নেয়া হয়। তার পর এটি বনবিভাগকে বুঝিয়ে দিতে বলা হলেও স্থানীয় জেলা প্রশাসন আজো তা করেনি। বরং বিভিন্ন সময়ে বনভূমি ব্যক্তিমালিকানায় বন্দোবস্ত দিয়েছে আর ভূমি দফতরের মাধ্যমে বনের জমি দখলদারদের নামে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু উঁচু স্থানের জমিগুলোকে রক্ষা করা হয়। আর নিচু জমিগুলোকে বিভিন্ন সময়ে ইজারা ও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দখলের প্রবণতা শুরু হয়েছে তখন থেকেই। নিচু জমির এ ইজারাপ্রাপ্তরা ধীরে ধীরে বনাঞ্চল উজাড় শুরু করে। পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলের জমি দেশের মানুষের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠে। ফলে এক দশকের ব্যবধানে বনের পাঁচ ভাগের চার ভাগই উজাড় হয়ে গেছে। সেসঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বনের জীববৈচিত্র্যও। আগে গাজীপুরের শালবনে বনমোরগ, সজারু, খরগোশ, বেজি, বিভিন্ন প্রজাতির বানর ও বুনো শূকরসহ অন্যান্য প্রাণীর দেখা মিলত। বন উজাড় হওয়ায় এখন তা আর দেখা যায় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কাগজে-কলমে যে বন দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তার অর্ধেকেরও কম অবশিষ্ট আছে। শালবন বন ধ্বংস রোধে সরকারের কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই। সরকার চাইলে হারানো বনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে শালবন ধ্বংস করে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো বন্ধ করতে হবে। সামাজিক বনায়নের ক্ষমতা বনবিভাগের কাছ থেকে তুলে নিতে হবে।
দেশে সংরক্ষিত ৪০টি বনাঞ্চলের মধ্যে জাতীয় উদ্যান ১৭টি ও বন্যপ্রাণীদের অভয়াশ্রম ২০টি। এ-জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অন্যতম হলো শালবন। কিন্তু ভাওয়াল বনের মতোই অন্যান্য বনাঞ্চল অনেকাংশেই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভারসাম্যহীন।
অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংসে ১০টি ঝুঁকি বিরাজমান। এসবের মধ্যে রয়েছে— দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনি ও নীতিসহায়তার অভাব এবং অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। বিধি ও আইনবহির্ভূতভাবে গাছ কাটা, স্থানীয়দের দ্বারা অবৈজ্ঞানিকভাবে বনজ সম্পদ আহরণ, শিল্প ও আবাসন ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ, জমি দখলকারীদের দৌরাত্ম্য এবং পাচারকারীদের দ্বারা বেআইনিভাবে বনাঞ্চল থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণী ধরা। বনাঞ্চল সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের অসহযোগিতাও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে বিলুপ্তির পথে বনের ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আট প্রজাতির উভচর প্রাণী। তবে বনাঞ্চল রক্ষায় সরকারের কোনো ধরনের অবহেলা নেই বলেই দাবি করেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি দেশে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল দরকার, কিন্তু আমরা তা পারিনি। জনসংখ্যার তুলনায় দেশে জমি কম, তাই প্রয়োজনীয় বন সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও বর্তমান সরকার ৪ শতাংশ বনাঞ্চল বৃদ্ধি করেছে। তাছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং বনাঞ্চল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। বনাঞ্চল সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়াতে পুরস্কারের প্রবর্তন এবং তদারকি বাড়াতে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করা হচ্ছে।
সামাজিক বনায়ন বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, সামাজিক বনায়নে প্রচুর ফাঁকফোকর থাকলেও এটি জনপ্রিয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সামাজিক বনায়ন করে। তাই এটি বন মন্ত্রণালয়ের একার সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রধান বন সংরক্ষকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
কিন্তু যোগাযোগ করা হলে প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, ‘এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড কাভার চেঞ্জ ইন গাজীপুর, বাংলাদেশ, ইন রিলেশন টু লোকাল ইকোনমি স্টাডিড ইউজিং ল্যান্ডস্যাট ইমেজেস’ শীর্ষক ওই গবেষণায় ল্যান্ডস্যাট ৪-৫-এর থিমেটিক ম্যাপিংয়ের (টিএম) মাধ্যমে দুটি ভিন্ন বছরের ছবি নেয়া হয়। তা ছিল যথাক্রমে ২০০৫ সালের ১৬ জানুয়ারি সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত আকাশ ও ২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারি সামান্য মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ছবি। এছাড়া ২০০১ সালের ২৯ জানুয়ারি পরিপূর্ণ মেঘমুক্ত আকাশের ছবি নেয়া হয় ল্যান্ডস্যাট ৭-এর বর্ধিত টিএম প্লাস ম্যাপারের মাধ্যমে। এ ধরনের ছবি সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায় জানুয়ারিতে। আর নির্ভুল তুলনা নিশ্চিত করতে মূলত ভিন্ন বছরের একই সময়ের ছবি নেয়া হয়েছে।
ল্যান্ডস্যাটের ছবি গ্রহণ করা হয়েছে ইউএসজিএস গ্লোবাল ভিজুয়ালাইজারের কাছ থেকে। শ্রেণীবিন্যাসকৃত তথ্য বিশ্লেষণে গুগল আর্থ থেকে ৩৮টি এলাকার (সর্বমোট ৪৫৩৫ পিক্সেল) ছবি নেয়া হয়েছে। আর ডিজিটাল গ্লোব ইমেজারির মাধ্যমে গুগল আর্থ এসব ছবি নিয়েছে ২০০৭ ও ২০১০ সালে। বিষয়টির বাস্তব চিত্র পেতে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ২৬২ জন জিপিএস ক্যামেরা ছাড়াও ডিইএম ও এসআরটিএম প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ছবি তুলেছেন। সূত্র: বণিক বার্তা।