গাজীপুর-বিমানবন্দর বাস র্যাপিড ট্রানজিট: ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়বৃদ্ধির প্রস্তাব
ইসমাইল আলী:
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত নভেম্বরে প্রকল্পটির বিস্তারিত নকশা চূড়ান্ত করা হয়। বর্তমানে এর ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যেই বাড়ানো হচ্ছে দ্রুতগতির এ বাস সার্ভিস নির্মাণ ব্যয়। প্রকল্পটির ব্যয় ১ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিআরটি প্রকল্প নিয়ে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার অর্থায়নকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে বৈঠক করে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)। সেখানে বিআরটি প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি প্রকল্পটিতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়। তবে বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি সংস্থাটি।
সওজের তথ্যমতে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মিতব্য বিআরটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এখন তা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাত্ প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে ৯৭০ কোটি টাকা বা ৪৭ শতাংশ।
জানতে চাইলে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক মো. আফিল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকল্পটির বিস্তারিত নকশার ভিত্তিতে ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত সাতটি ফ্লাইওভার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেন করা হচ্ছে। এজন্যই মূলত ব্যয় বাড়ছে। এডিবি বাড়তি ব্যয়ের অর্থসংস্থান না করলে সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহের প্রস্তাব করা হবে।
বিআরটি নির্মাণে ১ হাজার ৬০৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা সরবরাহ করার কথা এডিবি, এজেন্সি ফ্রান্স ডি ডেভেলপমেন্ট (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ)। ৪৩৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা জোগান দেয়া হবে সরকারি তহবিল থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটি ব্যবস্থা চালুতে খুব বেশি কাজের প্রয়োজন হয় না। বিদ্যমান সড়কের দুই পাশে ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) দিয়ে বাসের জন্য পৃথক লেন করলেই চলে। আর বাসে ওঠানামার জন্য কিছু স্টপেজ তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে ভূমি থেকে দু-তিন ফুট উঁচুতে ছাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। বাস স্টপেজের সামনে থামার পর সোজা হেঁটে তাতে উঠে যান যাত্রীরা। আর চলাচলের রুটের মধ্যে কোনো জংশন (মোড়) থাকলে সেখানে বিআরটির বাসকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। বাস মোড়ের কাছাকাছি আসার পর সিগন্যাল বাতি জ্বলে। এতে মোড়ে অন্যান্য যানবাহন বন্ধ করে বিআরটির বাসকে আগে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ফলে বিআরটি নির্মাণে ব্যয় অনেক কম হয়।
তবে বাংলাদেশে বিআরটি নির্মাণ খুবই ব্যয়বহুল হচ্ছে বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিআরটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিমানবন্দর সড়ক থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রস্তাবিত বিআরটির জন্য কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ১০২ কোটি টাকা। নতুন প্রস্তাব অনুমোদন হলে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় আরো বাড়বে।
বুয়েটের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রথম বিআরটি চালু হয় ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরে ১৯৭৪ সালে। ৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যবস্থাটি চালু করতে সে সময় ব্যয় হয় ৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অর্থাত্ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয়ের পরিমাণ ১৫ লাখ ডলার। ২০১১ সালে একই শহরে নতুন আরেকটি বিআরটি চালু করা হয়। এতে ব্যয় হয় কিলোমিটারপ্রতি ২৫ লাখ ডলার।
কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় বিআরটি ব্যবস্থা চালু করা হয় ২০০০ সালে। ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা কিলোমিটারপ্রতি ৫৩ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে ২০০৪ সালে চালু করা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিআরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, কিলোমিটারপ্রতি যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ডলার। ব্রাজিলের সাওপাওলোয় ২০০৫ সালে ১১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি বিআরটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। কিলোমিটার হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ লাখ ডলার।
এছাড়া ২০১২ সালে আহমেদাবাদে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি চালু হয়। এতে ব্যয় হয় ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। অর্থাত্ প্রতিবেশী দেশটিতেও এ ব্যবস্থা চালু করতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৩১ হাজার ডলার।
জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় বিআরটি সবচেয়ে কম ব্যয়সম্পন্ন পদ্ধতি। খুব বেশি জটিলতা না থাকায় দ্রুতই এটি চালু করা যায়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলার। তবে বাংলাদেশে এটা অনেক বেশি হচ্ছে। মূলত অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থায় বিআরটি চালু করার কারণেই ব্যয় বেশি পড়ছে।
উল্লেখ্য, বিআরটি চালুর জন্য গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক পর্যন্ত চার লেনবিশিষ্ট ২০ কিলোমিটার বাসের পৃথক লেন, ৩১টি স্টপেজ ও গাজীপুরে একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। কিছু সড়ক প্রশস্ত, সার্ভিস সড়ক ও গাজীপুরে তিন কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি প্রকল্পটির আওতায় আট লেনবিশিষ্ট টঙ্গী সেতু ও সাতটি মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণেরও কথা রয়েছে। বণিক বার্তা।