গান্ধী: যার বিরুদ্ধে উঠেছিল নারীবিদ্বেষ ও বর্ণবাদের মতো অভিযোগ

বিবিসি বাংলা

রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে এবং অহিংস দর্শনের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছিলেন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতের এই জাতির জনক মহাত্মা বা মহান আত্মা হিসেবেও পরিচিত।

গান্ধীর ব্যক্তিত্বের এমন নানা দিক দেখে মনে হতেই পারে যে এমন মানুষের মধ্যে মন্দ কিছুর কোনও স্থান হতে পারে না।

তবে আর দশটা মানুষের মতো তিনিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না।

বর্ণবাদ

গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনজীবী হিসাবে কাজ করতেন তখন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের ব্যাপারে তিনি বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এমনও বলা হয় যে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের যেন মানুষ হিসেবেই গণ্য করতেন না।

গার্ডিয়ানের লেখক মাইকেল কনেলান এবং উপাধ্যক্ষ ময়ুখ সেন গান্ধী সম্পর্কে তাদের গবেষণা গ্রন্থে এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন।

এছাড়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার দুজন অধ্যাপক অশ্বিন দেশাই ও গুলাম ওয়াহেদের ‘দ্য সাউথ আফ্রিকান গান্ধী: স্ট্রেচার বেয়ারার অব দ্য এম্পায়ার’ নামে গবেষণাধর্মী বইটিতেও গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকার জীবন সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসে।

১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত প্রায় ২১ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন গান্ধী।

সেখানে যাওয়ার পর পর শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন তিনি, এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

তবে তাঁর আন্দোলন ছিল ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয়দের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে।

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে তিনি কোন অবস্থান নেননি।

এ ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক কিংশুক চ্যাটার্জি বিবিসি বাংলাকে জানান, “এই ব্যাপারে বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কিছু করেননি।”

“এই ব্যাপারটা নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতারাও বলেছেন যে, গান্ধী অনেক বড় রাজনীতিবিদ। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি যে আন্দোলন করেছিলেন সেখানে শুধু ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সামগ্রিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের দাবিতে তিনি কোন আন্দোলন করেননি।”

দক্ষিণ আফ্রিকায় বিত্তশালী ভারতীয় ব্যবসায়ী ও শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে গান্ধীর ওঠাবসা থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গদের সংস্পর্শ তিনি এড়িয়ে চলতেন।

১৮৯৩ সালে নাটাল পার্লামেন্টকে লেখা এক চিঠিতে তিনি ভারতীয়দের, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের চাইতে উন্নত জাতি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি বলেছিলেন যে ভারতীয়রা “বর্বর আফ্রিকান বাসিন্দাদের” চাইতে উন্নত।

১৯০৪-এর এক স্মারকলিপিতে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদেরকে আপত্তিকর দক্ষিণ আফ্রিকান গালি কাফফির, এমনকি ‘বর্বর’ ও ‘অসভ্য’ বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

১৯০৫-এ ডারবানে যখন প্লেগ লাগে, গান্ধী তার জন্য দায়ী করেন এই ‘আফ্রিকানদের।

এ বিষয়ে মি. চ্যাটার্জি বলেন, “গান্ধী শুধু চেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা যে অন্যায় করছে, সেটা যেন ভারতীয়দের সঙ্গে না হয়। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার থেকে ভারতীয়দের অধিকারকে আলাদা করতে উনি যেসব যুক্তি দেখিয়েছিলেন, সেখানে এই বিতর্কিত মন্তব্যগুলোও ছিল।”

গান্ধীর আক্ষেপ ছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা, ভারতীয়দের কালো আফ্রিকানদের মতো ও বর্ণবাদী বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখত।

শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের আফ্রিকানদের কাতারে নামিয়ে দেবে, এটা তিনি মেনেই নিতে পারেননি।

১৯০৮ সালে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরে, তিনি আক্ষেপ করেছিলেন যে তাকে ভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গ কারাবন্দীদের কাতারে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।

এমন নানা কারণে গান্ধীকে বর্ণবাদী আখ্যা দিয়ে গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর ঘানার রাজধানী আক্রার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়।

২০১৬ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ভারতের অর্থায়নে তৈরি মূর্তিটি উন্মোচন করেন। এর পরপরই সেটি সরানোর জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলন গড়ে ওঠে।

মূর্তিটি সরিয়ে ফেলতে ‘হ্যাশট্যাগ গান্ধী মাস্ট ফল’ নামে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমেও প্রচারণা চালানো হয়েছিল।

একই বছর মালাউইয়েও গান্ধীর ভাস্কর্য নির্মাণের একটি প্রকল্প বিক্ষোভের মুখে স্থগিত করেন আদালত।

যৌন-জীবন থেকে দূরে থাকার পরীক্ষা

গান্ধীর ব্রহ্মচর্য পরীক্ষাকে তার সবচেয়ে অন্ধকার দিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেড অ্যাডামস তার ”গান্ধী : নেকেড অ্যামবিশন” বইটিতে উল্লেখ করেন যে, রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধীর ছিল আধ্যাত্মিক এক জীবন৷

যেখানে তিনি পার্থিব ভোগ-সুখের ব্যাপারগুলোকে প্রতিরোধ করেছেন৷

গান্ধী বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়েসে। এর পর ৩৮ বছর বয়েসে – যখন তিনি চার সন্তানের পিতা – তখন তিনি ‘ব্রহ্মচর্য’ বা যৌনসম্পর্ক-বিরহিত জীবনযাপন শুরু করেন।

তাঁর আশ্রমে থাকা অনুসারীদেরও তিনি যৌনজীবন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন৷

গান্ধী নিজেই আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার পিতা যখন মারা যান – তখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন করছিলেন বলে পিতার পাশে থাকতে পারেন নি – এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছিল।

এরপর থেকে নিজের যৌন চাহিদা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কতটুকু সেটা প্রমাণ করার জন্য তিনি বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেছেন৷

এমনকি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীদেরও তিনি যৌনমিলন থেকে বিরত থাকার কথা বলতেন বলে জানিয়েছেন অ্যাডামস৷

নিজের যৌনানুভূতি দমনের পরীক্ষা করতে তিনি প্রায়ই নারীদের পাশে নগ্ন হয়ে ঘুমাতেন – তাদের মধ্যে কয়েকজন কম বয়সী মেয়েও ছিল।

মাইকেল কনেলান এবং ময়ুখ সেনের লেখায় এমন তথ্য উঠে আসে।

শেষের দিকে তিনি তার কিশোরী ভাগ্নির সাথে একই বিছানায় নগ্ন হয়ে শুয়েছিলেন। একই বিছানায় তাদের স্পর্শ না করে তিনি নিশ্চিত হতে চাইতেন যে তিনি কোনও যৌন শিকারি নন।

তবে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের লেখায় বিষয়টি অন্যভাবে উঠে এসেছে।

তিনি লিখেছেন, বঙ্গ প্রদেশের নোয়াখালীতে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করে যখন ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছে – তখন গান্ধী এক বিতর্কিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি তার নাতনী এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী মানু গান্ধীকে বললেন, তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে।

তিনি চাইছিলেন এটা পরীক্ষা করতে যে তিনি তার যৌন আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা।

গান্ধী মনে করতেন – তিনি যে পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তার সাথে ভারতের ধর্মীয় সংঘাতের একটা সম্পর্ক আছে।

এভাবে তিনি তার অনুসারীদের দমন করতেন এবং তাদের ওপর নিজের ক্ষমতা দেখাতেন এবং এই পরীক্ষা তিনি সবচেয়ে বেশি করতেন স্ত্রী কস্তুরবার সঙ্গে – ময়ুখ সেন লিখেছেন।

গান্ধী বলেছিলেন, তার স্ত্রী কস্তুরবার সাথে তার সম্পর্ক তখনই ‘আধ্যাত্মিক’ হয়ে উঠেছিল যখন তিনি ‘শারীরিক কামনার জীবনকে বিদায় দিয়েছিলেন।’

নারী বিদ্বেষ

মাইকেল কনেলানের মতে, গান্ধী অত্যন্ত নারী-বিদ্বেষী ব্যক্তি ছিলেন।

উদাহরণ স্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকাকালে, এক তরুণ গান্ধীর দুই নারী অনুসারীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলে তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দুই নারীর মাথার চুল জোর করে কেটে ছোট করে দেন – যাতে তারা কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারেন।

তার ধারণা যে নারীদের কারণেই পুরুষরা তাদের মৌলিক যৌনতার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

যে নারীরা পুরুষদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করে তাদের তিনি দেখতে পারতেন না। “আধুনিক চুলের স্টাইল এবং পোশাক সম্পর্কে তার ছিল তীব্র ঘৃণা।”

গান্ধীর মনে করেন নর-নারীর যৌনসম্পর্ক হবে শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য, আনন্দের জন্য নয়।

ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের লেখা ‘দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক গান্ধীর নতুন জীবনী গ্রন্থে নারী অধিকার, যৌনতা এবং কৌমার্য বিষয়ে গান্ধীর ভাবনা উঠে এসেছে।

গান্ধী একসময় তাঁর সময়কার অনেক পুরুষের মতো মনে করতেন যে নারীদের কাজই হল গৃহস্থালিতে কাজ এবং সন্তান লালন-পালন করা।

তিনি আবার নারীদের শিক্ষা, কাজ করার অধিকার এবং নারীপুরুষের সাম্যেরও সমর্থক ছিলেন।

পরবর্তীতে তিনি নারী ক্ষমতায়নের অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

তার একজন সহযোগী বলেছিলেন, তার মানসিকতা ছিল অনেকটা মধ্যযুগের খ্রিষ্টান সন্তদের বা জৈন সাধুদের মত।

ইতিহাসবিদ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, গান্ধীর চিন্তাধারা প্রাচীন হিন্দু দর্শনে প্রোথিত মনে হলেও, আসলে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রতিভূ।

গর্ভ-নিরোধ বিরোধী

গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে গর্ভ-নিরোধক ব্যবহার ব্যভিচারের লক্ষণ।

রামচন্দ্র গুহ তার বইতে বলছেন, গান্ধীর মতে যৌনতা হচ্ছে ‘জান্তব কামনা’ মাত্র, যা বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ এই জান্তব কামনাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে।

‘পুরুষদের উচিৎ তার ‘জান্তব কামনা’কে সংযত করা, আর নারীদের উচিৎ তাদের স্বামীদের বাধা দেয়া।’

একজন আমেরিকান জন্মনিয়ন্ত্রণকর্মী এবং যৌন শিক্ষাবিদ মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে ১৯৩৫ সালে মি. গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল – তার সম্প্রতি-প্রকাশিত বিবরণ থেকে এসব জানা গেছে।

মি. গান্ধীর দিক থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা অবশ্য এই প্রথম নয়।

তিনি একবার একজন নারী-অধিকার কর্মীকে বলেছিলেন: “আপনি কি মনে করেন যে জন্মনিরোধক দিয়ে শরীরের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব? নারীদের বরং শেখা উচিৎ কিভাবে তাদের স্বামীদের ঠেকাতে হয়। পশ্চিমা দেশের মতো গর্ভ-নিরোধক ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, নারী আর পুরুষ বাঁচবে শুধু যৌনতার জন্য, তাদের মস্তিষ্ক হবে দুর্বল। নীতিবোধ ভেঙে পড়বে।”

নারীদের ঋতুস্রাবকেও অপবিত্র হিসেবে দেখতেন গান্ধী।

রিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার লেখা ‘সেক্স অ্যান্ড পাওয়ার’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন যে গান্ধী ঋতুস্রাবকে “যৌনতার দ্বারা একজন নারীর আত্মার বিকৃত রূপের প্রকাশ” হিসাবে দেখেন।

বিদেশি ওষুধ বিরোধ

গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, তখন গান্ধী তার পেনিসিলিন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, যদিও চিকিৎসকরা বলেছিলেন যে এটি তাকে নিরাময় করবে।

গান্ধীর দাবি হল নতুন এই ওষুধটিতে বিদেশী পদার্থ রয়েছে যা তার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো উচিত হবেনা।

এমন অবস্থায় কস্তুরবা ধুঁকে ধুঁকে ১৯৪৪ সালে মারা যান।

কয়েক বছর পরে সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে তিনি কতো বড় ভুল করেছেন।

এরপর গান্ধী নিজে যখন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তখন তিনি চিকিৎসার জন্য নিজের ইচ্ছায় কুইনাইন ওষুধ নিয়েছিলেন। যার কারণে তার জীবন রক্ষা পায়।