গালিবের গজল থেকে – মাঈন উদ্দিন জাহেদ
বাংলাদেশে মহাকবি মীর্জা আসাদুল্লাহ খা গালিব কে নিয়ে প্রথম একান্তভাবে কাজ করেন কবি ও চিন্তুক মনির উদ্দিন ইউসুফ।যিনি বাঙলা ভাষায় ফারসী থেকে ইরানীমহাকাব্য শাহনামার সফল অনুবাদ উপহার দিয়ে ছিলেন।কবি ও চিন্তুক হিসেবে তারঁ ধী শক্তি সত্যিই সচেতন পাঠককে বিস্মিত করে।বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র মূল্যায়নে তারঁ একটি অনন্য মাত্রা আজ ও মূল্যায়ন হয়নি।এছাড়া তাকে মূল্যায়নের যোগ্য ব্যাক্তিও খুব স্বল্প।
কবি ও চিন্তুক মনির উদ্দিন ইউসুফ ১৯৬০ সালের দিকে গালিব চর্চা শুরু করেন।৯০ দশকে পশ্চিমবঙ্গের লেখিকা যূথিকা তলাপাত্র আতিশ- এ – গালিব লিখে আধুনিক পাঠকের দৃষ্টি ফেরান আঠারো শতকের এ কবির দিকে।যা এক সাথে ছিলো জীবনী ও কবিতা পাঠ।সত্যি যা ছিলো অনন্য।
২০০৪ সালে গালিবের গজল শিরোনামে ড. মফিজ চৌধুরীর একটি অনুবাদ প্রকাশ হয় মোহাম্মদ সা.দাত আলীর সম্পাদনায়।যা ছিলো প্রায় ৪০ বছর আগে করা একটি অনুবাদ কৃতির্ – যা সম্পাদকদের আলস্যের বদন্যতায় প্রকাশ পেয়েছে অনবাদকের মৃতু্যর দশ বছর পর।ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পাঠক সমাজ আরও একটি গালিবের অনুবাদ উপহার পায় আশি দশকের কবি ও কথাশিল্পী বুলবুল সরওয়ারের কাছ থেকে- মীর্জা গালিবের গজল শিরোনামে।চট্রগ্রামের নন্দন প্রকাশনের এ প্রকাশনা সুধী সমাজের ঈষর্ার দৃষ্টি কেড়েছে।ইংরেজি থেকে অনুবাদ হলেও অনুবাদক গালিব ঘরাণার সাথে পরিচিত বলে এবং ভাষা বৈশিষ্ট্যে এগানা বলে অনুবাদগুলো হয়ে ওঠেছে উপভোগ্য।
মীর্জা গালিবের শায়েরীর সাথে যাদের উঠাবসা নেই , তারা বুলবুলের অনুবাদের রস গ্রহনে ব্যর্থ হবেন না।ইতোমধ্যে বাঙালি পাঠক শুধু নয় লেখকরাও আচমিত হয়েছেন গালিবের শায়েরীতে। এর পেছনে নেপথ্য ভূমিকা রেখেছে নাসির উদ্দিন শাহ পরিচালিত ধারাবাহিক এপিসোড মীর্জা গালিব ও জগজিৎ সিং এর অনন্য গজল গাওয়া।আকুল প্লাবি প্রেমে ছুঁয়েছে নব্বই দশকের তারুণ্যই নয় পঞ্চাশের কবি সৈয়দ লিখেন গালিবের জীবন ও কৃতর্ি নিয়ে নব আঙগিকে নিজস্ব কবিতা।ষাটের কথাশিল্পী সেনিনা হোসেন লিখেন যমুনা নদীর মোশাহিদা । দুটিই আলাদা ভাবে মূল্যায়নের দাবী রাখে।পশ্চিমবঙগে গালিব কে নিয়ে আরও তিনটি গ্রন্থ আলোর মুখ দেখেছে। পুষ্পিত মুখপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রকাশ পেয়েছে গালিবের পত্রাবলী,গালিবের নিজের লেখা আত্মজীবনী দস্তুব, ও গালিবকে নিয়ে লেখা প্রথম স্মৃতিচারণ গ্রন্থ মৌলনা আলতাফ হোসেন হালির লেখা গালিবের স্মৃতি।যা সত্যি গালিব পাঠকের জন্য মহার্ঘ্য।গালিবের গজলের পাশাপাশি তার জীবনও গজলময়। পাঠক তুমুল ভাবে আলোড়িত হবেন এ তিনটি বই পাঠে। সাথে বুলবুল সরওয়ারের অনুবাদগুলো পড়তে ভুলবেন না।
গালিবের গজল থেকে // মাঈনউদ্দিন জাহেদ
গজল অর্থাৎ প্রেমালাপ- যারবিচিত্র চিন্তার প্রকাশ- পরিধি বিশাল , বিরহ থেকে মিলন আকাঙ্ক- হতাশা-ব্যথা-বেদনা-স্বাদ-আহ্লাদ-ঈর্ষা-যন্ত্রনা-ক্রটি,অভিমান-আর্তি। গজল শুরু হয় যে দু‘টো চরণ দিয়ে তাকে বলা হয় মাতলা ।প্রথম পংক্তিরশেষ শব্দটি আগের শব্দ দ্বিতীয় পংক্তির শেষ শব্দটির আগের একটি শব্দের সঙ্গেঁধ্বনিগত মিল থাকতে হয়। এ মিলকে বলা হয় ‘কাফিয়া’। গজলের পরবর্তী প্রতিটি কবিতার দ্বিতীয় পংক্তিরশেষ শব্দটি‘ মাতলা’র দ্বিতীয় পংক্তির শেষ শব্দটির স্থানে বার বার ছন্দিত হবে, আর এর নাম ‘রাফিফ’। গজলের দু’টো মিল। একটি ধ্বনিগত-কাফিয়া, দ্বিতীয়টি রাদিফ শব্দগতরা পুনরাবৃত্তি। গজলের শেষ কবিতা কে বলে মাকতা। বাংলা কবিতায় ঈশ্বের গুপ্তের কবিতাবলীতে এ মিল পাওয়া যায়। গজলের নায়িকা কখনওকিশোরী নয় বরং হয় তারা যুবতী – যে মনোরঞ্জন প্রাঞ্জ। তাকে বলা হয় ‘তাওয়াযেফ’- যাকে উদ্দেশ্য করে গজল রচনা হতো তারা সাধারণত পান সভায় গজলের সুরেনাচতেন । একনিষ্ঠ না হলেও যারা তন্ময় মূহুতের একান্ত জন। গজলের গাওয়ার একটিনির্দিষ্ট ঢং আছে। যাতে অভিজাত বাংলার তরুনী কিংবা অনিন্দ্য সুন্দরী নৃত্যপটিরসীরা। তাদের ধনাঢ্য বণিক বা আমীর-ওমরাদের মনোরঞ্চনের জন্য নিজেদের রুপকে তুলেধরতে। যা রক্ষনশীল মুসলিম সমাজে শালীনতার আড়ালে আর একটি বিকৃতি । বিশিষ্ট চিন্তকআবু সায়ীদ আইয়ুবের মূল্যায়ন হচ্ছে। এই শালীনতা বোধ, যার আওয়াতায় সমযৌন প্রেমউনবিংশ শতাব্দীর উর্দু কাব্যে সমাদৃত হলো।এবং নারীর প্রতি প্রতি পুরুষের ভালোবাসা বহিস্কৃত হলো বা প্রচ্ছন্ন রইলো আমাদের আজকের রুচিতে যতোই অদ্ভুত ঠেকুক,তাকে অস্বীকার করার জো নেই । তেমনি ভাবে বাঙালি মুসলিম বিত্তশালী সমাজে ঢুকেগিয়েছিল ঊনিশ শতকে ‘ঘেটুপুত্র’ রাখার প্রবণতা আর বাঙালি হিন্দু সমাজে কালি পুজাউপলক্ষে ‘নাটটো পোয়া’ নাচনো প্রথা । সামাজিক বিবর্তনের মধ্যদিয়ে অনেক বিকৃতি এখন লোপ পেয়েছেঠিকই ,তবে তাদের ক্ষতের চিহৃ বয়ে চলছে। আমাদের ইতিহাস গজল নিয়ে একটি বিমোহিত বোধ আছে রুচিশীল শিক্ষিত সমাজে । এটা একধরনের নষ্টালজিয়া । আমাদের ভেতরের অপ্রাপ্তিগুলো কে আমরা ভাব-গানের মাঝে খুজিফিরি।উর্দ্দু সাহিত্যের অসাধারণ গজলশিল্পী মীর্জা গালিব। তার গজল থেকে ক’টি ভাবঅনুবাদ-
গজল -১
যে আমি বার বার খুলি দরজা-জানালা
সেকি এলো সেকি এলো
বধুর চিঠি নিয়ে এলো নাকি বায়ূ-
বিশাদে আকাশ এলোমেলো
সে এলে আমার ঘরে বসে থাকি অবিরত
খোদার কি কুদরত!
এক বার দেখি ওকে, আবার দেখি ঘর
শূন্য ঘরে একি স্বপ্নীল জগৎ?
হৃদয়ের ক্ষত হৃদয়েই থাক
দেখবে কেন অন্য লোক?
দেহ-সৌষ্টব্যে পড়বে নজর-
দেখে যদি হিংসুটে লোক!
কী আর দেখবে তার -যার মাথায়
শোভা পায় মানিক্য মুকুট
বন্ধুর মাথায় মুক্তো জ্বলে আমি জ্বলি ঈর্ষায়
তার ভাগ্য নিয়ে করি আমি মাথা কুট্-কুটু্
গজল -২
নাইবা যদি কাঁদতাম আমি
এঘর হোতা বিরনে ভূমি ;
সাগর না হয় ,হতো মহাসাগর
কিংবা হতো মরুভূমি ।
হৃদয়ের কথা কি আর বলবো
দিলতো নয় কাফের দিল
কমিনা নাহলে এ দিল কি আর
এমন পেরেশান হয়ে যেতো ।
জীবনের এই তপস্যা শেষে-
একবারও তোমার দেখা না পেলে ;
তার চেয়ে তো ঢের ভালো হতো জীবন
তোমার ঘরের দারওয়ান হলে ।
গজল-৩
চলে বলে চাই এমন কোন খানে –
যেখানে নেই কেউ;
সমব্যথী নেই সমভাষী নেই
চলো চলে যাই; সেই খানে।
চলো বাধিঁ ঘর দরোজা জানালাহীন ,
প্রাচীরও ছাদহীন ;
নেই কোন প্রতিবেশী ,
নেই বলবার কেউ
আমি তুমি বন্ধনহীন ,,.
ভুগি যদি রোগ-শোকে? দেখবার কেউ নেই
মৃত্যু যদি বা আসে, কাদঁবার কেউ নেই ।
গজল- ৪
এসো তুমি প্রাণ যায় যায়
এসো তুমি! অপেক্ষার ধর্য্য নেই আর ।
জীবনশেষে দেহেম্বত্ত পাইও যদি
জীবনশেষে জ্বালার সেকী হয় প্রতিদান ?
তোমার মেহফিলে যদি কেঁদে ফেলি ?
ভয়ে তাই মরে যাই;
প্রাণ ভরে কাঁদার মতো পাইনা একটু ঠাঁই !
হায় ….হায় …..হায় ।
আমার হৃদয়ের কোথায় আছে হিংসা -ক্রোধ
প্রেমের ভস্মস্তুপে থাকে না কোনো বিরোধ;
আমাকে হত্যার যদি করো শপথ !
ভেঙ্গে না প্রতিঞ্জা যেন আবার ;
শপথ করেছে গালিব মাতাল হবে না,
নয়তো হবে না বন্ধুর প্রতিঞ্জা পালন ।
গজল -৫
আয়নাতে দেখে চুপ কেন? প্রেমে লাজ ?
হৃদয় দেবে না বলে গর্ব ছিলো; করো সাজ;
পত্রবাহকের প্রাণ নিয়োনা তোমার হাতে ;
নেই তার অপরাধ,তার তাতে
যা কিছু হয়েছে আমার অপরাধ সকলি আমার ।