চট্টগ্রামের গণহত্যা
রহীম শাহ ।
পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম অত্যাচার দেখেছে বাংলাদেশ, ১৯৭১
সালে। দেখেছে চট্টগ্রামবাসীও।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পুরো দেশের রূপ বদলে যায়। নিরস্ত্র বাঙালি
ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে চলে যায় অস্ত্র প্রশিক্ষণের
জন্য। এই সুযোগে পাকবাহিনী দখল করে নেয় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের
মতো চট্টগ্রাম শহর। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের পাকবাহিনী কিছু
বেইমান বাঙালি ও বিহারি দোসরদের দ্বারা অসংখ্যা নির্যাতন
কেন্দ্র ও বধ্যভূমি গড়ে তোলে। বাঙালিদের নির্যাতন করার জন্য
পাকদোসর হয়ে যেসব কুলাঙ্গার এগিয়ে এসেছিল তাদের আমরা
আলবদর, রাজাকার, আলশামস ও তথাকথিত মুজাহিদ বাহিনী বলে
ঘৃণার অস্ত্র ছুড়ে মারি। সে সব নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমিতে
বর্বর বাহিনী ও তাদের দোসরা জঘন্যতম পন্থায় মানুষদের অত্যাচার
করত। পাকবাহিনী ও তাদের মেরুদ-হীন বাঙালি ও বিহারি দোসররা
চট্টগ্রাম শহরে যেসব নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি পরিচালনা করত
তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া পাঁচটি বধ্যভূমির সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং
বিবরণ এখানে তুলে ধরছি।
১. চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ ছিল পাকসেনাদের সামরিক নিয়ন্ত্রণ
কেন্দ্র। এখান থেকেই তারা পুরো শহরকে নিয়ন্ত্রণ করত। সার্কিট
হাউজের বিশেষ কটি কক্ষ ছিল নির্যাতনের জন্য। ইলেকট্রিক চেয়ারে
বসিয়ে নির্যাতন করা হত। এই ইলেকট্রিক চেয়ারের মাধ্যমে
অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বাঙালিদের নির্যাতনের ব্যবস্থা ছিল।
নির্যাতনের পর অনেককে মেরে ফেলা হত। এছাড়াও এখানে নারী
নির্যাতনের ব্যবস্থা ছিল। কক্ষ দুটি দোতলায়। একটি কক্ষে শহরের
সুন্দরী মেয়েদের জোর করে ধরে এনে রাখা হত। আর বিশেষ কক্ষটি থাকত
সুসজ্জিত। সেখানে বন্দি মেয়েদের বেছে বেছে অফিসারদের জন্য
আনা হত। পুরো রাত একের পর এক অফিসাররা আসত। যার যাকে পছন্দ
সে ঐ মেয়েটিকে সুসজ্জিত কক্ষে নিয়ে লালসা সাঙ্গ করে চলে যেত।
কিছুদিন এসব মেয়েদের ভোগ করার পর সিপাহিদের দিয়ে দিত।
সেই স্থানে অন্য মেয়ে আনা হত। গর্ভবতী হয়ে গেলে সেসব মেয়েদের
বাইরে পাঠিয়ে দিত হত্যা করার জন্য। সার্কিট হাউজে ছিল :
১। বাঙালি নির্যাতন কেন্দ্র; ২। নারী নির্যাতন কেন্দ্র; ৩।
বধ্যভূমি এবং ৪। পাক শহর নিয়ন্ত্রণ দপ্তর।
স্বাধীনতার পর এখান থেকে অনেক মেয়েকে উদ্ধার করেছে
মুক্তিযোদ্ধারা। সঙ্গে অন্যান্য কক্ষ থেকে অনেক বাঙালি তরুণকে।
সেই ইলেকট্রিক চেয়ারে যাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের অসংখ্য
মাথার খুলি সার্কিট হাউজের সংলগ্ন গর্তে পাওয়া গেছে। এই
সার্কিট হাউজের নির্যাতন শিবিরের দায়িত্বে ছিল পাক সৈন্য
ক্যাপ্টেন নেওয়াজ মাহমুদ নজর। তার সঙ্গে সখ্য ছিল মুসলিম লীগ
(কট্টরপন্থী), জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের।
ডিসেম্বরের ৩ তরিখে একটি মেয়েকে ভোগ করার প্রশ্ন নিয়ে দুজন
পাকসেনা অফিসার মারা যায় এই সার্কিট হাউজেই। কে কার
আগে ভোগ করবে এই নিয়ে তাদের মাঝে দ্বন্দ হলে এক পর্যায়ে একে
অন্যকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। দুজনই মারা যায়। একজন বালুচ সৈন্যর
সহযোগিতায মেয়েটি অন্ধকারে পালিয়ে চলে আসে আলমাস
সিনেমা হলে। মানসম্মান ও প্রাণে রক্ষা পায় মেয়েটি।
২. চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম
স্টেডেয়াম ব্যবহৃত হয় খেলাধুলার জন্য। কিন্তু ১৯৭১ সালে ইতিহাসের
জঘন্যতম বর্বর পাকবাহিনী চট্টগ্রাম নিয়াজ স্টেডিয়ামকে
ব্যবহার করেছে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে। স্টেডিয়ামের বিভিন্ন
কক্ষে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছে। পাকবাহিনীর
সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রদান করেছে সি আর বি ভবনে
কর্মরত কজন বাঙালি অন্যরা অবাঙালি। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়।
পাক দোসররা রেলওয়ের আবদুল আলীকে ধরে নিয়ে আসে। ভদ্রলোক
টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। রাতে তাঁকে ধরে আনা হল
স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়দের কক্ষে বসিয়ে রাখার পর নিয়ে গেল মেজর
আনসারির সামনে। মেজর আনসারি তখন গভীর মনোযোগে টেবিলে
নুয়ে কী যেন পড়ছিল। চোখ ঘুরাতেই একজন সৈনিক সেল্যুট দিয়ে
দাঁড়াল। সৈন্যটি মেজর আনসারিকে লক্ষ্য করে উর্দুতে বলল, স্যার,
উনি সবাইকে চেনেন।
মেজর আনসারি একটি কাগজ জনাব আবদুল আলীর হাতে দিলেন।
বললেন, এই কাগজে যাদের নাম আছে চিনেন কিনা? জবাবে বললেন,
সবাইকে চিনি। সবাই রেলের কর্মচারী ও কর্মকর্তা। যাদের নামের
তালিকা তিনি দেখলেন, সবাই বাঙালি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের
সমর্থক। বুঝতে পারলেন, অবাঙালি রেল কর্মচারী ও পাকিস্তানের
বাঙালি দোসররা এদের নাম সরবারাহ করেছে। মেজর আনসারি তার
সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করলেন। আবদুল আলী সাহেব কারণ বুঝতে
পারলেন। তাকে ব্যবহার করা হবে। না বুঝার ভান করে তিনি চুপ করে
রইলেন। ইতিমধ্যে তার কানে ভেসে এল মানুষের আর্ত চিৎকার। বিশেষ
কক্ষে চলছিল বাঙালির উপর নির্যাতন। তিনি ভীত হলেন। এমন সময়
সেই কক্ষে প্রবেশ করল একজন যুবক। সে সি আর বি অঞ্চলে ছাত্র সংঘের
কর্মী। তার সঙ্গে ছিল একজন পাকসৈনিক। সে দ্রুত বাইরে চলে
গেল। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তারা চাপা স্বরে জিতু ও মিতুর কথা বলল।
আলী সাহেব আরও আতঙ্কিত হলেন। কারণ মিতু ও জিতু তাঁর কন্যা।
সরকারি মহিলা কলেজে আইএ ও বিএ-র ছাত্রী। এরই মধ্যে সকাল হল।
মেজর আনসারি একজন পাকসেনা অফিসারকে ডেকে বললেন, আলী
সাহেব সব কাজ করবে, তাকে ছেড়ে দাও। দ্রুত পদে আলী সাহেব
বাসায় ফিরলেন। কন্যাদের ভাল অবস্থায় দেখতে পেয়ে তিনি আল্লাহকে
ধন্যবাদ জানালেন।
ঘরের বাইরে এসে উন্মুক্ত আকাশ এবং চারদিক দেখছিলেন। এমন সময়
ঘরে বাইরে দেখে সেই যুবকটি। সঙ্গে শাদা পোশাকে আর একজন। তার
মনে সন্দেহ হল। বুঝে নিলেন সব। তিনি দ্রুত ভেতরে গেলেন। স্ত্রীকে
ডেকে ঘটনা বললেন। ভাবতে লাগলেন কী করে কন্যাদের বাঁচাবেন।
বুদ্ধিমান আলী সাহেব বুঝে নিলেন পাহারা বসিয়েছে। তিনিও
একটি কৌশল আঁটলেন। আলী সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে যুবকটিকে
ডাকলেন। সে এলে ঘরে বসিয়ে অনেক আলাপ করলেন। যুবকটি প্রাণ
খুলে কথা বলল। এমন সময় ঘরের কাজের ছেলে দৌঁড়ে এসে বলল, বেগম
সাহেব অসুস্থ, চিৎকার করছে। আলী সাহেব ভেতর গেলেন। অল্প সময় পর
বেরিয়ে এলেন। ছেলেটিকে বললেন, দয়া করে রেলওয়ে হাসপাতালের
এ্যাম্বুলেন্সটি দি এনে দিতে? বাসার ফোন খারাপ। বখাটে
যুবকটির মুখ উজ্জ্বল হল। সে মনে মনে ভেবেছিল, অসুস্থ মাকে
হাসপাতালে নিয়ে গেলে মেয়ে দুটিকে পাকসেনাদের সহযোগিতায়
নিয়ে যাবে। সে সঙ্গের জনকে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এল। ছুটল
হাসপাতালের দিকে। ইতিমধ্যে দারোয়ানের সহযোগিতায় বাড়ির
উল্টোপথে আলী সাহেব স্ত্রী কন্যাসহ সবাইকে নিয়ে নেমে গেলেন
লালখান বাজারের মোড়ে রাস্তায়। তারপর টেক্সি নিয়ে চলে আসেন
আগ্রাবাদ বেপারিপাড়ায় ভাইয়ের বাসায়। আলী সাহেব সুকৌশলে
নিজেকে বাঁচিয়ে আনেন স্টেডিয়ামের নির্যাতন কেন্দ্র থেকে এবং
নিজের কন্যাদের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন। অসংখ্য নির্যাতনের
সাক্ষী হয়ে চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম আজও আছে। স্টেডিয়ামে জুলাই
মাসের ২১ তারিখ থেকে আগস্টের ১৩ তারিখ পর্যন্ত প্রতিরাতে ৮-১০
জন বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করত।
৩. গুডস হিল
মুসলিম লীগের চরমপন্থীদের দ্বারা এই নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালিত
হত। এ বাড়িটি ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়ি। তিনি স্বাধীনতার
সূচনাতে তেমন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হননি। কিন্তু মে মাস থেকে
মুসলিম লীগের চরমপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তানি
সৈন্যদের সহযোগিতা করতে শুরু করেন। এক পর্যাযে তার গুডস হিল
স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষের নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়। শোনা
যায়, এই কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে তাঁর পুত্র সালাহউদ্দিন কাদের
চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে
স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষজনকে এখানে ধরে এনে লটকিয়ে পিটান
হত। উল্লেখযোগ্য যে, এই বাড়িতে প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ওমর
ফারুককে হত্যা করা হয়েছে। আলবদর বাহিনীর একটি বিশেষ গ্রুপ
এ বাড়ির নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সহযোগী। অবশ্য মুসলিম লীগের
নরমপন্থী ও বিবেচক দলটি স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন এবং তারা
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। যুদ্ধের সময়
গুডস হিলের চারপাশে ছিল অসংখ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী। নিরাপত্তার জন্য
নিয়োজিত ছিল পাকসেনা, আলবদর, রাজাকার আর মুজাহিদ
বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডারের বিরাট বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি
দল রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে চেষ্টা করেছিল ফজলুল কাদের
চৌধুরীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তিনি সেই কুলাঙ্গারকে
পাঠিয়ে দেন পাকিস্তান। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পর সেই
বিশ্বাসঘাতক দেশে ফিরে আসে। সময় বুঝে রাজনীতিতে জড়িয়ে
পড়ে।
৪. টাইগারপাস নৌঘাঁটি
পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হত। এটি
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নির্যাতনের
জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। মার্চের শেষ দিকে এখানে বন্দি করে আনা হয়
তৎকালীন ছাত্রনেতা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান সিটি
কর্পোরেশনের মেয়র এ.বি.এম.মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন ও
মোহাম্মদ ইউনুসকে। তাদের বীভৎস কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে
এখানে। শুধু কি তাই? এদের অনেকের সামনে মেয়েদের ধর্ষণ করা
হয়েছে। পুরুষদের একটি কক্ষে রেখে নির্যাতন করা হত। নির্যাতনের
কৌশল ছিল বিভিন্ন রকম। পাশেই ছিল নারী নির্যাতনের আলাদা
কক্ষ। বহু মহিলা ছিল এখানে। অবশ্য অফিসারদের জন্য নারী
নির্যাতনের আলাদা কক্ষ। সাধারণ সিপাহিদের জন্য ছিল আলাদা।
এছাড়াও এখান থেকে বিভিন্ন স্থানে বাঙালি নারীদের অন্যান্য
ক্যাম্পে সরবরাহ করা হত। টাইগারপাস কলোনির একজন অবাঙালি
রাজাকার ছিল আনোয়ার খান। সে ছিল টাইগারপাস নৌ-ঘাঁটির
সোর্স। সে কোন ঘরে কোথায় মেয়ে আছে অথবা কে স্বাধীনতার
পক্ষে রয়েছে, তাদের তালিকা সরবরাহ করত। এই আনোয়ার আনের
সার্বিক তত্ত্বাবধানে জুলাই মাসে টাইগারপাস কলোনির এক
বাসায় পাকবাহিনী হামলা চালায় গভীর রাতে। পাঁচ জনের এই দলে
পাকবাহিনীর দোসর ইসলামী ছাত্র সংঘের বাঙালি কিছু কর্মী
ছিল। পুরো এলাকা তাদের পাহারায় ছিল। আর পাঁচজন পাকসেনা
সেই ঘরে প্রবেশ করে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে। মেয়েটি তখন বি.এ.
শ্রেণির ছাত্রী ছিল। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারিয়ে মেয়েটি বেসামাল
হয়ে পড়ে। সকাল হওয়ার পূর্বেই সেই মেয়েটি ঘরের সামনে পেয়ারা
গাছে ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে।
টাইগারপাস বখতেয়ার নৌঘাঁটি বধ্যভূমি হিসাবে ব্যবহৃত
হয়েছে একাত্তরে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি কমান্ডো দল দ্বারা
এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হত। এখানে হত্যা করা হত বিভিন্ন অফিস-
আদালতের বাঙালি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের। বাঙালি ইপিআর
পুলিশ, আনসারসহ সেনাবাহিনীর সদস্য, যারা পাকবাহিনীর
হাতে ধরা পড়েছে তাদের এখানে হত্যার ব্যবস্থা ছিল। এখানে যাদের
হত্যা করা হত তাদের লাশ পাথর বেঁধে সাগরে ফেলে দিত। খুব
গোপনীয়ভাবে হত্যাযজ্ঞ চলত বলে অনেকে এই বধ্যভূমি সম্বন্ধে
জানতেন না।
৫. ফয়’স লেক
ফয়’স লেক অঞ্চল ছিল চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। এ
বধ্যভূমিকে কেন্দ্র করে বিহারিরা পশু খামারে একটি নির্যাতন কেন্দ্র
গড়ে তোলে। বিহারিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ নির্যাতন কেন্দ্রে প্রায়
সবাই ছিল রেলওয়ের কর্মচারী। এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের পূর্বদিন পর্যন্ত এই নির্যাতন
কেন্দ্র পরিচালিত হয়। কেন্দ্রের প্রধান ঘাতক ছিল অবাঙালি আলী
আকবর। ফয়’স লেক শহর চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ রেলওয়ে ওয়ার্কসপের
পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন আহম্মদ সামদানীর অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠে।
বধ্যভূমির প্রথম ঘাতক হিসাবে নিয়োগ পায় আহমেদ মকবুল খান।
সে অবাঙালি। পেশায় পাহাড়তলি রেলওয়ে ওয়ার্কসপের মেকানিক।
মার্চের প্রথম দিনে সে বদলি নিয়ে আসে সৈয়দপুর থেকে। জামাতের
মধ্যম সারির নেতা মকবুল রেল শ্রমিক সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিল। মে
মাসের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ কর্মী মোহাম্মদ আলীকে সে রেল
ওয়ার্কসপের সামনে দেখতে পায়। ছুটে গিয়ে মকবুল তাকে ধরে
নিয়ে আসে ওয়ার্কসপের ভেতরে। কোনো কথা না বলে গালমন্দ করতে
করতে তাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে কোমর ভেঙে দেয়। তার এই
অমানবিক আচরণে ক্যাপ্টেন সামদানী খুবই প্রীত হয়। ঠিক
সেদিনই সামদানী মকবুলকে ঘাতক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করে।
পাঁচ জন পাকসৈন্য ও বার জন অবাঙালির সার্বিক তত্ত্বাবধানে
মকবুলকে ফয়’ক লেক বধ্যভূমির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন সামদানী
রেলওয়ে ওয়ার্কসপ থেকে মকবুলের জন্য বিভিন্ন সাইজের চারটি
তলোয়ার ও ছুরি তৈরি করে দেয়। সঙ্গে দেওয়া হয় বড় ও মাঝারি সাইজের
পাথর। এক বৃহস্পতিবার পাঞ্জাবি সুবেদার আকমল খানসহ তথায়
বধ্যভূমির কাজ শুরু করে। বধ্যভূমি স্থাপনের সংবাদে খুশি হয়ে
হানাদার বাহিনীর নির্দেশে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ থেকে
বন্দি চার জন বাঙালিকে এনে হত্যা করে। ফয়’স লেক বধ্যভূমির হত্যা
পদ্ধতি ছিল :
১। জবাই করে হত্যা; ২। গুলি করে হত্যা এবং ৩। শরীর চিরে লবণ-মরিচ
ছিটিয়ে হত্যা।
এই তিন পদ্ধতিতে হত্যার পেছনে কারণ ছিল জবাই করে হত্যা করলে সে
মাথা পিছু পেত ২০ টাকা, গুলি করে হত্যা করলে পেত ১০ টাকা আর
শরীর চিরে লবণ মরিচ লাগিয়ে হত্যা করলে পেত ২৫ টাকা। ক্যাপ্টেন
সামদানী মকবুলকে এই হারে টাকা প্রদান করত। শহরের বিভিন্ন
নির্যাতন কেন্দ্র থেকে ফয়’স লেকে বন্দি বাঙালিদের পাঠিয়ে দেওয়া
হত হত্যার জন্য। এই হত্যাগুলো সম্পন্ন হত গভীর রাতে। মাঝে-মাঝে
ভোরেও হত। কোনো রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যার পূর্বে পুরো দেহ
চিরে লবণ মরিচ মেখে দিত। তারপর রেলের লোহার পাতের সাথে হাত পা
মাথা শক্ত করে বেঁধে রাখত। পরে প্রয়োজনে পাথরের উপর রেখে জবাই করা
হত। বিভিন্ন বির্যাতন কেন্দ্র থেকে যাদের আনা হত তাদের গুলি করে
লেকে ফেলে দেওয়া হত। অধিকাংশ সময়ে তারা জবাই করে মাথা আলাদা
করত এবং দেহকে বড় গর্তের ভিতরে ফেলে দিত। প্রায় প্রতিদিনিই
সেই গর্তে এক ধরনের কেমিক্যাল ছিটিয়ে দিত। জুলাই থেকে
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ এখানে প্রায় ২৫ হাজার বাঙালিকে
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যা করেছে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক
ভোরে অবাঙালিরা পাক সৈন্যদের সহযোগিতায় দোহাজারি
নাজিরহাট ও ফেনী থেকে আগত তিনটি ট্রেনের সকল যাত্রীকে ধরে
এনে ফয়’স লেকে হত্যা করে। সেখানে নারী ও শিশু ছিল অসংখ্য। ১৬
ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে অসংখ্য মৃত দেহের মাঝে নারী ও শিশুদের
গলিত দেহ দেখা গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফয়’স লেক বধ্যভূমির
একটি গর্ত থেকেই প্রায় ১১০০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
ফয়’স লেইকের চূড়ায় মহিলাদের শাড়ি ব্লাউজ ও পেটিকোট দেশ
স্বাধীন হওয়ার পরও পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ফয়’স লেক বধ্যভূমির পরিচালক ছিল পাঞ্জাবি লেন ও রেলওয়ে ওয়ার্কসপের
অবাঙালিরা। তাদের সংখ্যা ছিল শতাধিক। প্রত্যেক মাসিক ভিত্তিতে
ভাতা পেত। এছাড়াও ছিল বকশিক। তাদের জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল
পাহাড়তলি এলাকায় বাঙালিদের বাড়িঘর লুট করা। ক্যাপ্টেন সামদানী
তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা বিধান করত। ফয়’স লেকের হত্যার বর্ণনা
দিতে গিয়ে পাঞ্জাবি লেনের গাজী কামাল উদ্দিন বলেন, ১০ নভেস্বর
১৯৭১ আমার বাবা আলী করিম, চাচা, আরও দুজন মান্নান ও আবদুল
গোফরানকে ধরে নিয়ে যায়। আব্বা ও চাচাকে পেট চিরে ফয়’স লেকে
হত্যা করে। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল গোলাম আকবরসহ আরও
কজন।
পাঞ্জাবি লেনের ঘাতকরা জিয়ার আমলে তাদের চাকরি ফিরে পায় এবং ৭
বছরের বেতন ও পায়। গাজী কামালের পিতার হত্যাকারীরা এখনো বহাল
তবিয়তে রয়েছে।
এ. কে. এম আফসার উদ্দিন বলেন, সেদিন ছিল ১০ নভেম্বর ১৯৭১ সাল,
২১ রমজান। আকবর শাহ মসজিদ থেকে যেইমাত্র নামাজ পড়ে বের
হয়েছি, দেখি একজন অবাঙালি যুবক এসে অভিযোগ করল মসজিদের
পূর্বদিকে পাহাড়ের সমতল স্থানে বাঙালিরা চারজন বিহারিকে মেরে
ফেলে রেখেছে। উর্দুতে সে বলল, আকবর হোসেন ও দুজন মুসল্লি
সেখানে গেলাম। দেখলাম কজন অবাঙালি লাশগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে
রয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল অবাঙালি ঘাতক আকবর খান। সে চিৎকার
করে বলল, ইহাছে ভাগো শালা বাঙালি লোক। তার এই চিৎকারের সঙ্গে
সঙ্গে কানে এলÑভাগনে মাত দাও, খতম কর। কোনো রকমে পিছিয়ে
আসলাম কিন্তু আকবর হোসেন বাসার কাছে আসতেই অন্য দিক
থেকে আসা বিহারিরা তাকে ধরে নিয়ে গেল আগের জায়গায়। তিনি
ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিলেন। সকাল অনুমান সাড়ে ৭টার দিকে
বিহারিরা পুরো পাঞ্জাবি লেনের মানুষজনদের ধরে-ধরে নিয়ে গেল
ফয়’স লেকে। তাদের প্রায় সকলে মারা পড়েছে। …বিহারিরা ৭০ বছর
বয়সের বৃদ্ধ মুয়াজ্জিন ও রমজানের এত্তেকাব পালনকারী ৬২ বছরের আরও
একজন বৃদ্ধকে মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং জল্লাদের নিকট
সমর্পণ করে। দেখেছি অগুনতি মৃতদেহ। তাদের মাঝে অসংখ্য মহিলা,
সবাই উলঙ্গ। অধিকাংশই যুবতী। প্রায় সবার পেটে বাচ্চা। এসব
মেয়েদের সেনানিবাস থেকে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছে। পাক
সৈন্যরা মেয়েদের ভোগ করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার
কারণে ভোগের অযোগ্য হওয়ায় ফয়’স লেকে পাঠিয়ে দিয়েছে হত্যার
জন্য। আমরা ধৈর্যের সঙ্গে গুনে দেখেছি। তাজা মৃতের সংখ্যা প্রায়
১০০০ হবে। মানুষের মাথার খুলির সংখ্যা ও অগুনতি।
উল্লেখ্য যে, আফসার উদ্দিনসহ আরও কজন তখন ফয়’স লেকের অন্য
পাহাড়ে ঝোঁপের মধ্যে পালিয়ে ছিলেন। কোনোক্রমে বাঁচতে
পেরেছিলেন।