চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা
স্বাধীনতা–উত্তরকালে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যেও ব্যাপক জোয়ার পরিলক্ষিত হয়। এ–জোয়ার বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের মূল স্রোতকেই সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকাল থেকেই চট্টগ্রামের নাটক এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে এসেছে। যুদ্ধ–উত্তরকালে চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীদের মাঝে সঞ্চারিত হয় নতুন জীবনচেতনা। সদ্যস্বাধীন দেশে মুক্তির আনন্দে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে। আত্ম–আবিষ্কারের প্রবল আকাঙক্ষায় উদ্যমী তরুণদের অনেকেই আস্থা রাখে নাটকের মতো কার্যকরী শিল্প মাধ্যমের ওপর। পাদপ্রদীপের আলোতে তারা উন্মোচিত করতে চাইলো সময়ের ক্ষতকে; সমাজ–জীবনের নানা অসঙ্গতি ও বৈরী–বাস্তবতাকে।
স্বাধীনতা–উত্তর চট্টগ্রামের গ্রুপথিয়েটারগুলোকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্য। উন্মেষকালে প্রতিটি গ্রুপ থিয়েটার নিজেদের নাটক নিজেরাই রচনা করতে চেয়েছে। এ সৃজনশীল অভীঞ্ঝা এবং সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে এ সময় দলীয়ভাবে অনেক নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটে। দ্বন্দ্ব–বিক্ষুদ্ধ জীবনের জটিল জিজ্ঞাসাকে তারা নাটকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন। গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যান্দোলনের ফলে যে সব নাটক রচিত হয়েছে তার সবগুলোতেই সময়ের ক্ষত, ব্যক্তির স্খলন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের রূঢ় বাস্তবতার স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবাদ–প্রতিরোধ চেতনা এ সময়কালের নাট্যসাহিত্যের মূল প্রবণতা।
চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্য সুদীর্ঘ নাট্য–ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী। কবি নবীনচন্দ্র দাসের অনুরোধে চট্টগ্রাম কলেজের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক কৃষ্ণপদ বিদ্যারত্ন (কৃষ্ণপদ শর্মা) রচনা করেন ‘একশৃঙ্গ নাটক বা ভগবান বুদ্ধদেবের পূর্ব্ব জীবনী’–শীর্ষক কাব্যনাটক। ১৮৯৭ সালে চট্টগ্রামের সনাতন প্রেস থেকে নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে চৌধুরী জহুরুল হকের ভূমিকা সহ নাটকটি পুন প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য সমিতি। কৃষ্ণপদ বিদ্যারত্ন রচিত ‘একশৃঙ্গ নাটক বা ভগবান বুদ্ধদেবের পূর্ব্ব জীবনী’ চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে ধরে নিলে, চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস আজ শতবর্ষ উত্তীর্ণ। শতাব্দী পরিক্রমায় স্বাধীনতাপূর্বকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যের এ ধারায় যুক্ত হয়েছেন শশাঙ্কমোহন সেন, মোজাফফর আহমদ, আবদুল মোনএম, আবুল ফজল, মাহবুব–উল আলম, সুচরিত চৌধুরী,কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দী, ফরিদ উদ্দিন আহমদ, আব্দুস সাত্তার, মোহাম্মদ হাসান, অমলেন্দু বিশ্বাস প্রমুখ প্রতিভাবান নাট্যজন।
গত চার দশকের নাট্যচর্চার মধ্যদিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতা–উত্তর চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্য। মঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্টরাই নাট্যসাহিত্যের এ–ধারাকে পুষ্ট করেছেন। এ সময়কালে রচিত নাট্যসাহিত্যে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বপ্নভঙ্গজনিত বেদনা, সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার স্বরূপ। যে দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ জীবন–যাপন করেছে,সে রূঢ়–বাস্তব জীবনের রূপ নাট্যকাররা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন মঞ্চের ক্যানভাসে। কখনো মৌলিক সৃজনে, কখনো অনুবাদ রূপান্তরে, গল্পের নাট্যরূপ, লোককথার পুননির্মাণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সৃষ্ট চট্টগ্রামের গত চার দশকের নাট্যসাহিত্য আজ স্বতন্ত্র সাহিত্যশাখা হিসেবে চিহ্নিত হবার যোগ্য।
স্বাধীনতা–উত্তরকালে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যেও ব্যাপক জোয়ার পরিলক্ষিত হয়। এ–জোয়ার বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের মূল স্রোতকেই সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকাল থেকেই চট্টগ্রামের নাটক এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে এসেছে। যুদ্ধ–উত্তরকালে চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীদের মাঝে সঞ্চারিত হয় নতুন জীবনচেতনা। সদ্যস্বাধীন দেশে মুক্তির আনন্দে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে। আত্ম–আবিষ্কারের প্রবল আকাঙক্ষায় উদ্যমী তরুণদের অনেকেই আস্থা রাখে নাটকের মতো কার্যকরী শিল্প মাধ্যমের ওপর। পাদপ্রদীপের আলোতে তারা উন্মোচিত করতে চাইলো সময়ের ক্ষতকে; সমাজ–জীবনের নানা অসঙ্গতি ও বৈরী–বাস্তবতাকে। শোষণ–নির্যাতন আর অধিকার আদায়ে লড়াকু মানুষের জীবন–সত্যের স্বরূপ নাটকের মুকুরে প্রতিফলিত হলো সৃজনশীলতার প্রত্যয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে চট্টগ্রামের শিল্পী–সাহিত্যিক এবং নাগরিক মধ্যবিত্তের সাথে শ্রমজীবী–কৃষিজীবী গ্রামীণ সাধারণ মানুষের যে দূরত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে তা কিছুটা কমে আসে। কেননা মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে জীবন রক্ষার্থে জনগণের অতি কাছাকাছি যেতে হয়েছিল চট্টগ্রামের শিল্পী–সাহিত্যিকদের। ফলে গ্রামীণ জনগণের দুঃখ–বেদনা, শোষণ–নির্যাতন, জীবন–সংগ্রাম প্রভৃতির সাথে তাঁদের চাক্ষুষ পরিচয় ঘটে। এই অর্জিত জীবন অভিজ্ঞতা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিত চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যের বিরাট এলাকা জুড়ে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিবাদ–প্রতিরোধ চেতনা,যুদ্ধের শত্রুমিত্র চিহ্নিতকরণ, সেই সাথে সমসাময়িক সমাজজীবনের নানা সংকট, ব্যক্তির যাপিত জীবনের যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব–বিক্ষুদ্ধ সংগ্রামী মানুষের জীবন ও জীবন–সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয় স্বাধীনতা–উত্তর চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যের প্রধান উপজীব্য বিষয় হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে।
চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই চট্টগ্রামের স্থায়ী নাগরিক নন। পেশাসূত্রে চট্টগ্রামে অবস্থানকালে তাঁরা যুক্ত হন নাট্যরচনায়। এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য নাট্যকার মমতাজ উদদীন আহমদ (জ.১৯৩৫)। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে তাঁর নাট্যকৃর্তির প্রসঙ্গ। এছাড়াও চট্টগ্রামে বসে তিনি রচনা করেছেন ‘ফলাফল নিম্নচাপ’, ‘বর্ণচোরা’ প্রভৃতি। মমতাজ উদ্দীন আহমদের নাটক মুক্তিপাগল চট্টগ্রামের মানুষকে যুগিয়েছে অসীম সাহস ও প্রেরণা। অধ্যাপনাসূত্রে চট্টগ্রামে বসবাসকারী জিয়া হায়দার (১৯৩৬–২০০৮) নাট্যসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। জিয়া হায়দারের উল্লেখযোগ্য নাটক হল ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’, ‘পঙ্কজ বিভাস’, ‘সাদা গোলাপে আগুন’, ‘এলেবেলে’, ‘শ্যামলী চৌধুরীর কথা’ প্রভৃতি। পুরো সত্তর দশকজুড়ে নাটক রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন চৌধুরী জহুরুল হক (১৯৪৭–২০০৮)। ‘কবি কাহিনী’, ‘স্বর্গ–উপসর্গ’, ‘চিঠি’, পঞ্চরং’, ‘কল্পিত কল্পনা’ প্রভৃতি নাট্যরচনায় খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর উন্নত শিল্পচেতনা। সমাজ ও পারিবারিক জীবনের নানা সংকট ও বৈরী–বাস্তবতা তুলে এনেছেন রবিউল আলম (জ.১৯৪৮)। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাট্যকৃর্তী ‘জননীর মৃত্যু চাই’, ‘সমাপ্তি অন্যরকম’, ‘কখনো সৈকতে’, ‘নাপুস’, ‘আকাঙিক্ষত একজন’, ‘বিপক্ষে বন্দুক’, ‘রাজা সাহিত্য–কারখানা’, প্রভৃতি। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুন দিন’ এবং নাট্যকার মিলন চৌধুরীর প্রসঙ্গ। গত চারদশক জুড়েই মিলন চৌধুরী (জ.১৯৫০)নাট্যরচনায় যুক্ত। ‘নরক থেকে বলছি’, ‘চর্যাপদের হরিণী’, ‘একজন পিরামিড’, ‘অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা’, ‘নিবারণের স্বপ্ন–স্বদেশ’, ‘দায়ভার’ প্রভৃতি তাঁর নাট্যরচনার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। সমকালীন যুবসমাজের হতাশা, অবক্ষয় প্রভৃতি নিয়ে নাটক লিখেছেন হাবীব আহসান। ‘তরুণ ও বহমান ক্ষত’, ‘পলাতক পালিয়ে গেছে’ নাটক দুটো তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। একই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে ইফতেখার সাদিকের ‘জড়–হাইফেন’ নাটকে। এ ছাড়াও আবুল মোমেন (জ.১৯৪৮) রচিত ‘জীবন মানেই তৃষ্ণা’, শিশির দত্ত (জ.১৯৫৫) রচিত ‘মল্লিকার চোখে জল’, মুনীর হেলাল (জ.১৯৫৭)রচিত ‘শহর আমার শহর’ সমকালের বেশ জনপ্রিয় নাটক।
বিশ শতকের আশির দশকে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার তুমুল উত্থান, রাষ্ট্রের অব্যবস্থা,রাজনৈতিক অস্থিরতা আর স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় শক্তির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ব্যবধানজনিত কারণে সমগ্রদেশের মতো চট্টগ্রামের নাট্যকাররাও নতুন ভাবনায় উদ্দীপিত হন। আশির দশক থেকে নাট্যসাহিত্যে যুক্ত হয় প্রবল দ্রোহীচেতনা। রাজনৈতিক সংকট, নেতাকর্মীদের মিথ্যা আশ্বাস,রাষ্ট্রযন্ত্রের ঔদাসীন্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধে বিপক্ষীয় শক্তির এ দেশীয় দোসরদের আস্ফালন প্রভৃতি নেতিবাচক ঘটনা ও পরিস্থিতি চট্টগ্রামের মঞ্চসংশ্লিষ্ট নাট্যকারদের মনে তুমুল ক্ষোভের সঞ্চার করে। এ নেতি পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে প্রদীপ দেওয়ানজী (জ.১৯৫৪) রচনা করেছেন ‘আসবে সুঠাম সময়’, ‘অবাক রাজার অবাক কাণ্ড’, ‘দাবি’, ‘রাকস’; শান্তনু বিশ্বাস (জ.১৯৫৪) রচনা করেছেন ‘নবজন্ম’ ‘কালো গোলাপের দেশ’, ‘দপ্তরী রাজ দপ্তরে’, ‘ইনফরমার’; অলোক ঘোষ (জ.১৯৫৫) রচনা করেছেন ‘শ্যাওলা’, অভীক ওসমান (জ.১৯৫৬) রচনা করেছেন ‘অবশেষে জেনারেল’, ‘রাত ফেরার’, ‘শঙ্খ উপাখ্যান’, ‘সমুদ্রে অন্ধকার’; দীপক চৌধুরী (জ.১৯৫৮) রচনা করেছেন ‘রাজা এলেন রাজাকার, ‘আজকের সমাচার’, ‘পরাজয়ের পালা’, ‘স্বাধীনতার ময়না তদন্ত’, ‘আবার যুদ্ধ’;সনজীব বড়ুয়া (জ.১৯৫৮) রচনা করেছেন ‘বাজলো রাজার বারোটা’, ‘মহারাজ অসুস্থ’;শোভনময় ভট্টাচার্য্য (১৯৫৮–২০০৫) রচনা করেছেন ‘এপিঠ ওপিঠ’, ‘সিড়ি’, ‘দালাল’, ‘তস্কর’, ‘একাত্তরে তেলেসমাতি’, ‘সূর্যসেন’; বিজন মজুমদার (জ.১৯৬০) রচনা করেছেন ‘ধর্মঘট’, অরূপ বড়ুয়া (জ.১৯৬৪) রচনা করেছেন ‘সেনাপতির গদি’, স্বপন ভট্টাচার্য (জ.১৯৬৭) রচনা করেছেন ‘ট্রাংক রহস্য’, ‘অভীঞ্ঝিত’; আফরোজ আহমদ মিরজু রচনা করেছেন ‘ক্রসবাঁধ’, ‘স্বাধীনতার আহাজারি’ মইনুল শাওন রচনা করেছেন ‘ক্ষতের পাঁচালী’, রফিউল কাদের রুবেল (জ.১৯৭৭)রচনা করেছেন ‘সত্তান্ধ’, ‘লজ্জা’ প্রভৃতি নাটক।
লক্ষ্য করা যায়ণ্ড চট্টগ্রামের নাট্যকারদের গভীরভাবে আলোড়িত করেছে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে তাদের নাটকের আখ্যানে। মুক্তিযুদ্ধ একটি বহুমাত্রিক মহাকাব্যিক ঘটনা। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির যুগপৎ বীরত্ব ও বেদনার অনেক আখ্যান। চট্টগ্রামের নাটক বীরত্বের সে মহিমা ও বেদনার অশ্রুকে স্পর্শ করতে চেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের মঞ্চকর্মীরা গত চারদশক ধরে মুক্তিযুদ্ধের নাটক নির্মাণে নিবেদিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অজস্র অনুষঙ্গ উঠে এসেছে চট্টগ্রামের মঞ্চের মুকুরে। মুক্তিযুদ্ধে স্বপক্ষীয়দের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মহিমাকে তুলে ধরার পাশাপাশি বিপক্ষীয় শক্তির নৃশংসতাকেও তারা নাট্যায়ন করেছেন। পাকবাহিনী কর্তৃক হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের দৃশ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রতিটি নাটকেই পরিলক্ষিত হয়। উত্তরকালে যুদ্ধে নির্যাতিতা নারী, যুদ্ধশিশু ও শহীদ পরিবারের যাপিত জীবনের অপরিমেয় বেদনার ভাষ্য উঠে এসেছে নাটকের সংলাপে। স্বাধীনতার বিপক্ষীয় শক্তির তুমুল উত্থানে স্বপক্ষীয়দের মনে বেড়ে ওঠা ক্ষোভ গ্লানি ও বেদনা এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষা ও জোরালো ভঙিতে উচ্চারিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নাটকে অনালোকিত একটি বিষয়ে আলোকসম্পাত করেছে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানিদের নির্যাতনের বিভীষিকাময় ইতিহাস বহন করছে বাংলাদেশের অজ্রস্র বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকে বিষয়টি তেমনভাবে উঠে আসেনি। নাটকে প্রায় অনালোচিত এ বিষয়টি চট্টগ্রামের মঞ্চে উঠে এসেছে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। চট্টগ্রামের ফয়েজলেকের পাশে বাংলাদেশের বৃহত্তম বধ্যভূমি অবস্থিত। একাত্তর সালে বর্বর পাকিস্তানি সেনাকর্তৃক চট্টগ্রামে পরিচালিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নির্মম সাক্ষী এ–বধ্যভূমিটি। বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থ, নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ও তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে ফয়েজলেক বধ্যভূমি নিয়ে প্রদীপ দেওয়ানজী (জ.১৯৫৪)রচনা করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘বধ্যভূমি’। এটি একটি অনন্য ডকুড্রামা। নাটকটি মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানিদের অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের বীভৎস এক বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়।
স্বাধীনতাপূর্বকাল থেকেই চট্টগ্রামে আঞ্চলিক নাটকের একটি জনপ্রিয় স্রোত পরিলক্ষিত হয়েছে। চট্টগ্রামের লোকজীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়েছে আঞ্চলিক নাটকে। এতে উঠে এসেছে জনপদের জীবন ও সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিনির্ভর নাটকের ধারায় আবদুল গফুর হালীর (জ.১৯২৮) ‘গুলবাহার’, সনজিত আচার্যের ‘সাম্পানওয়ালা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামের গ্রামীণ জীবনের সুখদুঃখের কথামালা হিসাবে নাটকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ নর–নারীর স্বপ্ন, প্রণয়, প্রত্যাশা, হতাশা, ব্যর্থতা, বিচ্ছেদ, বিরহ এবং সামষ্টিক মানুষের জীবন–সংগ্রাম, বিশ্বাস, সংস্কার, কুসংস্কার প্রভৃতি গীত–বাদ্য ও কথার আশ্রয়ে দৃশ্যমান হয়েছে এ–সব নাটকে। স্বাধীনতাউত্তরকালেও চট্টগ্রামের লোককথা, পুঁথি, পালা এবং এ–অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ ও মানুষের জীবনসংগ্রামকে নাটকে তুলে ধরেছেন আমাদের নাট্যকাররা। এ প্রসঙ্গে সুচরিত চৌধুরীর (১৯২৯–১৯৯৪) ‘আমিনা সোন্দরী’ একটি দৃষ্টি–উন্মোচনকারী অনন্য শিল্পসৌকর্যসমৃদ্ধ নাট্যনিদর্শন। বর্তমানে বাংলাদেশের মঞ্চে লোকনাট্যের যে বিপুল সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে বলা যায় মিলন চৌধুরী নির্দেশিত এ–নাটকটি বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে সে সম্ভাবনার পথপ্রদর্শক। খন্দকার মর্তুজা আলীর (জ.১৯৪৭) ‘রমেশশীল’, ‘ভগাকাইন’ ‘মাস্টারদা’; শামসুল হক হায়দরীর(জ.১৯৫৭) ‘গাঁও গেরামর পালা’; আমিনুর রহমান মুকুলের (জ.১৯৭১) ‘মলকাবানু’, ‘সাম্পাননাইয়া’; দীপংকর দে (জ.১৯৭৯) রচিত ‘দুতিয়ার চাঁদ’, প্রভৃতি নাটকে চট্টগ্রামের জনজীবন, সংস্কৃতি ও লোকজীবনের অনুষঙ্গ ফুটে উঠেছে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে। উল্লেখ্য, আমাদের নাট্যকারদের হাত ধরে সমতলীয় বাঙালি জীবনের আখ্যান উঠে এসেছে । কিন্তু চট্টগ্রামের সমতলের সাথে পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ–সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিবিড় নৈকট্য ও নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও নাটকে উপেক্ষিত থেকেছে পাহাড়ি আদিবাসী জীবন। পার্বত্য চট্টগ্রামে এগারোটি(মতান্তরে তেরোটি) আদিবাসী গোষ্ঠীর রয়েছে স্বতন্ত্র জীবনসংস্কৃতি। এদের জীবন সংগ্রাম ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুসঙ্গের ব্যবহারে চট্টগ্রামের নাটকে যুক্ত হতে পারে স্বাতন্ত্র্যের নতুন চিহ্নসূত্র। এর মধ্যদিয়ে নৃগোষ্ঠীনাট্য চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায় হলেও একুশের ঘটনা ও বেদনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের নাট্যশাখা তেমন সমৃদ্ধ হয়নি। একুশের নাটক হিসোবে? সমগ্র বাংলাদেশেই? বহুল মঞ্চায়িত একমাত্র নাটক মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। তবে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন এ শূন্যতা কিছুটা হলেও পূর্ণ করেছে। মিলন চৌধুরীর ‘যায় দিন ফাগুন দিন’, রেজ্জাকুল হায়দারের ‘হরমুজ আলির একুশ’, আলী আনোয়ারের ‘বোবা মিনার’, সুদীপ দেওয়ানজীর ‘রঙিন সকাল কৃষ্ণচুড়া’, শোভনময় ভট্টাচার্যের ‘একুশের ইতিবৃত্ত’ একুশের নাট্যসাহিত্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। চট্টগ্রামের শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে শিশুনাটকগুলো। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন ওহীদুল আলমের ‘হালুয়া’, আবুল মোমেনের ‘ফুলকি’, ফেরদৌস খানের ‘শিশুমেলা’, আবু নাসের ফেরদৌসের ‘শাহজাদীর ঘুম ভাঙলো না’,ওমপ্রকাশ ঘোষ রায়ের ‘গ্যালেলিও’, রবিউল আলমের ‘আকাশ পারের আগন্তুক’, শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যরূপ ‘বীরের পুতুল’, প্রদীপ দেওয়ানজীর ‘মনভালো চশমা’, ‘রক্তরাজা সবুজ পরী’, দীপক চৌধুরীর ‘লেখাপড়া’, ‘শুলরাজার দেশ’, অসীম দাশের ‘মড়াগাঙ্গের সৈকতে’, সৌরভ শাখাওয়াতের ‘অদ্ভুত ভুত’, ইউসুফ ইকবালের ‘প্রকৃতির পাঠ’, তিলক বড়ুয়ার ‘টাকা দিলে আমি কাঁদবো’,রফিউল কাদের রুবেলের ‘লফা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা–উত্তর চট্টগ্রাম নাট্যাঙ্গনের উন্মেষপর্বের অনেক নাট্যকার এখন নিষ্ক্রিয়ণ্ড কেউ কেউ প্রয়াত। আশার কথা হলোণ্ড মৌলিক নাটক রচনার ধারাটি কখনো দুর্বল হয়ে যায়নি। নবীন নাট্যকারদের নিবিড় পরিচর্যায় মৌলিক নাটকের ধারাটি এখনো প্রাণবন্ত সজীব। বহুবিধ বিরূপ বাস্তবতা সত্ত্বেও সম্ভাবনাময় অনেকে এগিয়ে এসেছেন নাট্যরচনায়। আহাম্মদ কবীর (জ.১৯৫৯),জাহেদুল আলম (জ.১৯৭১), মাজহারুল আলম তিতুমীর (জ.১৯৭১), সুচরিত চৌধুরী টিংকু (জ.১৯৭১), মোকাদ্দেম মোরশেদ (জ.১৯৭১), সুমন টিংকু (জ.১৯৭১), তাপস চক্রবর্তী (জ.১৯৭৪),রফিউল কাদের রুবেল (জ.১৯৭৭), দীপংকর দে (জ.১৯৭৯), শিহাব খান (জ.১৯৮৬) প্রমুখ এক বা একাধিক নাটক রচনা করে প্রশংসিত হয়েছেন।
চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্য বিকাশে অনুবাদ নাটকের বিশেষ ভূমিকা আছে। নাট্যদলগুলো দলীয় চিন্তা ও সামর্থ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মৌলিক নাটক না পেলে নির্ভর করেছে বিদেশি নাটকের অনুবাদে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় কর্মীরাই অনুবাদ করেছেন নির্বাচিত নাটক। অনুবাদের জন্য নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীদের সমকাললগ্নতা ও সমাজমনষ্কতার পরিচয় রয়েছে। দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমকালীন সংকটসহ গভীর মানবিকবোধসম্পন্ন নাটকগুলোই তারা অনুবাদ করেছেন। অনুবাদে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়েছেন স্বাধীনতা। আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে ভাবানুবাদ ও রূপান্তরে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামকে আত্মীকরণ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এসব কারণে চট্টগ্রামের অনুবাদ নাটকগুলো কোননা কোনোভাবে বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অনেক অনুবাদ নাটক বিষয় বক্তব্য চরিত্র বাংলাদেশের সাথে এতই প্রাসঙ্গিক যে– এগুলো মৌলিক নাটক বলেই ভ্রম হয়। এখানেই চট্টগ্রামের অনুবাদ নাটকগুলোর স্বার্থকতা। স্বাধীনতাউত্তরকালে নাট্যপ্রযোজনার প্রয়োজনেই অনুবাদ নাটকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এসময় মৌলিক নাট্যকারেরাও হাত দিয়েছেন অনুবাদে। চট্টগ্রামের মঞ্চসফল অনুবাদ–রূপান্তর নাটকগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেয়া হলো।
একাত্তরের উত্তাল মার্চের নির্ভীক নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ। লেডি গ্রেগরির ‘রাইজিং অব দি মুন’কে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটযুক্ত করে তিনি সৃজন করেছেন ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’। রূপান্তর করে লিখেছেন আন্তন চেখভের ‘সোয়ান সঙ’ অবলম্বনে ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’। বার্টোল্ড ব্রেখটের ‘সেনোরা কারার রাইফেল’ অবলম্বনে অমিত চন্দ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন ‘রাইফেল’। বিশ্বনাট্যের ইতিহাস প্রণেতা জিয়া হায়দার বিদেশি নাটকের অনুবাদেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ তার অনুবাদ রূপান্তরগুলো হলো– ‘দ্বাররুদ্ধ’ (‘নো এক্সিট’, জ্যঁ পল সার্ত্রে), ‘এন্টিগোনে’ (জ্যঁ আনুই), ‘তাইরে নাইরে না’ (‘দ্যা ফ্যানটাসটিকস’, টম জোনস),। নাট্যপ্রযোজনার প্রয়োজনে দলীয় সংগঠক, কর্মী ও নির্দেশকদের হাতে অনুবাদ রূপান্তর হয়েছে অনেক বিশ্বসেরা নাটক। ম. সাইফুল আলম চৌধুরী মূলত নাট্যসংগঠক। দলের প্রয়োজনে অনুবাদ করে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন অনুবাদ নাটকের ক্ষেত্রকে। তার প্রথম অনুবাদ (জামিল আহমদের সাথে যৌথভাবে) ‘শেষ সংলাপ’ (‘সুলতানস ডায়লামা’,তৌফিক আল হাকিম)। এর পর এককভাবে অনুবাদ রূপান্তর করেছেন– ‘বিষের বালি’ (‘দি এ্যানিভার্সেরি’, আন্তন চেখভ), ‘অদ্ভুদ অন্ধকার’ (‘দ্যা রিফান্ড’, ফ্রিৎজ করিন্থি), ‘তিনি আসছেন’(‘দ্য লিডার’, ইয়োজিন আয়োনেস্কো) ‘অতিকায় অজগর’ (‘দ্যা কুইন এন্ড দ্যা রেভেলস’, ইয়োগো বেটি), ‘এই ঘর এই বসতি’ (‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’, আর্থার মিলার)। অসীম দাশ সব্যসাচী নাট্যনির্দেশক। নাটকের আদ্যপান্তে রয়েছে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। বিশ্বনাট্যের হিরকখণ্ডের দ্যুতি ছড়ায় মেধাবী এ নির্দেশকের শিল্পিত নির্দেশনায়। নিজের প্রাতিস্বিক নাট্যচিন্তার সাযুজ্যপূর্ণ বেশকিছু নাটক তিনি অনুবাদ করেছেন নির্দেশনার অনিবার্যতায়। অনেক বিশ্বসেরা নাট্যকারকে তিনি প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে। তার অনুবাদগুলো হলো: দারিয়া ফো–র দুটি নাটক ‘স্বপ্নবৎ’ (‘আর্চ এন্জেলস ডোন্ট প্লে পিনবল’), এবং ‘এ ওমেন এ্যালোন’। ‘নওকর শয়তান মালিক হয়রান’ (‘দ্যা সারভেন্ট অব টু মাস্টার্স’, কার্লো গোলদোনি), ‘বাঁধ’ (‘ড্রামস অন দ্যা ড্যাম’, হেলেন স্যাক্সন), ‘দ্যা লেসন’ (ইয়োজিন আয়োনেস্কো)। তার অনুদিত একক অভিনয়ের নাটক ‘এ ওমেন এ্যালোন’ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার ‘নাট্যচিন্তা’ পত্রিকায়– দারিয়া ফো নিয়ে বিশেষ সংখ্যায়। নির্দেশনার প্রয়োজনে কামালুদ্দীন নীলু (অভিজিৎ সেনগুপ্তের সাথে যৌথভাবে)অনুবাদ করেছেন চীনা অপেরা ‘লাল লণ্ঠন’। চীনের নাট্যকার ল্যু সানের নাটক অবলম্বনে শোভনময় ভট্টাচার্য লিখেছেন ‘করোটি’। মিশরীয় নাট্যকার তৌফিক আল হাকিমের দুটি নাটক অনুবাদ করেছেন আহসান সাইয়েদ– ‘সংকটে শয়তান’(আল শয়তান ফি খতর) এবং ‘যুদ্ধ ও শান্তির মাঝামাঝি’ (বাইন আল হারব ওয়া আস সালাম)। বিশ্বসেরা নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের রোমান্টিক কমেডি ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ অনুবাদ করেছেন রবিউল আলম (জ.১৯৪৮)। জ্যোতির্ময় নন্দী অনুবাদ করেছেন ‘নিয়তি নির্দিষ্ট মানুষ’ (‘ম্যান অ্যান্ড ডেস্টিনি’, জর্জ বার্নার্ড শ) এবং ‘গাংচিল’ (‘সী–গাল’, আন্তন চেখভ)। এছাড়া গল্প–উপন্যাসের নাট্যরূপ, নাটকের রূপান্তর প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে রচিত হয়েছে বেশকিছু মঞ্চসফল নাটক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবুল মোমেনের (জ.১৯৪৮) ‘শেষের রাত্রি’ (গল্প: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), জিয়া হায়দারের (১৯৩৬–২০০৮) ‘উন্মাদ সাক্ষাৎকার’ (গল্প: অ্যাডগার অ্যালান পো), শিশির দত্ত (জ.১৯৫৫) ও মুনীর হেলালের (জ.১৯৫৭) যৌথসৃজন ‘লালসালু’ (উপন্যাস: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ),মিলন চৌধুরীর ‘মহেশ’ (গল্প: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), প্রদীপ খাস্তগীরের ‘সেপাই’ (গল্প: হাসনাত আবদুল হাই), রবিউল আলমের (জ.১৯৪৮) ‘শাড়ি বাড়ি গাড়ি’ (গল্প: আবু রুশদ) এবং ‘এক যে ছিলো দুই হুজুর’ (গল্প: মিখাইল সালতিকভ শ্চেদ্রিন), শ্চেদ্রিনের একই গল্প নিয়ে চন্দন সেন রচিত নাটকের স্বপন ভট্টাচার্যকৃত (জ.১৯৬৭) রূপান্তর ‘টু ইডিয়টস’, সুদীপ দেওয়ানজীর ‘দুই বিঘা জমি’ (কবিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং ‘ডাক হরকরা’ (গল্প: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), মশিউর রহমান আদনানের ‘ফাঁকিপুরের পশু’(গল্প: ভগবতী পানিগ্রাহী), এবং ‘অথ কুত্তাশিয়াল চরিতামৃত’(গল্প: আবুল মনসুর আহমদ), ইউসুফ ইকবালের (জ.১৯৭২) ‘রঙ্গসভা’ (গল্প: আবুল মনসুর আহমদ) আমিনুর রহমান মুকুলের (জ.১৯৭১) ‘মন তার শঙ্খিনী’ (গল্প: হাসান আজিজুল হক)শিবলু চৌধুরীর (জ.১৯৭৬) ‘অস্পৃশ্য’ (গল্প: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়– চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন নাট্যসাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে পালন করেছে গৌরবোজ্জ্বল এক ভূমিকা। মৌলিক, অনুবাদ, রূপান্তর, নাট্যরূপ মিলিয়ে এক সমৃদ্ধ নাট্যভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন এখানকার নাট্যকর্মীরা। বিপুল আয়তন নাটক রচিত হয়েছে এখানে। স্বাধীনতা–উত্তর চট্টগ্রামের মঞ্চকে কেন্দ্র করে রচিত ও মঞ্চায়িত এসব নাটক বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধসহ সমকালীন আর্থ–সামাজিক–রাজনীতি যেমন উঠে এসেছে এসব নাটকের বিষয় ও বক্তব্যে তেমনি উঠে এসেছে এ–জনপদের মানুষের যাপিত–জীবন ও সৃজন–চিন্তনের স্বরূপ। জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকট ও বাঁকপরিক্রমাকে চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা মঞ্চে তুলে এনেছেন নিজস্ব বিবেচনা ও দৃষ্টিতে। আমাদের জাতীয় জীবন ও সমকালীন সমাজ বাস্তবতার অনুপুঙ্খ নাট্যভাষ্য হিরসবে নাটকগুলো বিশ্বস্ত শিল্পসাক্ষী। কিন্তু চট্টগ্রামে রচিত ও মঞ্চায়িত অনেক দর্শকনন্দিত নাটক এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। নাট্যপত্রিকা বা ছোটোকাগজে প্রকাশিত নাটকগুলো এখন দুষ্প্রাপ্য। অপ্রকাশিত অনেক মঞ্চসফল নাটক হারিয়ে যেতে বসেছে বিস্মৃতির অতলে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক খণ্ডে স্বাধীনতা–উত্তর চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্য গ্রন্থবদ্ধ হওয়া জরুরি। তাহলে খুঁজে পাওয়া যেত বাংলাদেশের নাট্যচর্চা ও নাট্যসাহিত্যের স্বতন্ত্র একটি স্রোতণ্ড যা বিষয় বক্তব্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ। এ নাটকগুলো এ–অঞ্চলের নাট্যকর্মীদের মনন সৃজন ও চিন্তন দক্ষতার পরিচয়বাহী কালের সাক্ষী। কোন বিত্তবান নাট্যপ্রেমিক ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা কোন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অথবা কোনো সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় কাজটি করা গেলে এ–সব অমূল্য নাট্যকৃতি এবং উদ্যোক্তা উভয়ই অক্ষয় হয়ে থাকবে। সে–সাথে চট্টগ্রামের নাট্যসাহিত্যও স্থায়িত্ব পেতো স্বকীয় মর্যাদায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, নাট্যজন