ছাদকৃষি: প্রয়োজন এখন সুষ্ঠু পরিকল্পনা
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বাসার ছাদে বাগান দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ ছাদে এখন শুধু ফুল নয়, শাকসবজি, ফলমূল সবই হচ্ছে৷ বাণিজ্যিক না হলেও শখের এই বাগানে বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা৷ পড়ুন ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন . . .
নাসিরুল ইসলাম থাকেন মিরপুরে৷ তিনি তাঁর পাঁচতলা বাসার ছাদে বাগান শুরু করেছেন তিন বছর আগে৷ বাগানের আয়তন ১,৪০০ বর্গফুট৷ মৌসুমি সবজি ছাড়াও তিনি আম চাষে রীতিমতো সাফল্য দেখিয়েছেন৷
আম রয়েছে নানা জাতের, নানা দেশের৷ বাহারি সব আমের কারণে প্রতিবেশীদের মধ্যে তাঁর সুনামও ছড়িয়ে পড়েছে৷ গত মৌসুমে অনেকই তাঁর ছাদবাগানের আম দেখতে গেছেন৷ প্রতিবেশীদের সাধ্যমতো বাগানের আম খেতেও দিয়েছেন নাসিরুল৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গত মৌসুমে এত আম হয়েছে যে, আমাকে আর বাজার থেকে আম কিনতে হয়নি৷ আমার বাগানে থাইল্যান্ডসহ নানা দেশের, নানা জাতের আম গাছ আছে৷ আমি মাল্টা এবং কমলাও ফলিয়েছি আমার বাগানে৷”
ছাদে বাগান করার এই শখ এসেছে হতাশা থেকে৷ নাসিরুলের বাড়িটি বহুতল করার আগে এখানে আম কাঁঠালসহ নানা ধরনের সবজি চাষ হতো৷ বাচ্চারা খেলতে পারতো৷ বাড়ি করার কারণে সেই সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়৷ সেখান থেকেই নাসিরুল ছাদে বাগান করার পরিকল্পনা
তাঁর বাগানে শীতের সবজির চাষ হয়েছে৷ ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, লাউ, ধনে পাতা, লেটুস পাতা, মরিচ ইত্যাদির চাষ করেন তিনি৷ এছাড়া মরিচ তাঁর বাগানে বারো মাসই হয়৷ চাষ হয় ক্যাপসিকামের৷
যে মৌসুমে যে ধরনের শকসবজি হয় সেই মৌসুমে তা-ই চাষ করেন নাসিরুল৷ তিনি বলেন, ‘‘শাকসবজিও আমার কিনে খেতে হয় না৷ বরং প্রতিবেশীদের দিতেও পারি৷ এবার প্রচুর পুঁই শাক হয়েছিল৷ অনেককেই দিয়েছি৷”
নাসিরুল টিনের ড্রাম আর প্লাস্টিকের কন্টেনারে গাছ লাগান৷ প্রয়োজনীয় পরামর্শ নার্সারি থেকেই পেয়ে থাকেন৷ নার্সারিতে পরিচর্যার লোকও পাওয়া যায়৷ এছাড়া তিনি নিজেও বাগান পরিচর্যায় সময় দেন৷ তিনি জানান, ‘‘বাগান শুরু করার সময় যা খরচ হয়, এরপর আর তেমন খরচ নেই৷ আমার মাসে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয় না৷ আমি চাষ করি অর্গানিক উপায়ে৷ কোনো কৃত্রিম সার বা কীটনাশক ব্যবহার করি না৷”
মল্লিকের ফল বাগান
ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে এরকম ছাদবাগানের সাফল্যের অনেক গল্প এখন পাওয়া যায়৷ ছাদে এখন প্রায় সব কিছুরই চাষ হয়৷ এমনকি ধান চাষেও সাফল্য দেখিয়েছেন কেউ কেউ৷ ছাদে পানির চৌবাচ্চা করে জলজ উদ্ভিদ আর শাপলা, পদ্ম ফুটিয়েছেন কেউ কেউ৷ কেউ আবার পুরো ছাদটিকেই পরিণত করেছেন ফলের বাগানে৷ সেরকমই একজন হলেন ঢাকার বাসাবোর এহতেশামুল হক মল্লিক৷ তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক৷ তিনি তাঁর বাড়ির চারতলার কিছু অংশ এবং পাঁচতলার ছাদ মিলিয়ে ১৬শ’ বর্গফুটের ফল বাগান গড়ে তুলেছেন৷ মাঝেমধ্যে অবশ্য সেখানে সবজিও চাষ করেন৷ তাঁর বাগানে পেয়ারা, কলা, কামরাঙা, আনার, সফেদা, মাল্টা, তেঁতুল, আনারস, ড্রাগন, ডুমুর, অরবড়ই, আমড়া, কদবেল ইত্যাদি ফলানো হয়৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘২০০০ সালে আমি প্রথম ছাদে ফুল চাষ শুরু করি৷ আমার স্ত্রী-ই গোলাপসহ নানা ধরনের ফুল গাছ লাগাতেন৷ এরপর আমার সবজি ও ফল চাষে আগ্রহ হয়৷ কিন্তু প্রথমে নার্সারি থেকে যে চারা কলম আনতাম তা ভালো হতো না৷ দুই বছরেও ফল আসতো না৷ এরপর রামপুরার একজন ছাদবাগানি টিপু সুলতান খানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়৷ তিনি এখন আর নেই৷ তিনিই আমাকে ছাদে চাষের উপযোগী চারা ও বীজ দেন৷ তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷ নানা ফল দিয়ে আমার বাগান ভরিয়ে তুলেছি৷”
মল্লিক বলেন, ‘‘আমার তেমন কোনো ফল কিনে খেতে হয় না৷ সারাবছরই আমার ছাদের বাগানে কোনো-না-কোনো ফল থাকে৷ আমার কলিগরা আসেন, বন্ধুবান্ধব আসেন৷ তাঁদের নিয়ে ছাদে নানা অনুষ্ঠানও করি৷ গাছের ফল গাছ থেকেই পেড়ে তাঁদের খেতে দেই৷ এ এক অন্যরকম আনন্দ৷”
এহতেশামুল হক মল্লিক একটি ওয়েবসাইটও খুলেছেন৷ সেখানে তাঁর বাগানের ছবি, ফলের ছবি, বাগান নিয়ে লেখা আছে৷ আর যাঁরা ছাদবাগান করতে চান, তাঁদের পরামর্শ ও তথ্য সহায়তাও দেন তিনি৷
শুরুর কথা
বাংলাদেশে ছাদবাগানের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় রামপুরার টিপু সুলতান খানকে৷ তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘গ্রিন রুফ মুভমেন্ট’ নামে একটি সংগঠন৷ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারী গোলাম হায়দার ওই সংগঠনের দায়িত্ব নেন৷ তিনি একজন প্রকৌশলী হলেও ছাদবাগান থেকে এখন কৃষিকেই তাঁর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি ছাদবাগান শুরু করি ৩০ বছর আগে৷ তারও আগে কাজ শুরু করেন টিপু সুলতান খান৷ তিনিই সংগঠনটি গড়ে তোলেন৷ আমরা সভা-সেমিনার করেছি৷ লিফলেট বিতরণ করেছি ছাদবাগানের জন্য৷ কিন্তু আমরা বিপ্লব ঘটে গেছে বলে মনে করলেও আসলে তা নয়৷ ঢাকায় যত ছাদ আছে তার মাত্র পাঁচ ভাগে বাগান আছে৷ তবে উৎসাহ বাড়ছে৷ আমরা বলি, ছাদকে সবুজ করেন৷ সেটা শাকসবজি বা ফলের চাষ, ফুল গাছ লাগানো বা যে-কোনো ধরনের প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে হতে পারে৷ সাধারণভাবে বলা হয়, এটা করলে অক্সিজেনের ঘাটতি দূর হবে, কার্বন ডাই-অক্সাইড কমবে৷ বাড়িকে শীতল রাখবে৷ কিন্তু এর বাইরেও আমরা যেটা বলি, শহরে ছাদবাগান যত বাড়বে, তত শিক্ষিত কৃষক তৈরি হবে৷ আর ছাদবাগানের আগ্রহ মানুষকে কৃষিতে দক্ষ করবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সব শহর মিলিয়ে ১০ লাখেরও বেশি ছাদ আছে৷ এ ছাদগুলো চাষাবাদের আওতায় আনলে বছরে একটা ছাদ থেকে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকার সবজি পাওয়া সম্ভব৷ আমরা বলি, বাংলাদেশের মোট ছাদের আয়তন একটি জেলার আয়তনের সমান৷ আর ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষ নগরে বাস করবে৷ তাই নগরের ছাদকে ব্যবহার করতে হবে কৃষি উৎপাদনে৷ সারা পৃথিবীতেই ছাদে চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় করার কাজ চলছে৷ ভিয়েতনামের সবজি চাষের ৫০ শতাংশ হয় ছাদে৷ টোকিও শহরে ছাদে ২৫ শতাংশ বাগান করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ আমাদের এখানেও সরকারি প্রণোদনা এবং উদ্যোগ প্রয়োজন৷”
গোলাম হায়দার ছাত্র অবস্থায় কাজি পেয়ারার একটি গাছ লাগানোর মাধ্যমে ছাদবাগান শুরু করেন৷ এখন মূলত তিনি তাঁর রামপুরার ছাদবাগানকে বিভিন্ন ফল, সবজি, শাক, ফুলের জাত সংরক্ষণের বাগানে পরিণত করেছেন৷ তিনি জানান, ‘‘আমার বাগানে আমই আছে ৩৫ জাতের৷ আমার ছাদে ওষধি গাছ আছে, ক্যাকটাস আছে৷” তিনি বলেন, ‘‘আমি পেশায় এখন নগরের কৃষক৷ আমার এর বাইরে কৃষিখামার আছে, নার্সারি আছে৷ আমি বাগান করতে পরামর্শ দেই, প্রচার চালাই, উদ্বুদ্ধ করি৷”