ছুটি কি ফাঁদ ?

 

হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

ভারতের লেখক সমরেশ বসু ‘ছুটির ফাঁদে’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। তাতে অসুবিধা কিছু ছিল না, বই আর কজন পড়ে। গোল বাধল তখন, যখন বাংলাদেশের শহীদুল হক খান উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দিলেন। ছবিটি কতটা সুনির্মিত ও শিল্পসম্মত ও ব্যবসাসফল হয়েছিল মনে পড়ে না, তবে ‘ছুটির ফাঁদে’ নামটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা মনে আছে। এখন দেখছি, শুধু ছড়িয়েই পড়েনি, নামটি আমাদের প্রিন্ট মিডিয়ায় একেবারে আসন গেড়ে বসেছে। প্রতি বছর ঈদ এলে পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘ছুটির ফাঁদে’র দেখা মিলবেই।
এ লেখা যখন লিখছি তখন (সোমবার) পর্যন্ত কোনো পত্রিকায় এই নিয়মিত বার্ষিক শিরোনামটি চোখে পড়েনি। তবে এটা নিশ্চিত, আর দিন-দুয়েকের মধ্যেই ‘ফাঁদের’ দেখা মিলবে। কেননা, এবারো ঈদের ছুটি, তার আগে-পরে সাপ্তাহিক ছুটি এবং মাঝখানে যে দিন-দুয়েক কর্মদিবস তাও তো প্রকারান্তরে ছুটিই- সব মিলিয়ে নয় দিন ছুটি। অতএব, আর পায় কে! দেশ ও জাতি যে ঈদের নামে বিরাট ছুটির ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছে, সে কথা বলতে আর বাধা কিসের। আর ইনিয়ে-বিনিয়ে এ কথাও দেশবাসীকে বোঝানো দরকার যে, এত ছুটি! এত ছুটি ভালো নয়, হোক না তা ঈদের ছুটি। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ চাঁদে গেছে, মঙ্গলে গেছে আর আমরা কিনা আটকে আছি ছুটির ফাঁদে! হায়, এ দেশটার কী হবে!

এ-ই হলো ‘ছুটির ফাঁদ তত্ত্বের’ প্রবক্তাদের বক্তব্য ও মনোভাব। প্রশ্ন হলো, ছুটি কি সত্যিই ফাঁদ, যে ফাঁদে আটকা পড়ে দেশ-জাতির উন্নয়ন এবং তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ!
মনে পড়ল দৈনিক নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের কথা। এই প্রাজ্ঞ প্রবীণ সম্পাদক একদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে আড্ডায় স্মৃতিচারণায় বলছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের সঙ্গে তার স্বল্পস্থায়ী সাক্ষাতের কথা। গুনার মিরডাল নাকি কথায় কথায় তাকে বলেছিলেন, সে জাতিই সভ্য, যার প্রচুর অবসর আছে। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমরা (পশ্চিমারা) শুধু কাজই করি, আমাদের কোনো অবসর নেই, ছুটি নেই। এটা তো ঠিক না। মানুষের জীবনের কাজ যেমন থাকবে, তেমনি তার অবসর এবং অবসরযাপনও থাকতে হবে।’ বলেছিলেন মিরডাল, ‘আসলে প্রাচ্যের মানুষই সভ্য। তাদের প্রচুর অবসর।’
গুনার মিরডাল নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জগদ্বিখ্যাত মানুষ। তার কথা অবশ্যই মান্য, সর্বাংশে না হলে আংশিক তো বটেই। পশ্চিমে ছুটি না থাকার কথা তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছিলেন, জানি না। তার পরেও একজন অর্থনীতিবিদ যখন অবসরে প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন, বুঝতে হবে, তা তিনি তার অধীত ও চর্চিত জ্ঞানের বাইরে গিয়ে বলেননি। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে অবসরের অর্থনৈতিক তাৎপর্যটি তিনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি।
কিন্তু আমরা, বাংলাদেশের মিডিয়াকর্মীরা, নিশ্চিতভাবেই ভুলে যাই (‘ভুলে যাই’ কথাটি কি ঠিক হলো? আমরা হয়তো বিষয়টা জানিই না। জানলেই তো মনে রাখা কিংবা ভুলে যাওয়ার প্রশ্ন আসে)। তাই তো ঈদ কিংবা এ রকম কোনো উৎসব এলে, ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠলেই আমরা ‘ফাঁদ’ খুঁজতে শুরু করি। উৎসব যে মানবজীবনেরই অনিবার্য অনুষঙ্গ আর ছুটি ছাড়া যে উৎসব হয় না, সে কথাটাই আমরা ভাবতে চাই না। আমরা ভাবি না, এই কদিন ছুটির জন্য যদি দেশ রসাতলে যায়, তো সারা বছর কাজ করে আমরা কোন মঙ্গলগ্রহে পৌঁছাতে পেরেছি?
মানুষের শ্রমে ও ঘামে সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং এগিয়ে চলছে, এ নিয়ে কোনো বিবাদ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ তো মানুষই। সে যেমন শ্রম দেবে, পরিশ্রম করবে, তেমনি তার অবসরও চাই। এই অবসরটুকুর নামই ছুটি। আর ছুটি কখনো ফাঁদ নয়। ছুটি কর্মী মানুষের মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকার। আমরা কি ‘ছুটির ফাঁদ, ছুটির ফাঁদ’ বলে চেঁচামেচি করে সেই প্রয়োজন ও অধিকারকে অস্বীকার করেই যাব?
প্রিয় পাঠক, লেখাটি এখানেই শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে একটি খবর আমাকে আটকে দিল। আজকের (২১ জুলাই, ২০১৪) প্রথম আলোর একটি সংবাদে দৃষ্টি আটকে গেল। বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা ধনী কার্লোস স্লিম হেলু বলেছেন, ‘কাজের ব্যাপারে আমরা সবাই ভুল ধারণার মধ্যে আছি। আমাদের সপ্তাহে মাত্র তিন দিন কাজ করা উচিত।’
কেন, সেই জবাবও দিয়েছেন এই ধনকুবের। তিনি মনে করেন, সপ্তাহে তিন দিন কাজ ও চার দিন ছুটি থাকলে তাতে জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠবে না, বরং হবে মজার। এর ফলে শ্রমশক্তি অধিকতর সুস্থ-সবল ও উৎপাদনশীল হয়ে উঠবে। এ ছাড়া আর্থিক সচ্ছলতা ও দীর্ঘায়ু লাভের একটা যোগসূত্র তৈরি হবে।
কার্লোস হেলু কিন্তু কাজবিরোধী নন, বরং দৈনিক শ্রমঘণ্টা আটের পরিবর্তে ১১ করার পক্ষপাতী তিনি। এমনকি অবসরের বয়সসীমারও বিরোধী তিনি। তার মতে, আমাদের ৭০-৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করা উচিত। সপ্তাহে তিন দিন, দৈনিক ১১ ঘণ্টা।
কার্লোস হেলু বলেই শেষ করেননি, নিজের কোম্পানিতে এ তত্ত্ব বাস্তবায়নও করেছেন। তার সব কোম্পানিতে সাপ্তাহিক কর্মদিবস চার দিন, তিন দিন সাপ্তাহিক ছুটি। তার বয়স এখন ৭৪ বছর। এখনো কাজ করেন তিনি। তার সম্পদের পরিমাণ আট হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
কার্লোস হেলুর তত্ত্বই চূড়ান্ত সত্য, এমনটি নয়। দেশ-কাল-পাত্রভেদে এর অদলবদল থাকবেই। কিন্তু এ তত্ত্বের পেছনে যে সারসত্যটি দীপ্যমান, তা হলো মানুষের জীবনে কাজের পাশাপাশি চাই অবসর অর্থাৎ ছুটিও। কাজ তো করতেই হবে, এর মাঝেই মানুষ যেন হঠাৎ-হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠতে পারে, সমস্বরে অথবা আপন মনে ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’
মানুষ আনন্দের পুত্র। মানুষ কাজ করবে, মানুষ ছুটি ভোগ করবে। ছুটিকে কেউ বলবে না ‘ছুটির ফাঁদ’। এমনই তো হওয়া উচিত। তাই নয় কি?
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী: বার্তা সম্পাদক, অর্থনীতি প্রতিদিন
humayunsc@yahoo.com

২ thoughts on “ছুটি কি ফাঁদ ?

  • সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫ at ১২:২৮ অপরাহ্ণ
    Permalink

    প্রতিটি বিভাগের নিচে নতুন সাব টা্ইটেল খুলতে পারছি তবে নতুন বিভাগ খুলতে পারছি না।

  • সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫ at ১২:২৮ অপরাহ্ণ
    Permalink

    প্রতিটি বিভাগের নিচে নতুন সাব টা্ইটেল খুলতে পারছি তবে নতুন বিভাগ খুলতে পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.