ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ প্রকল্প চূড়ান্ত

ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি রেল সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। এজন্য নির্মাণ করা হবে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ। দুই দফায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২১১ কোটি টাকার বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলওয়ের সমাপ্ত বা পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ব্রড গেজ রেলপথ দুই ভাগে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করে অস্ট্রেলিয়ার স্ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল ও কানাডার ক্যানারেইল। এতে অর্থায়ন করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

সে সময় ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা। আর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ৭৯ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার অংশের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৬২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ২৫ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও রেলপথ নির্মাণসহ সব ধরনের ব্যয় এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তবে অর্থায়ন না পাওয়ায় চীনের সহায়তায় দুটি অংশ একই সঙ্গে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। গত বছর জি-টু-জি ভিত্তিতে রেলপথটি নির্মাণে সম্মত হয় চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি)। এক্ষেত্রে শুধু রেলপথ নির্মাণেই ব্যয় হবে ৩১৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার বা ২৫ হাজার ১১০ কোটি টাকা। বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় এ অর্থ দেবে চায়না এক্সিম ব্যাংক। আর জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে ব্যয় হবে ৯ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এ অর্থ সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করতে হবে। সব মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।সূত্র: বণিক বার্তা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে এর আগেও ৪ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। ২০১৪ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের সময় ১২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছিল এডিবি। তবে গত বছর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করার সময় তা ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা করা হয়। অর্থাৎ দুই দফায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু রেলপথ নির্মাণেই ৬২৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার বা ৫০ হাজার ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করেছিল সিআরইসি। গত অক্টোবরে এ প্রস্তাব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর পর আলোচনার ভিত্তিতে রেলপথ নির্মাণ ব্যয় অর্ধেকে (৩১৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার) নামিয়ে আনা হয়। এছাড়া রেলওয়ের অন্যান্য প্রকল্পের ব্যয় এ প্রকল্পের কাছাকাছি রয়েছে।

এ যুক্তি সঠিক নয় বলে মনে করেন রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অন্যান্য প্রকল্পের ব্যয়ের তুলনায় ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। এর মধ্যে খুলনা-মংলা ৮৬ কিলোমিটার ব্রড গেজ রেলপথ শিগগিরই নির্মাণ শুরুর কথা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৪৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

শুধু ব্রড গেজ নয়, ডুয়াল গেজের চেয়েও ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় বেশি। শিগগিরই শুরু হতে যাওয়া আখাউড়া-লাকসাম ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় ১৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সাধারণ রেলপথ নির্মাণ ব্যয় কিলোমিটারপ্রতি ১২-১৭ কোটি টাকা। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারতের রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে (হোয়াইট পেপার) এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, আগামী কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৫৪টি নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ১৭ হাজার ১০৫ কিলোমিটার। এতে ব্যয় হবে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪৮ কোটি রুপি। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ১০ কোটি ১৪ লাখ রুপি বা প্রায় ১২ কোটি টাকা। এছাড়া ভারতের মুম্বাই শহর থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত ৫৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ১১৮ কোটি টাকা।

পাকিস্তানে সাধারণ রেলপথ নির্মাণ ব্যয় কিলোমিটারপ্রতি ১২-১৫ কোটি টাকা। দেশটি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে খানেওয়াল থেকে রায়ওয়েন্ড পর্যন্ত ২৪৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করে। এতে ব্যয় করা হয় ৪ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপি বা ৩ হাজার কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। দেশটির পরিকল্পনা কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এদিকে সাম্প্রতিক কালে সাধারণ রেলপথ নির্মাণ করছে না চীন। দেশটির প্রায় পুরোটাই হাইস্পিড রেলপথ। ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতির হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে চীন গড়ে ব্যয় করছে ৭৩-৭৫ কোটি টাকা। গত বছর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, দেশটি ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতির ট্রেন চালানোয় রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় করছে দেড়-দুই কোটি ডলার। আর ২০০ কিলোমিটার গতির ট্রেন লাইন নির্মাণে ব্যয় করা হয় গড়ে ৯০-৯২ লাখ ডলার বা ৭৩-৭৫ কোটি টাকা।

ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ২১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) সাগরকৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে ১ হাজার ৯০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া রেলপথের ২৭ কিলোমিটার এলিভেটেড (উড়ালপথে) হবে। এজন্যও ব্যয় কিছুটা বেশি হচ্ছে।

তবে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ বাদ দিলেও এ প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ১৫৫ কোটি টাকা। এটিও রেলের যেকোনো প্রকল্পের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়েও অনেক বেশি।

সূত্র জানায়, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণ ব্যয় নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও প্রশ্ন ওঠে। গতকাল রেল ভবনে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্তাবটি তৃতীয় কোনো ক্রয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়নের প্রস্তাব দেন বুয়েটের প্রাক্তন অধ্যাপক ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। একই ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম। এক্ষেত্রে কর্ণফুলী টানেলের উদাহরণও তুলে ধরেন তিনি। তবে বৈঠকে এর বিরোধিতা করেন রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা। পরবর্তীতে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, সিআরইসি যদি ৬২৬ কোটি ডলারের প্রস্তাব ৩১৩ কোটি ডলারে করতে রাজি হয়, তবে তা আরো কমানো গেল না কেন, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই রেলওয়ে যে মূল্যায়ন করেছে, তা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই করে নেয়া উচিত। এতে রেলওয়ে নিজেদের দিক থেকে পরিষ্কার থাকবে। পাশাপাশি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতেও এর অনুমোদন সহজ হবে। ভবিষ্যতে প্রকল্প ব্যয় যাতে না বাড়ে, সেজন্য সময়মতো নির্মাণকাজ শেষ করার পরামর্শ দেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.