তিনিই সাহসিকা…
মিডিয়ায় পরিচিত হবেন, এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল না, তবে ছোট্ট একটি ঘটনা দারুণ অনুঘটক হয়ে কাজ করেছে তার জীবনে। একসময় পুরোপুরি মিডিয়ার মানুষ বনে যান। পরবর্তীতে আমরা শায়লা সিমিকে আবিষ্কার করি রেডিও জকি, অভিনেত্রী, উপস্থাপক কিংবা লেখক হিসেবে
এখন যেমন হরহামেশা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়, দুই দশক আগের প্রেক্ষাপটটি তেমন ছিল না। বলা যায়, সূচনা পর্বের সাহসিকা হয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার শুরুটা তার হাত ধরে।
১৯৯৭ সাল, মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আয়েশি সময় পার করছেন, অবসরের ব্যস্ততা বলতে একমাত্র ছাত্রীটিকে পড়ানো। এমন সময় ‘তিব্বত মিস রূপসী বাংলাদেশ ১৯৯৮’ নামে একটি সুন্দরী প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হলে, ওই ছাত্রীর মা শায়লা সিমির হয়ে কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে দেন আয়োজক বরাবর।
সে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগের পাশাপাশি দেশের বাইরে বসবাসরত বাঙালি মেয়েরাও অংশ নিয়েছিল। মিস বাংলাদেশ হতে সিমিকে লড়তে হয় মোট ৫০০ অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে।
সিমি বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় পুরোটা সময় আমি ভীষণ ক্যাজুয়াল ছিলাম। মনে হয়েছিল এখান থেকে অনেক কিছু জানার আছে আমার। আর ওটা ছিল বাড়ি থেকে বাইরে কোথায় প্রতিযোগীদের মধ্যে থাকা। জীবনকে অন্যভাবে দেখা। সময়টাকে আমি দারুণ উপভোগ করেছি।’
তিনি আরো জানান, প্রথমবার এমন আয়োজন তাই আয়োজকরা আন্তর্জাতিক স্টাইলকেই অনুসরণ করেছিল। মাসব্যাপী গ্রুমিং, পারফরম্যান্সের ওপর পয়েন্টিং, ট্যালেন্ট রাউন্ড— এমনভাবে এগিয়ে যায় প্রতিযোগিতাটি। অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, নিমা রহমান, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারসহ জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ১৯৯৮ সালের ৩০ মার্চ— চূড়ান্ত আসরে সেরা হিসেবে সিমির নাম উচ্চারিত হলে তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন।
মিডিয়াতে পরিচিতি হবেন, এমন কোনো আগাম আকাঙ্ক্ষা ছিল না, তবে সেদিনের ওই ছোট ঘটনাটি দারুণ এক অনুঘটক হয়ে কাজ করেছে তার জীবনে। একসময় পুরোপুরি মিডিয়ার মানুষ বনে যান। পরবর্তীতে আমরা তাকে আবিষ্কার করি রেডিও জকি, অভিনেত্রী কিংবা উপস্থাপিকা হিসেবে। যদিও সিমিকে এমন রূপে দেখতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কিছু বছর।
কারণ প্রতিযোগিতাটি নিয়ে যখন খবরের কাগজগুলোতে বড় করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়, তখন বিচ্ছিন্ন কিছু গোষ্ঠীর উসকানিতে ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’ আয়োজনকে খানিকটা নেতিবাচকভাবে প্রচার করা হয়। ফলাফল, পরের বছর প্রতিযোগিতাটি আর আয়োজিত হয়নি। তবে তার উত্তরসূরি হিসেবে আমরা পেয়েছি হাল আমলের সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলোকে।
বিচ্ছিন্ন সেই ঘটনার সূত্র ধরে সে সময় আর মিডিয়াতে কাজ করা হয়নি শায়লা সিমির বরং তিনি মনোযোগী হন পড়াশোনা নিয়ে। লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে গ্র্যাজুয়েশন করেন। এর পর ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান, লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্সের পাশাপাশি একটি ব্যাংকেও চাকরি করেছেন।
সাবলীল ভঙ্গি আর সুন্দর করে কথা বলাটা সিমির সহজাত গুণ। ২০০৭ সালে দেশে আসেন কয়েক বছরের জন্য, তখন কেবল শুরু হচ্ছে রেডিও টুডে। সেখানে আরজে হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাকে দেখা যায় আরটিভিতে তারকালাপ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে। সিমি আগ্রহ দেখালে টিভি চ্যানেলটি কোনো ইন্টারভিউ ছাড়াই তাকে নিয়ে নেয়। সিমির কর্মক্ষেত্রের তালিকাটা বেশ লম্বা, বিটিভিতে উপস্থাপক, গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘রুপালি পর্দায় সোনালি দিনের গান’ নামে একটি অনুষ্ঠান। এছাড়া এনটিভি, আরটিভি, একুশে টিভির পাশাপাশি বৈশাখী টিভিতে সহকারী নির্দেশক হিসেবেও দায়িত্বরত ছিলেন। টিভি নাটক ‘রাতের গল্প’, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘কাইট’সহ বেশকিছু নাটকেও হাজির হয়েছেন তিনি।
২০০৯ সালের আবার লন্ডনে পাড়ি জমান। লন্ডনভিত্তিক টিভি চ্যানেল এসটিভি ইউকে কিংবা বাংলা টিভি ইউকেতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পাশাপাশি নির্দেশক ও প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। লন্ডনভিত্তিক রেডিও চ্যানেল বিবিসি বাংলা ওয়ার্ল্ড রেডিও কিংবা কমিউনিটি রেডিও বেতার বাংলা এফএম ১৫০৩এএমেও কাজ করাসহ লন্ডনের পোয়েট্রি ক্যাফে আর সৌধ নামে কবিতা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন তিনি।
মাসখানেক হলো দেশে ফিরেছেন, এবারের ফেরাটা ঘুরেফিরে চলে যাওয়া নয়, ঢাকাতেই পাকাপাকিভাবে থাকবেন তিনি। আর এখানে স্থায়ী হওয়ার অন্য কারণটি হচ্ছে, বনানীতে অটিজম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। পরিকল্পনার অনেকখানি এরই মধ্যে এগিয়ে নিয়েছেন, আসছে এপ্রিল কিংবা মে থেকে শুরু হতে যাচ্ছে স্পার্ক নামে এ গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ও স্কুলের কার্যক্রম। এখানে অটিস্টিক শিশুদের দেখভালের পাশাপাশি মা-বাবা এবং ওদের যারা দেখাশোনা করেন তাদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। লন্ডনে থাকা অবস্থায় অটিজম নিয়ে কোর্স করেন সিমি। আমাদের সমাজের স্পেশাল চাইল্ড যারা, তাদের নিয়ে সিমির কাজের আগ্রহটা বোধহয় সেই থেকে।
এত এত পারদর্শিতা যে মানুষটির, তার শৈশবের দিনগুলো ছিল বৈচিত্র্যময়। মা-বাবা দুজনই সরকারি চাকুরে বলে সিমির শৈশব আর কৈশোরের গল্পরা ভীষণ বর্ণিল। ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাতে থাকা হয়েছে তার। শৈশব-কৈশোরের সেই যাপনগুলো সিমির মানস আর সৃষ্টিশীলতা সমৃদ্ধ করেছে। দেখার চোখ কিংবা ভিন্নভাবে বোঝাপড়ার মননটা যেন এভাবেই। একুশের বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কবিতার বই ‘প্রভু সমগ্র’।
বই সম্পর্কে জানতে চাইলে সিমি বলেন, ‘লেখার নামে, পাঠের নামে, ব্যক্ত হয়ে আছে, সবকিছুই তন্ত্র এবং মন্ত্রের মিলনটাকে সহজ করে দেয়। আধ্যাত্মিক কবিতা সামান্য কিছুটা আলাদা আধুনিক কবিতা থেকে, জীবনবোধের এক দার্শনিক বাখ্যা! আধ্যাত্মিক কবিতা রচনার এক দুর্দান্ত উপায় ও সম্প্রসারিত পদ্য শৈলী লক্ষণীয় এ বইয়ে। অখণ্ড মনোযোগ না হলে বাক্য থেকে অর্থ ধরা মুশকিল হবে।’বণিক বার্তা।