দখল-দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী ও হালদা

দখল-দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের খরস্রোতা নদী কর্ণফুলী ও প্রাকৃতিক মত্স্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। বছর বছর নদী দুটির উভয় পাড়ে দখল ও দূষণের মাত্রা বেড়েছে। গত কয়েক বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের ভূমি দখল ও শিল্প বর্জ্যের দূষণে মৃতপ্রায় দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নদী।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ‘নদীর সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত গঠিত কমিটি’র প্রতিবেদনেও নদী দুটির এমন চিত্র উঠে এসেছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ব্যক্তি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ মোট দখলদারের সংখ্যা ২ হাজার ১৭২। তবে কর্ণফুলী নদীর বড় অংশ দখল করেছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী নদীর তীরে বিভিন্ন কারখানা, কনটেইনার ডিপো, ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে এই ১৫৮ একর ভূমির মূল্য ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ কে খাঁন অ্যান্ড কোং দশমিক ১৪ একর ও ইন কনটেন্ট টার্মিনাল (কনটেইনার টার্মিনাল ও কার্যালয়) তিন একর জমিতে কনটেইনার ডিপো নির্মাণ করেছে। মাঝির ঘাট স্ট্যান্ড রোড এলাকায় কর্ণফুলী স্লিপওয়ে অ্যান্ড ডকইয়ার্ড দশমিক ৫২ একর, একই এলাকায় মেসার্স ইউরো শিপিং দশমিক ১২ একর, আনোয়ারা অ্যাপারেলস দশমিক শূন্য ৯ একর, বাংলাদেশ রাইস মিল দশমিক শূন্য ৬ একর, বেঙ্গল আসাম রাইস মিল দশমিক শূন্য ৫৯ একর, দাদা সল্ট দশমিক শূন্য একর, কন্টিনেন্টাল এজেন্সিস দশমিক শূন্য ৭ একর, রাসেল অ্যান্ড ব্রাদার্স দশমিক শূন্য ৬ একর, মেসার্স আরেফা ট্রেডার্স দশমিক ৩৬ একর, বিএ অ্যান্ড ব্রাদার্স দশমিক ২১ একর, বিকন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস দশমিক শূন্য ৭ একর, আবদুস ছালাম অ্যান্ড ব্রাদার্স দশমিক শূন্য ৩ একর নদী তীর দখল করেছে। কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৬টি শিল্প-কারখানা।
মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে নদী দখলদারদের মধ্যে আব্দুন নবী দোভাস দশমিক ১১ একর, বজলুর করিম দশমিক শূন্য ২৪ একর, মমতাজুল ইসলাম দশমিক শূন্য ৫ একর, গণি মিয়া দশমিক শূন্য ৬ একর, মো. সুজন দশমিক ২৭ একর, পেয়ার আহমেদ দশমিক শূন্য ৮ একর, নজু মিয়া ওয়াকফ এস্টেট দশমিক শূন্য ৭ একর, ইউনুছ মিয়া দশমিক শূন্য ৪ একর, আব্দুর নুর চৌধুরী গং দশমিক শূন্য ১৯ একর, জানে আলম দশমিক শূন্য ২৯ একর ভূমি দখল করেছে। এছাড়া কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিভিন্নভাবে প্রায় ২৫ একর কর্ণফুলীর তীর দখল করে রেখেছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলীর তীর দেশের অর্থনীতির প্রাণ। অথচ ২ হাজার ১৭২ জন অবৈধ দখলদার এ নদীকে দুই তীর থেকে এক প্রকার গিলে ফেলেছে। দখল ও দূষণের এই অবস্থা থাকলে এ নদীকে ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও নদী গবেষক মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, ২০০৯ সালে হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ জোয়ারের সময় পানির উপরের লেভেল থেকে ৫০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর সীমানা। সেই হিসেবে বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে অবৈধ দখলদাররা। কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েও অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলছে এ ৫০ মিটার সীমানার মধ্যে।
কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চ আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলী নদীর সীমানা নির্ধারণে মাঠপর্যায়ে জরিপ চালানো হয়। রায়ে উল্লেখ রয়েছে— সর্বোচ্চ জোয়ারের সময় পানির উপরের লেভেল থেকে ৫০ মিটার হচ্ছে কর্ণফুলীর সীমানা। কমিটি সরেজমিন অনুসন্ধান করে ২ হাজার ১৭২ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে। তাদের তৈরি অবৈধ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে— সেমিপাকা ঘর, বস্তিঘর, মার্কেট, দালান, মত্স্য প্রকল্প, খামার, গোডাউন, কারখানা, কনটেইনার ডিপো, ইয়ার্ড ও গার্মেন্টসসহ অন্যান্য স্থাপনা। দখলদারের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর ব্যক্তিরাও রয়েছেন। এসব দখলদার কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।
২০১২ সালের এক জরিপ থেকে জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর গড় গভীরতা ছিল ৩ থেকে ২২ মিটার। বন্দর এলাকায় গভীরতা ছিল ১১ থেকে ২২ মিটার। গঠনের দিক থেকে দেশের অন্যান্য নদীর চেয়ে ভিন্নতর হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর কোথাও কোথাও ৩৫ দশমিক শূন্য ৫ ডিগ্রি আনুভূমিক তল রয়েছে। এটি এমনভাবে খাড়া যে, জোয়ারের পানি কোনোভাবেই উজানে ২০ কিলোমিটারের বেশি অতিক্রম করতে পারে না। ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা পলিমাটি ক্রমে নদীর নাব্যতা কমিয়ে ফেলছে। একই সঙ্গে কালুরঘাট থেকে নদীর মোহনা পর্যন্ত থাকা ২০টি ডুব চর হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে এ নদীর জন্য।
বন্দরের হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের তথ্যমতে, ১৯৮৯-৯০ সালে ব্রিজঘাট এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল ৮৭০ মিটার। একই জায়গায় ২০০৯-১০ সালের জরিপে প্রস্থ কমে দাঁড়ায় ৬০০ মিটার। ১৯৯০ সালে চাক্তাই খালের মুখ এলাকায় প্রস্থ ছিল ৬৫০ মিটার। ২০১১ সালে তা হয় ৬০০ মিটার। গত ২৫ বছরে স্থানভেদে নদীর প্রশস্ততা কমেছে ৫০ থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত।
শুধু কর্ণফুলীই নয়, দূষণ ও ভরাটে বিপর্যস্ত উপমহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মত্স্য প্রজনন কেন্দ্র হালদাসহ চট্টগ্রামের সাঙ্গু ও ইছামতি নদী। ৫৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ চার নদী বাঁচাতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ অত্যন্ত অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্যমতে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের নদীগুলো রক্ষায় গত বছরের ২৩ জুন জেলা প্রশাসনের কাছে চট্টগ্রামের চার নদীর সামগ্রিক তথ্য চায়। নদীগুলো হলো— ১৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কর্ণফুলী, ৮৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের হালদা, ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইছামতি এবং ২৯৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সাঙ্গু। পরে জেলা প্রশাসন চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর, বন্দর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস আগ্রাবাদ ও সদর সার্কেলকে সংশ্লিষ্ট নদীর নিজ নিজ অংশের এসব তথ্য জানানোর জন্য চিঠি দেন। জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটির তথ্যেও কর্ণফুলী ও হালদার দখল-দূষণের কথা উঠে আসে।
জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে হালদা নদীতে ১২টির বেশি বাঁক কেটে ফেলেছে স্থানীয়রা। এর মধ্যে ভাটিতে নয়টি ও উজানে তিনটি বাঁক আছে। বাঁকের কারণে হালদা নদীর দৈর্ঘ্য কমেছে ২৫ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে হাটহাজারীর শিকারপুর ও মাদার্শা ইউনিয়নের সাতটি খাল হয়ে শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে এ নদীতে। তাছাড়া হালদা নদীর দুই পাশে আছে বড় আকারের বিস্তৃত দুটি বিল। এখানে বছরে দুবার ফসল উত্পাদন হয়। এর সঙ্গে আছে প্রায় ১৫টি বড় বাণিজ্যিক চা বাগান। এসব চা বাগানে ব্যবহার করা হয় প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক। কীটনাশক পানির সঙ্গে মিশে পড়ে হালদা নদীতে। পাশাপাশি ভরাট ও দূষণের কবল থেকে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ইছামতি ও সাঙ্গু নদীও রেহাই পাচ্ছে না বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রধান কাজই নদী দূষণরোধ, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ এবং নদীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি। চট্টগ্রামের চারটি নদীর তথ্য চাওয়া হয়েছিল। তবে সব তথ্য পাওয়া যায়নি। আগামী মাসে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।
নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিচ বলেন, চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নদী চারটির অবস্থা খুবই নাজুক। দখল-দূষণে বিপর্যস্ত অন্যতম নদী কর্ণফুলী। প্রতিনিয়ত নদীতে পড়ছে নগরীর ছোট-বড় প্রায় ৬০০ শিল্পকারখানার বর্জ্য। ভরাট হতে হতে ৭০০ মিটার প্রস্থের নদী এখন ৪০০ মিটারে এসে ঠেকেছে। রেহাই পাচ্ছে না উপমহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মত্স্যপ্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। দখল, ভরাট ও দূষণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে নদীটি। সৌজন্যে: বণিক বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.