দিতির ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়ে যেতো!

দেখার ক্ষমতা থাকলে অন্ধ হওয়ার অভিনয় করা কারও পক্ষে এতো সহজ নয়। যখন চোখের সামনে কিছু নড়াচড়া করবে, তখন সেদিকে না তাকিয়ে নিজের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা ধরনের মনোযোগ দরকার হয়। তাই ‘স্বামী-স্ত্রী’ ছবিতে অন্ধ চরিত্রে অভিনয় করে গর্বিত ছিলেন পারভীন সুলতানা দিতি। এ ছবির সুবাদে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন তিনি।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে চোখে সমস্যা দেখা দিলে (পরে জানা গেছে সেটা হয়েছিলো টিউমারের কারণে) দিতি ভয় পেতেন ভবিষ্যতে অন্ধ হয়ে যাবেন! অবাক করা ব্যাপার হলো, তার প্রতিটি আশঙ্কা সত্যি হতো! নিজের রোগ ছাড়াও অনেক ব্যাপারে জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেতো! ফেসবুকে এ কথা জানালেন দিতির কন্যা লামিয়া চৌধুরী। শুরু থেকেই মায়ের অসুস্থতার প্রতি মুহূর্তের খবর জানিয়েছেন তিনি। মায়ের মৃত্যুর পর গত ২৩ মার্চ সবার সঙ্গে কষ্ট ভাগাভাগি করেছেন এই তরুণী। মাকে স্মরণ করে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন লামিয়া। মায়ের অভিনীত ‘স্বামী-স্ত্রী’ ছবির ‘এ সুখের নেই কোন সীমানা’ গানের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। দিতির মস্তিষ্কে টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের পর জানা গেলো, তিনি একসময় দৃষ্টিশক্তি হারাবেন। কারণ টিউমারটি এমন জায়গায় হয়েছিলো, যা সরাসরি দৃষ্টিশক্তির সঙ্গে যুক্ত। মৃত্যুর আগে শেষ কয়েক মাস তার চোখ দুটো ছিল শুন্য ও নির্জীব। লামিয়া বললেন, ‘কিছু মুহূর্তে তার চোখ দুটোকে একটু-আধটু নড়তে দেখেছি, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই মনে হয়েছে তিনি আমাদের আর দেখতে পারছেন না।’ দিতির ভবিষ্যদ্বাণীগুলো প্রায়ই হেসে উড়িয়ে দিতেন লামিয়া। তিনি লিখেছেন, ‘এখন আমার মনে হচ্ছে, হয়তো তিনি ক্যান্সারের কথা আরও আগে থেকেই জানতেন। তিনি যেভাবে তার রোগ ও মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন, তা বোঝার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। তিনি কখনও কারও কাছে নিজের দুঃখ কিংবা ভয় প্রকাশ করেননি। সবার সঙ্গে হাসিমুখে আনন্দ নিয়ে দেখা করেছেন। তার এই ভয়ঙ্কর রকমের ইতিবাচক মনোভাব আমাকে বেশি অস্থির করে দিতো। আমি বুঝতে পারিনি কীভাবে এরকম একটি রোগের বর্বরতা কাউকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে।’ দিতিকে বলা হয়েছিলো ক্যান্সার রোগীদের জন্য রাখা বিশেষ কাউন্সিলরের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন কি-না। তিনি রাজি হন। কিন্তু নিজে না গিয়ে লামিয়াকে পাঠিয়েছিলেন কথা বলার জন্য। কারণ তার মনে হয়েছে তিনি ‘ঠিক’ আছেন। বরং মায়ের ক্যান্সারের কথা শোনার পর তা মেনে নিতে মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছিলো বলে সেইসব মানুষের সঙ্গে লামিয়ারই কথা বলা প্রয়োজন!

D2
অসুস্থতার সময় সবার ভালোবাসা পাওয়ায় লামিয়া ও পুত্রসন্তান দীপ্তকে দিতি বলতেন, ‘আমি যদি অসুস্থ না হতাম তাহলে তো কোনোদিন জানাই হতো না আমাকে কতো মানুষ ভালোবাসে। তোমরা যে আমার এতো ভালো সন্তান, এতো যুদ্ধ করতে জানো, আমি তো কোনোদিন ভাবি নাই। পৃথিবীতে ডাক্তাররা, নার্সরা এতো ভালো হতে পারে এটা তো কোনোদিন জানতাম না। এতো হাজার হাজার মানুষ যে আমার জন্য দোয়া করছে, এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। এখন আমার কোনো কিছু নিয়ে কোনো চিন্তা নাই, দুঃখ নাই। এখন শুধু আমরা ঘুরবো, মজার মজার খাবো আর ফ্যামিলি টাইম কাটাবো।’ বেশিরভাগ মায়ের মতো দিতি চাইতেন তার সন্তানরা সবকিছুতে সবসময় সেরা হবো। তিনি চাইতেন, লামিয়া নিজের খেয়াল রাখুক, ওজন কমিয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোক। তিনি প্রায়ই কল্পনা করতেন, ওজন কমালে মেয়েকে দেখতে কেমন লাগবে, লাল কামিজ পড়লে কেমন লাগবে কিংবা একদম উজ্জ্বল হলুদ পড়লে কেমন লাগবে… মাঝে মাঝে দিতি চোখ বন্ধ করে লামিয়াকে এভাবে কল্পনা করতেন। কল্পনায় তিনি দেখতেন মেয়ে সেই রঙ আর সেইরকম পোশাকগুলো পড়েছে। দিতি নাটকীয়ভাবে বলে ফেলতেন, লামিয়া যখন আসলেই ওজন কমাবেন এবং নারীসুলভ পোশাক পড়া শুরু করবেন, ততোদিনে তিনি অন্ধ হয়ে যাবেন! তার আর মেয়েকে ওইভাবে দেখা হবে না। এ কথা শুনে হাসতেন লামিয়া। এসব স্মৃতিচারণ করে লামিয়া ফেসবুকে মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘মা আমি যদি আসলেই কোনোদিন চিকন হয়ে লাল রঙের কামিজ পড়ি, আমি নিশ্চিত, অনেকদূর থেকে হলেও তুমি দেখতে পারবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.