দেশী উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ না করলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আসবে না

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৭-০৮) সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর। জন্ম ১৯৪১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাবনার সুজানগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতেও স্নাতকোত্তর করেন। পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রেরই বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬২ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি)। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘে যোগ দেন তিনি। চেয়ারম্যান ছিলেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের। রাজস্ব ঘাটতি, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে করণীয়, অর্থায়ন, সরকারি ঋণ বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব, ব্যাংক, বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো, বিনিয়োগ, শিল্প উৎকাদনে মন্দাবস্থা, টাকার অবমূল্যায়ন, শেয়ারবাজারসহ নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন এম এম মুসা

গত চার মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আহরণ হয়েছে। ফলে অনেক ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

চলতি অর্থবছরে রাজস্বের যে টার্গেট ধরা হয়েছে, সেটা অতিরঞ্জিত। সুতরাং এটা কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়। কাজেই আমি বিস্মিত নই যে, গত চার বছরে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট ছিল, সেখান থেকে পিছিয়ে আছে সরকার। এর সঙ্গে আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যেগুলো প্রাসঙ্গিক। এর মধ্যে অন্যতম হলো, আমদানি প্রবৃদ্ধি। আমাদের আমদানি প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এলসি সেটেলমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। আমদানি কমা মানে আমদানি শুল্কও কমে যাওয়া। যদিও আমাদের সার্বিক রাজস্ব প্রবৃদ্ধির আনুপাতিক হারে এর গুরুত্ব কিছুটা কমেছে, তবে এখনো আমদানির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

দুই. আয়কর। এর একটা বড় অংশ আসে করপোরেট আয়কর হিসেবে। সেক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে— বিভিন্ন কোম্পানির, এমনকি ব্যাংকিং খাতে যে প্রফিট ডিক্লারেশন এসেছে, সেটা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। আবার ব্যাংকিং খাতে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণের যে প্রবাহ, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির স্টেটমেন্টে যে টার্গেট ছিল, তার চেয়ে কম। ব্যাংকগুলো মূলত মুনাফা অর্জন করে ঋণের মাধ্যমে। যেহেতু ঋণের চাহিদা কম, সেহেতু তারা ঋণ দিতে পারছে না। সম্প্রতি তারা সুদহারও কিছুটা কমিয়েছে। তা সত্ত্বেও ঋণের চাহিদা তেমন বাড়ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, করপোরেট করের উল্লেখযোগ্য অংশ আসে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু এখন তা তুলনামূলক কম আসছে। সুতরাং রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হারে না আসার এটাও একটা কারণ। আর দেশে বিদ্যমান যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সেটা তেমন সন্তোষজনক নয়। আগেই আমি উল্লেখ করেছি যে, বেসরকারি ঋণের প্রবাহ শ্লথ। তার মানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎকাদন কম হচ্ছে। দ্বিতীয়ত. রেমিট্যান্স— যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। দেখা যাচ্ছে, এ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়পর্বে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (মাইনাস ০.১৬) হয়েছে। এবং রফতানি খাতে জুলাই-সেপ্টেম্বরে রফতানি কিছুটা কম ছিল, জুলাই-অক্টোবরে কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু মোট রফতানি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশেরও কম; বছরজুড়ে টার্গেট ছিল ১০ শতাংশ। কাজেই এগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। তার মানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়েছে এবং সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ হলে ভ্যাট আহরণও কম হবে। কারণ উৎকাদন হলে ভ্যালু এডিশন যা হয়, তার ওপর কর ধার্য করা হয়। যদি উৎকাদন কম হয়, ভ্যালু এডিশনও কম হবে, কর আহরণও কম হবে। আমাদের সার্বিক রাজস্ব আহরণে ভ্যাট এখন বড় ভূমিকা পালন করে। সুতরাং এসব কারণে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলে আমাদের উপায় কী?

একটা উপায় হতে পারে, ব্যয়ের মাত্রা কমানো। সাধারণত দেখা যায়, রাজস্ব ব্যয় (কারেন্ট এক্সপেন্ডিচার) কমানোর খুব একটা সুযোগ থাকে না। কারণ রাজস্ব ব্যয়ের বড় উপাদান বেতন ও মজুরি। তার পর আছে অবসর ভাতা। আবার রয়েছে আগে নেয়া সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ। সুতরাং এগুলো কমানোর কোনো সুযোগ নেই। বরং বেতনের দিক থেকে ব্যয় বেশি হবে। কেননা সরকার বেতন বাড়িয়েছে। আরেকটি বড় খাত— ভর্তুকি। রাজনৈতিক কারণে সরকার এটাও খুব একটা কমাতে পারে না। কাজেই রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংকোচনের সুযোগ খুবই কম। আর এর চাপটা পড়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ওপর। সেটা এমনিতেই কম থাকে, এ বছর হয়তো আরো কম হবে। এডিপির ব্যয় কম হলে তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ এডিপির একটা বড় অংশ যায় অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে, যেগুলো মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করতে অত্যাবশ্যকীয়। অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে এসব খাতে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। কাজেই এডিপি বড় মাত্রায় কাটছাঁট করতে হবে। অন্যথায় আমাদের বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাবে।

বাজেট ঘাটতি বাড়লে অর্থায়ন কীভাবে হবে?

অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেখতে হবে বহির্বিশ্ব থেকে আমরা কী সাহায্য পাচ্ছি। সেখানে দেখতে পাচ্ছি, অর্থছাড় এবার খুব কম হয়েছে। সরকারের টার্গেটের চেয়ে অনেক কম। এর পর থাকে অভ্যন্তরীণ উত্স। অভ্যন্তরীণ ঋণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক কিছু প্রভাব আছে। এমনিতেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কম, সেখানে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিলে এ প্রবাহ আরো কমে যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ঋণের সিংহভাগ আসছে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সেখানে সুদও অনেক বেশি। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাজেটের যে প্রভিশন ছিল সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার, তার প্রায় তিন গুণ বেশি নেয়া হয়েছে এবং এ বছরেও এখন পর্যন্ত যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হয় একই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকবে। এই জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকার এরই মধ্যে প্রায় ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে। গত বছর যা একটু বেশি ছিল (৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা)। অর্থাত্ এ বছরও দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত গিয়ে বাজেটের যে প্রভিশন আছে, হয়তো তার আড়াই-তিন গুণ বেশি ঋণ নেয়া হবে। ফলে সুদের দায় আরো বেড়ে যাবে। সুদ পরিশোধে সরকারের আইনত বাধ্যবাধকতা থাকায় অন্য খাতে ব্যয়ের সুযোগ কমে যাবে। কাজেই চলতি বছরের বাজেট ব্যবস্থাপনায় সরকার বেশকিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

মাথাপিছু সরকারি ঋণ আগের তুলনায় চার গুণ বেড়েছে। সে হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। এতে কি কোনো প্রভাব পড়বে?

আগেই উল্লেখ করেছি, ঋণের প্রবৃদ্ধিটা মূলত এসেছে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে। কারণ আমরা বাইরে থেকে যে ঋণ পাই, সেগুলো সুদহার খুবই কম। এখনো বিশ্বব্যাংকসহ অন্য বহুপক্ষীয় দাতাগোষ্ঠীর সুদের হার ১ শতাংশ বা তারও নিচে। পরিশোধের সময় ৩০-৪০ বছর। সার্বিকভাবে বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে ডেট সার্ভিসিং লায়াবিলিটি এখনো আমাদের রফতানি আয়ের ৫ শতাংশের নিচে এবং সেটা ১০ শতাংশে উন্নীত হলেও কোনো দেশের জন্য অস্বস্তিদায়ক নয়। কাজেই বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে খুব একটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করি না। তবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেয়া হচ্ছে, সেটা ভবিষ্যতে বাজেটের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনুত্সাহে সরকার সুদের হারও কমিয়েছে। তবুও এর বিক্রি বাড়ছে…

এখানে সুদের হার কিছুটা কমিয়েছে বটে, একই সঙ্গে ব্যাংকের সুদের হার কমানো হয়েছে। সুতরাং ব্যাংকে যে আমানত প্রবৃদ্ধি, সেটাও কম। কারণ সেখানে লোকে কম সুদ পাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বন্দি অবস্থায় ধার করছে। এটাকে বলি ক্যাপটিভ বরোয়ার। এখানে বাজেটের যে প্রভিশন, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। দেখা যাচ্ছে, যে-ই কিনতে চাইছে, তার কাছেই সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে আমার মত হলো, সরকার একটা সিলিং নির্ধারণ করে দিতে পারে। কিন্তু সে ধরনের কোনো নীতি দেখি না আমাদের দেশে। যদিও সার্বিক ঋণ জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশ খুব একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নেই, তবু সুদের ব্যয় বৃদ্ধিটা বাজেট ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল মধ্যবিত্ত তথা অবসরভোগীরা কী করবে? মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সুদের হার আরো কমে গেলে তাদের অবস্থা কী হবে?

এখানে প্রথম কথা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির মাত্রা কমেছে। সুতরাং প্রকৃত সুদহার (অর্থাত্ সুদহার— মূল্যস্ফীতি) দেখলে দেখা যাবে, সেটা খুব বেশি কমেনি। ২ শতাংশের মতো কমানো হয়েছে সঞ্চয়পত্রে। কিন্তু মূল্যস্ফীতিও এক-দেড় শতাংশ কমেছে। ২০১৪ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল বার্ষিক হিসাবে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। ২০১৫ সালের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশে এবং অক্টোবরে আরো কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২ শতাংশে। কাজেই গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১ শতাংশের কিছু বেশি কমেছে। এতে কিছু ক্ষতি হয়েছে বটে, তবে সেটা বড় মাত্রার ক্ষতি নয়।

লোকে যদি দেখে যে, ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজে তাদের আয় কমে যাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই তারা সঞ্চিত অর্থ অন্যভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। কিছু লোকের অবশ্যই অসুবিধা হবে; যারা হয়তো শেয়ারবাজারে যেতে আগ্রহী নয় কিংবা কোনো বিজনেস ভেঞ্চারে যাওয়ার যাদের দক্ষতা নেই। সে হিসাবে কিছু লোকের অসুবিধা হবেই। সেক্ষেত্রে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা জালের আওতায় আনা যায় কিনা, সেটা চিন্তা করতে হবে।

অনেক দেশের তুলনায় আমাদের প্রকল্প ব্যয় অনেক বেশি। সেটা এত বেশি হয় কেন?

আমাদের প্রকল্প ব্যয় বেশি হওয়ার একটা কারণ, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ না হওয়া। এটা প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। দেখা যাচ্ছে, তিন বছরের একটি প্রকল্পে আলোচ্য সময় পর্যন্ত বেতন দিতে হয়, সেখানে মেয়াদ বাড়লে ওই সময়েও বেতন দিতে হয়। এছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে প্রয়োজনীয় রসদের দাম বাড়ে। আবার ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়ে। ফলে সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়।

এখন শিল্প উৎকাদনেও মন্দাবস্থা দেখা যাচ্ছে, যদিও গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি তেমন নেই। এটিকে কীভাবে দেখেন?

শিল্প উৎকাদনের ক্ষেত্রে এখনো গ্যাসের সংকট আছে এবং তা বেশ প্রকট। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অবশ্য বেশকিছু উন্নতি হয়েছে; যদিও সেটা ব্যয়বহুল কুইক রেন্টালের মাধ্যমে। কাজেই শিল্প উৎকাদনের ক্ষেত্রে জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাসের সমস্যা তো আছেই। এটি হলো একটি দিক। দ্বিতীয়ত. পরিবহন খাতের কোনো উন্নয়ন হয়নি। যেমন— ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ। এটা শেষ হওয়ার কথা তিন-চার বছরের আগে। এখনো হয়নি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেরও একই অবস্থা। পরিবহন খাতে খুব একটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং এসব বিষয় শিল্প উৎকাদন তথা ব্যবসাকে নিরুত্সাহিত করে। আরেকটি বিষয় আমার কাছে মনে হয়, রাজনৈতিক অঙ্গনের অনিশ্চয়তাও এর জন্য কিছুটা দায়ী। যদিও বর্তমানে অস্থিরতার মাত্রাটা কম; কিন্তু অনিশ্চয়তা বিদ্যমান— কখন কী হবে না হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে, তাতে লোকের মনে শঙ্কা ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। ফলে অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহী নয়।

একদিকে এবারের বাজেটে বিদেশী বিনিয়োগে জোর দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা দেশের পরিবর্তে বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাইছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

জাতিসংঘে কাজের সময় বিদেশী বিনিয়োগের ওপর ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েক বছর গবেষণা করি। গবেষণার মাধ্যমে আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, যে দেশে দেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন না, সে দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করেন না। কারণ কোনো দেশী বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করলে বিদেশীরা বুঝতে পারেন যে, সেখানে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিদ্যমান। সুতরাং তারা আগ্রহী হন। তাদের অন্য বিবেচনা আছে। তবে তাদের বড় বিবেচনা হলো, দেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন কিনা। আমাদের দেশে ২০০৫-০৬ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ জিডিপির আনুপাতিক হার হিসাবে ২১-২২ শতাংশে রয়ে গেছে। তার মানে দেশী বিনিয়োগের একটা স্থবিরতা আছে; সেটা অবকাঠামো-রাজনৈতিক-জ্বালানি সংকটে হোক বা অন্য কারণে হোক। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগ আসবেন, তা আশা করা বাতুলতা। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের রাডার স্ক্রিনে আছে এই অর্থে যে, চীন-ভিয়েতনাম-মালয়েশিয়ায় মজুরি বেড়ে যাওয়ায় সেখানে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা নতুন জায়গা খুঁজছেন। এজন্য বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল আসছে। কিন্তু তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমরা এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছি না।

স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা বাইরে বিনিয়োগে আগ্রহী, তাদের অনুমতি দেয়া যায় কিনা…

বেছে বেছে কিছু উদ্যোক্তাকে বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া যেতে পারে, যেহেতু দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। যার কাছে উদ্বৃত্ত অর্থ আছে, তিনি দেশে কিংবা বিদেশেও বিনিয়োগ করতে না পারলে তখন অবৈধ পন্থায় টাকা পাচার করবেন।  আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে অবৈধ পন্থায় প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। এজন্য কিছু উদ্যোক্তাকে বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। এতে দুটি সুবিধা। এক. জবাবদিহিতা থাকছে। অমুক লোক এত টাকা নিয়েছে— এটা সরকার জানতে পারছে। তার আয়ের উত্স সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। দুই. বিনিয়োগ প্রস্তাবটা লাভজনক হলে তা বাংলাদেশে আনতে পারছে। এতে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। তবে ঢালাওভাবে অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি।

রফতানি শ্লথ হওয়ার পেছনে অনেকেই চীনের মুদ্রা ও ইউরোর অবমূল্যায়নকে দায়ী করছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেক রফতানিকারক টাকার অবমূল্যায়ন করতে বলছেন। বিষয়টিকে  কীভাবে দেখেন?

আমি জানি যে, আমাদের রফতানিকারকদের অনেকেই টাকা অবমূল্যায়নের কথা বলছেন। যেমন— গার্মেন্টের বৃহত্ গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউরোর অবমূল্যায়ন হওয়ায় আমাদের রফতানি আয় কমেছে। এদিকে চীন আমাদের প্রতিযোগী। দেশটিও ইউয়ানের ২ শতাংশের মতো অবমূল্যায়ন করেছিল, কিন্তু পরে তা আবার বাড়িয়ে দেয়। সে হিসাবে খুব একটা পরিবর্তন নেই। সম্ভবত ভিয়েতনামও দেশটির মুদ্রার কিছুটা অবমূল্যায়ন করেছে। তবে এখানে দেখতে হবে, বিনিময় হার কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রফতানির ক্ষেত্রে। আমি কিন্তু রফতানির ক্ষেত্রে বিনিময় হারের খুব একটা ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি না। রফতানি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিনিময় হার সম্পর্কিত করলে তেমন প্রভাব দেখছি না। বরং আমি দেখতে পাচ্ছি, সাপ্লাই সাইডে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে  পণ্যের দাম কমাতে পারলে তাতে রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশি হয় (সেটা প্রাযুক্তিক উন্নয়ন বা উৎকাদন খরচ কমানো যেভাবেই হোক)। কাজেই বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন করলেই রফতানি বাড়বে, সেটা সঠিক নয়। তবে মোটামুটি স্থিতিশীল একটা বিনিময় হার থাকা উচিত, যাতে আমদানি কমার কারণে সৃষ্ট অতিমূল্যায়নের চাপটা মোকাবেলা করা যায়। আবার মূল্যস্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে প্রকৃত বিনিময় হারও স্থিতিশীল থাকবে বা হয়তো কিছুটা অবমূল্যায়িত হবে। সুতরাং আমি মনে করি, বিনিময় হারের বড় মাত্রায় অবমূল্যায়নের দরকার নেই।

আমরা যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলাম, সেক্ষেত্রে স্বল্পহারে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে তো চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এতে আগের ঋণের সুদও কি বেড়ে যাবে?

না। নতুন ঋণের ক্ষেত্রে যে সুদ ধার্য হবে, সেটাই পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু এখানে কিছু মানদণ্ড আছে। জাতিসংঘের সংজ্ঞানুযায়ী আমরা এখনো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় আছি। সুতরাং এই একটা সুবিধা আছে। ফলে আমাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আবার আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে গেলেও তেমন অসুবিধা হবে না। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো স্বল্পহারে ঋণ পাব না।  কাজেই এটা নিয়ে আমি তেমন উদ্বিগ্ন নই।

বিভিন্ন দেশ থেকে নেয়া আমাদের বায়ার্স ক্রেডিটে কেমন প্রভাব পড়বে?

আমি মনে করি, এটা সীমিত আকারে রাখা উচিত। বায়ার্স ক্রেডিট নেয়া উচিত নয়। কারণ আমাদের ঋণের বোঝাটা যেন না বাড়ে।

আমাদের শেয়ারবাজার কোন দিকে যাচ্ছে?

শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। আমার মনে হয়, উপরে আলোচিত সার্বিক অর্থনীতি এখানে কিছুটা প্রভাব ফেলছে। অনেকের হয়তো ধারণা আছে, সার্বিক অর্থনীতি গতিশীল নয়। সুতরাং কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা অর্জন করতে পারবে না। ফলে তারা ভালো ডিভিডেন্ড পাবে না। এজন্য তারা শেয়ার কিনতে আগ্রহী নয়। তাই আমাদের শেয়ারবাজারে চাহিদার একটা ঘাটতি আছে। এক্ষেত্রে আরো দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারের অন্যতম বড় স্টেকহোল্ডার ব্যাংকিং খাতের খাতওয়ারি প্রাইস আর্নিং রেশিও হলো ১০-এর নিচে। অথচ প্রাইস আর্নিং রেশিও ১৫ হলেও বিনিয়োগযোগ্য শেয়ার হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিছু ব্যাংকের আবার মুনাফা কমেছে, আবার এত কিছুর মধ্যে অনেকগুলোর বেড়েছেও। আমি মনে করি, মূলত সার্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যত্ নিয়ে মানুষের মনে যে উদ্বেগ, সেটাই একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে পারে শেয়ারবাজারের বর্তমান আস্থাহীনতার পেছনে।

অনেক দিন হয়ে গেলেও শেয়ারবাজারের যে আকার দিতে চাইছি, সেটা আমরা পারছি না। এখনো শেয়ারবাজার গুজবনির্ভর?

নানা রকম উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যেমন— ক্যাপিটাল মার্কেট ট্রেনিং সেন্টার আছে, সেখানে বিনিয়োগকারীদের বোঝানো হয়। স্টক এক্সচেঞ্জগুলো বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। তা সত্ত্বেও প্রতিটি শেয়ারবাজারে কিছুটা গুজব চলে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া উচিত নয়। দেখা যাচ্ছে, আমাদের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরে একটা নিম্নমাত্রার ভারসাম্যে (লো লেভেল ইকুলিব্রিয়াম) আটকে আছে। এখন পর্যন্ত যেসব শেয়ার আছে, সব মিলিয়ে অন্তত ছয়-সাড়ে ছয় হাজার পর্যন্ত সূচক হওয়া উচিত। কিন্তু সেখানে আমরা যেতে পারছি না; চার- সাড়ে চার হাজার সূচকে আটকে আছি। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি ভূমিকা আছে। তারা আরো সক্রিয় হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থা আসবে।

বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজার বিনিয়োগের একটা প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে করছে না কেন?

নতুন বিনিয়োগের কথা চিন্তা করলে প্রথমেই আসে আইপিও। আইপিওর ক্ষেত্রে আমাদের অসুবিধা হলো, নতুন আইপিও যেগুলো এসেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই স্বল্প মূলধনের এবং তাদের পাস্ট ট্র্যাক রেকর্ড নিয়েও কিছুটা প্রশ্ন আছে। আমি মনে করি, আইপিওর ক্ষেত্রে ভালো কোম্পানি কীভাবে আনা যায়, সেদিকে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এখানে বিএসইসির কিছুটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আছে। একদিকে শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি উত্সাহিত করার প্রয়োজন আছে, অন্যদিকে উত্সাহিত করতে গিয়ে স্ট্যান্ডার্ড নমনীয় করলে সেটা কিন্তু সঠিক হবে না। সুতরাং কিছুটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আছে। সেটা সত্ত্বেও এসইসির ভালো কোম্পানি আনার চেষ্টা করা উচিত।

শ্রুতিলিখন: হুমায়ুন কবির

সূত্র: বণিক বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.