নগরে বাউল কবি হেলাল হাফিজ

শুচি সৈয়দ |
প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে যার বসবাস সেই নগর বাউল কবি হেলাল হাফিজ। চির তরুণ, সজীব, প্রাণবন্ত এই বাউল ৭ অক্টোবর পা রাখবেন তাঁর । উনসত্তরতম জন্মদিনে। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ যিনি কবি, তার কবি হয়ে ওঠার পেছনে থাকে সকলের উপস্থিতি নীরবে-নিভৃতে, আর গহীন প্রদেশে। কবি সকলকে ধারণ করেই কবি। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সকলের স্বব, সকলের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, হওয়া না-হওয়ার বেদনার আর্তি। থাকে তার দেশ, থাকে তার নিজস্ব সময়। এসবই তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় সকলের কথা। এই সমগ্রকে ধারণ করেই কবি হয়ে ওঠেন তার কালের ঈশ্বর। কবিতা অর্জন করে ঐশ্বরিক আশীর্বাদ। একটি জাতির বিভিন্ন কালখণ্ডে তার কবিদের হাতে রচিত হয় অক্ষয় পঙ্ক্তিমালা যুগে যুগে যে পঙ্ক্তিমালা গৌরবে শনাক্ত করে সেই সব ইতিহাসকে তার হিরš§য় দ্যুতিতে। সে রকমই একটি আশ্চর্য অনুভূতিমাখা পঙ্ক্তিমালা যা এই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বজ্রবিদ্যুতের মতো সাহসে ঝলসে উঠেছিল নিরস্ত্র তরুণের বুকে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কালপর্বে ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ যেন এই পঙ্ক্তিমালাই আরও দার্ঢ্যে উচ্চারিত হয়েছিল ১৯৭১-এ বাংলার গৌরব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী কণ্ঠে ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের লাখো জনতার সমাবেশে- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ঐতিহাসিক পরিণতিতে। কবিতার স্ফূলিঙ্গ পরিণত হয় দাবানলে আর সেই দাবানল সমস্ত পঙ্কিলতাকে পুড়িয়ে সমস্ত খাদকে ছাই করে খাঁটি সোনা করে তোলে মানুষকে। কবিতা সেই স্বর্ণ সন্ধানের অভিযাত্রা। কবি সেই অভিযানের অভিযাত্রী।
নগর বাউল এই কবি হেলাল হাফিজ- যাকে তার মুগ্ধ পাঠকগোষ্ঠী শনাক্ত করেন প্রেমের কবি হিসেবে। এ দেশের তরুণ-তরুণীদের বুকের স্পন্দনে, আবৃত্তির কণ্ঠে যিনি বরিত প্রেমের পঙ্ক্তিমালার জন্য তার সেই পঙ্ক্তিসমূহের অন্তরে শুধু তারুণ্যের প্রেমেরই স্পন্দন নেই, আছে শাশ্বত মানব প্রেমের মমতাও। আর মানুষের প্রতি সেই শাশ্বত মমত্ব আছে বলেই অনায়াসে ব্যক্ত করেন নিজেকে, যে নিজের ভেতরে অবস্থিত সকলেÑ তিনি বলতে পারেন গভীর আস্থায়, ভালোবাসায়Ñ
‘কেউ ডাকেনি, তবু এলাম / বলতে এলাম ভালোবাসি।’
এভাবে ভালোবাসার কথা বলতে পারা সম্ভব প্রকৃত মানুষের পক্ষেই। ভালোবাসা কাউকে ভিখারি করে কাউকে রানী বানায়- এই বিনিময়ের বাইরে কাউকে মানুষ করে তোলে লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে। ব্যক্তি লাভ-ক্ষতির পাল্লায় যিনি নিজেকে তুলে দেননি, তেমনই কলুষ স্পর্শ করেনি তার কবিতাকেÑ এমনই এক দুর্লভ ব্যক্তিত্ব এই কবি বাউল।
বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের লাইব্রেরিতে তাঁকে বললাম, বলুন তিন বিষয়ে- বাংলাদেশ, বাংলাভাষা এবং বাঙালি সম্পর্কে।
পঁয়ষট্টি ছুঁই ছুঁই, তারুণ্যে ভরপুর প্রাণবন্ত কবি বললেন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে- আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস ভুল মানুষদের হাতে পড়ে গেছে। তার প্রথমটি হচ্ছেÑ রাজনীতি এবং দ্বিতীয়টিÑ ধর্ম। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দুটি জিনিসই প্রকৃত মানুষদের হাতে থাকা প্রয়োজন। কেননা এই দুটি বিষয়ই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও অকল্যাণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দেশের মানুষের সমস্ত দুর্ভোগের কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি ভুল মানুষদের হাতে থাকা। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এবং এ জন্য সমাজের প্রত্যেককেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকেÑ যে যে পেশায় আছেনÑ চিকিৎসক তার জায়গা থেকে, প্রকৌশলী তার অবস্থান থেকে, কবি-লেখক-সাংবাদিক তাদের অবস্থান থেকে, শ্রমিক-মজুর, আমলা-কর্মচারী সবারইÑ স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করতে হবেÑ যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি প্রকৃত মানুষ এবং যোগ্য মানুষের হাতে তুলে দেয়া যায়। দেখো, তোমরা সবাই জানো, আমি কোনো রাজনীতি করি না। নিজের মতো নিভৃত একাকী জীবনযাপন করি; কিন্তু রাজনীতি এমন একটা বিষয় যা প্রত্যেক মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। আমি নীরবে-নিভৃতে থাকা মানুষ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি রাজনীতি মুক্ত। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটিকে প্রকৃত মানুষ এবং সঠিক ও যোগ্য মানুষের হাতে তুলে দিতে না পারলে চলবে না।
বাংলাভাষা প্রসঙ্গে কবি হেলাল হাফিজ বললেন- পৃথিবীর কয়েকটি ভাষার মধ্যে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা বাংলা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমরা আÍোৎসর্গের একমাত্র উদাহরণ পৃথিবীতে এ যেমন গৌরবজনক সত্যি তেমনই সত্যি আমাদের এই ভাষাকে নিয়েও বর্তমানে চলছে বালখিল্য, ছেলেখেলা। এ ভাষায় সুন্দর করে লিখতে শেখা, বলতে শেখা, শুনতে শেখা কোনটাই আমরা যতœসহকারে করি না। আবার গ্লোবালাইজেশনের কারণে দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণী আÍসমর্পিত ইংরেজি ভাষার কাছে। তারা তাদের জীবন থেকে বাংলাকে বিদায় করে দিয়েছে। অমিত সম্ভাবনাময় বাংলা ভাষা চর্চা ও নির্মাণে আমাদের আন্তরিক এবং পরিশ্রমী হতে হবে। মান ভাষা বিনির্মাণের চেষ্টা করতে হবে। আঞ্চলিকতা থাকবে কিন্তু তার আধিপত্য গ্রহণযোগ্য নয়। শুদ্ধ ভাষা চর্চা করতে হবে। একটি সমৃদ্ধ ভাষা, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। তাহলেই এই জাতি আÍত্যাগের অভিষেকে গৌরবান্বিত হবে। দাঁড়াবে। বাঙালি প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে এখন বাঙালির বসবাস। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধায়-মননে আমরা অগ্রসরমান। পৃথিবীর যে কোনো জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালির অভিযাত্রা। একুশ শতকে বাঙালির এই অভিযাত্রা আমাকে অভিভূত করে, করে খুব আশাবাদীও। বাঙালি অপাংক্তেয় নয় এই ধরণী পৃষ্ঠে। বাঙালির অগ্রগামিতার অর্থ মানবতারই অগ্রগতি।
এখন ফেসবুকে আপনাকে পাওয়া যাচ্ছে, প্রযুক্তি কি আপনার নিভৃতির দখল নিচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে জানালেন, সম্প্রতি ‘ফেসবুকে’ বসার অভ্যাস হয়েছে এ এক অন্য দিগন্ত। ফেসবুকে আমার অনেক পাঠক চ্যাট করেন আমার সঙ্গে। ফেসবুকের তরুণেরা প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করেন তোলেন আমাকে। যেমন সম্প্রতি এক পাঠক ফেসবুক-এ আমাকে নিয়ে এক আলোচনার সমাপ্তি টানেন এই সিদ্ধান্ত দিয়ে যে, ‘‘হেলাল হাফিজ এক নেশার নাম।’’ তরুণদের এইসব মূল্যায়ন, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাকে স্পর্শ করে, ভাবায়। আমি তাদের চিন্তাধারাকে বুঝবার এবং উপলব্ধি করবার চেষ্টা করি। আমি বিজ্ঞান বিমুখ নই, প্রযুক্তি বিদ্বেষী নই। প্রযুক্তি তো আমাদের জীবনে ঠাঁই করে নেবেই অনিবার্যভাবে।
নগরে বাউল এই কবি জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টো দিকের হোটেল কর্নফুলির ২০২ নম্বর কক্ষে পেতেছেন একার সংসার। তার দ্বিতীয় কাব্য শেষ করার জন্য। এখানে উঠে ১ লাইনের যে কবিতাটি লিখেছেন ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো!’ তাকে সেবায়, ভালোবাসায়, সমাদরে মুগ্ধ করে রেখেছে হোটেলটির কর্মীরা।
একুশ শতকের তরুণ প্রজš§ যে-কবিকে ‘নেশা’ বলে শনাক্ত করছেন সে-কবি মোটেই কোনো ‘নেশা’ নন। যে অর্থে নার্সিসিজমে আক্রান্ত র‌্যাবোঁ কিংবা বোদলেয়র তারুণ্যকে আÍ-পাঁকে নিমজ্জিত করেন, বুঁদ করেন; হেলাল হাফিজ সেই অর্থে নার্সিসিজমে ডুবিয়ে দেন না তার পাঠককে বরং পথ দেখান, দেন দিশাÑ ১৯৬৯-৭১-এ, ১৯৯০-এ, কিংবা এই ২০১৩-তে মুক্তিযুদ্ধে, গণতন্ত্রের সংগ্রামে এবং বিশ্বশান্তির আন্দোলনে তাঁর গভীরতর কবিসত্তা কবিতায় বাক্সময় হয়Ñ স্বদেশের মানুষের জন্য, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য। আর তাই নগরে যথার্থ বাউল এই কবি রাখালের বাঁশিতে সুর তুলে বলতে পারেন
‘কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন-
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।
(রাখালের বাঁশি)
কবি তিনি নেশার নন দিশার, জীবন অন্বেষার। শেষ করি তাঁরই জবানীতে, তাঁরই কাব্যপঙ্ক্তিতে-
‘আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে,
সংগোপনে বলেছে-‘হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাÍক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই।’
(যুগল জীবনী/কবিতা একাত্তর)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.