নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম: অবশেষে বৈদ্যুতিক রেলপথ চালুর উদ্যোগ
ইসমাইল আলী |
রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে বর্তমানে সময় লাগে ৬-৮ ঘণ্টা। তবে বৈদ্যুতিক রেলপথ চালু হলে একই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৩ ঘণ্টা। এক্ষেত্রে এক ট্রিপে বিদ্যুত্ খরচ হবে ১৫ মেগাওয়াট, আর কিলোমিটারপ্রতি খরচ পড়বে ৬ পয়সা। একই ধরনের ব্যবস্থায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। এ রুটে ২০ ট্রিপে বিদ্যুত্ খরচ হবে মাত্র ১০ মেগাওয়াট। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ দুই রুটে বৈদ্যুতিক রেলপথ (ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন) চালুতে অবশেষে উদ্যোগী হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
২০১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ২২ কিলোমিটার রেলপথ বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেয়া হলেও নানা কারণে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। বরং পরের বছরই বাতিল হয়ে যায় এ পরিকল্পনা। এমনকি রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যানেও রাখা হয়নি প্রকল্পটি। তবে সম্প্রতি অবস্থান পরিবর্তন করে সার্বিকভাবে সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক রেলের প্রতি ফের ঝুঁকছে রেলওয়ে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথটিকে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনে রূপান্তরে সম্ভাব্যতা যাচাই দ্রুতই শুরু হবে। এজন্য ৫৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রস্তাবটি অনুমোদনে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বৈদ্যুতিক রেলপথ নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম বিদ্যমান রেলপথকে ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। একই সঙ্গে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন করা হলে বাড়তি ব্যয় খুবই কম লাগবে। তাই সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হবে শিগগিরই। এর ভিত্তিতে চূড়ান্ত ব্যয় নিরূপণ করে বিনিয়োগ খোঁজা হবে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, বৈদ্যুতিক রেলপথে কোনো জ্বালানির প্রয়োজন হয় না, ট্রেন চলে বিদ্যুতে। ফলে বিদ্যমান ডিজেল ইঞ্জিনেরও প্রয়োজন নেই। রেলপথের ওপর দিয়ে স্থাপিত লাইন থেকে সঞ্চালিত বিদ্যুত্ দিয়েই চলে ইঞ্জিন, যেগুলো আকারে অনেক ছোট। এসব ইঞ্জিনের দামও অনেক কম, মাত্র ২ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে ব্যবহূত ইঞ্জিনের দাম গড়ে ২০ কোটি টাকা। অর্থাত্ একটি ডিজেল ইঞ্জিনের দামে কেনা যাবে ১০টি বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন। এছাড়া বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের মেরামত ব্যয়ও অনেক কম।
ডিজেল ইঞ্জিন বড় ধরনের মেরামতে (ওভারহলিং) যেখানে ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হয়, বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে তা হবে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা।
এদিকে বৈদ্যুতিক রেলপথের ভিত্তি (বেইজ) নির্মাণ করা হয় সিমেন্ট-পাথরে ঢালাই করে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আর সাধারণ মাটির ভিত্তির ওপর রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১৪-১৫ কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয় প্রায় সমান হলেও বৈদ্যুতিক রেলপথে পাথর লাগে অনেক কম। এছাড়া এর স্থায়িত্বও বেশি। ২০ বছরেও বড় কোনো মেরামতের প্রয়োজন হয় না। অথচ সাধারণ রেলপথের নিচের মাটি বৃষ্টিতে দেবে গিয়ে পাথর সরে যায়। ফলে নিয়মিতই পাথর ফেলতে হয় ও মাটির কাজ করতে হয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক রেলপথে আগ্রহ বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অর্ধেকের বেশি রেলপথ ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে ট্রেনের গতি বাড়ার পাশাপাশি ব্যয় অনেক কমছে। এছাড়া ডিজেলের ব্যবহার না থাকায় পরিবেশের ক্ষতিও শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা যায়। দেরিতে হলেও বাংলাদেশের উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।
জানা গেছে, দেশে মাত্র ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুতে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানো সম্ভব। তবে এর গতি কিছুটা কম। গতি বাড়াতে বেশি বিদ্যুতের ট্রেন দরকার। সাধারণত অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে সর্বোচ্চ দেড় হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুতে চলছে বৈদ্যুতিক ট্রেন সার্ভিস। বিনিয়োগ বেশি হলে বিমানের গতিতেও চলবে বৈদ্যুতিক ট্রেন। এক্ষেত্রে বিদ্যুত্ খরচ আরো বেশি হবে, বাড়বে পরিচালন ব্যয়ও। বর্তমানে চীন এ ধরনের ট্রেন উদ্ভাবন করেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. তাফাজ্জল হোসেন জানান, জনবহুল হওয়ায় ও রেলপথের পাশে বাড়িঘর এবং হাটবাজার থাকায় আমাদের দেশে খুব বেশি গতির ট্রেন চালানো সম্ভব নয়। ফলে ২৫০-৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুতের ইঞ্জিনই যথেষ্ট। এতে ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি দ্রুতগতির সেবা দেয়া যাবে। বণিক বার্তা।