নারী ও তার জীবন
আনোয়ারুল হক নূরী ।
নারী কী ? নারী কী মানুষ ? আজন্ম কৌতুহলের বিষয় পূরুষের কাছে । নারী কী স্নেহময়ী মা ? নাকি মায়াবিনী জীবন সংগিনী ?হয়ত বা ছলনাময়ী রক্ত-মাংসের মানুষ । নারীর জন্মকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন বড়ই দুর্বোধ্য রসহ্যজালে ঘেরা । শিশুকালে সে অবুঝ খুকী । মা-কাতর স্নেহের দুলালী । বয়ঃসন্ধিক্ষণে সে হয়ে ওঠে সে অসম্ভব রকমের কৌতুহলী । আবিষ্কার করেত শেখে নিজেকে । তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে মিলনের দুর্নিবার আগ্রহ । দেখা যায় কখনো সে শাসন-শেকলের বাইরে মুক্ত বন্ধনহীন । যখন তখন অযথা অভিমান করে । বুকে অব্যক্ত কথামালার বসবাস । অথচ সে লাজুক লতার মত লজ্জাবতী । বুক ভরা কথা অথচ নির্বাক । সমাজ সংস্কারের অভাবে নারী পায় না তার মনোভাব ব্যক্ত করার অধিকার । সমাজ আর পারিপার্শ্বিক কারণে কিশোর পায় না স্বাধীনভাবে কথার বলার অধিকার । এক অসহনীয় পরিবেশের ভেতর দিয়ে তার উন্মাদ যৌবন কাল ফল্গুধারার মত বইতে থাকে । পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ তার সমস্ত আচরণের উপর রাখে সতর্ক ও কটাক্ষ দৃষ্টি । মূহুর্তে মুহুর্তে তার সমস্ত অহেতুক কারণে-অকারণে অযথা শাসনের শেকলে বন্দী রাখে তার সমস্ত বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ইচ্ছার মুক্ত প্রকাশ । তার কোমল মনে জমতে থাকে ক্ষোভের কাল মেঘ । তাই কখনো নির্জলা সত্যের শাসন কে উপেক্ষা করে ; মা বাবা বড় জন কে অবহেলার চোখে দেখে । তখন সে নিজেকে ভাবতে শেখে মুক্ত রাজ্যের স্বাধীন রাজা । মানে না শাসন ,মানে না বারণ, মানতে চায় না নিজ জীবনের ভয়াবহ পরিণতি । মনের গোপন রাজ্যে রচনা করতে শেখে সুখ-স্বপ্নের সুন্দর তাজমহল । জানে না সে তা কী কল্পনার তাজমহল ,নাকি বাস্তবের দুখের তাজমহল ? নারীর বিভ্রান্ত মনের মিথ্যা মোহ তাকে নিয়ে যায় দুখের যন্ত্রণাময় কুড়ে ঘরে । বাস্তবের মাঠ ছেড়ে বিচরণ করে কল্পনার ছলনার পঙ্কীরাজে । শেষতক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে নির্মম অভিঘাতে মুখ থুবড়ে পড়ে কল্পনার মায়াবী পঙ্কীরাজ ।
যখন সে জননী নয় ।
বয়ঃসন্ধিক্ষণে একজন নারী মা নয় । হয়ত সে মাতৃত্বহীন স্বাভাবিক মানুষ অথবা নারীর পূর্ণ অবয়বে জীবন সঙিগ আকাঙ্ক্ষীনি রহস্যময় মায়াবীনী । কখনও সে চঞ্চল প্রকৃতির , কখনো সে অভিমানিনী , কখনও সে শাসন শেখলহীন । কখনও লাজুক , আবার কখনও প্রশান্ত । বিচিত্র আদলে ঘুরপাক খায় অস্থির ষোড়ষী ।পুরুষের যখন তখন বাধা নিষেধের নির্দয় খাচায় তার স্বাভাবিক ইচ্ছা বন্দী হয়ে থাকে । ছটফট করতে থাকে ষোড়শীর মন ।সামাজিক অপবাদ, সমাজের অন্যায় আবদার ,কিশোরী মন কে করে তোলে বিক্ষুদ্ধ । ফলে তার মনের নির্ভৃত কোণে জমতে থাকে ক্ষোভের কালো মেঘ । অসহায় কিশোরী মা বাবার কাছে তার মনের অবুঝ আবেগ প্রকাশ করতে সাহস পায় না । এক অস্থির অসহনীয় অসময়ের মধ্যে দিন কাটে কিশোরী । এক অজানা অন্ধ আবেগের বশে কোন সময় তার সোনালী জীবনের সর্বনাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না । বয় চাঞ্চল্যের কারণে সে চায় একটু পুরুষের ছোঁয়া , চায় মিষ্ট আলাপ । হৃদয় দেয়া নেয়ার অবাধ সুযোগ খুজে ; সমাজের প্রবল প্রতিরোধ ,বাদ-অপবাদের মুখে ।মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নারী-পুরুষের ভালবাসা । এই ভালবাসা সমাজ স্বীকৃতি দেয় না । প্রেম ভালবাসাও সমাজের স্বীকৃতির অপেক্ষা করে না । সমাজ অনেক কিছু স্বীকৃতি দেয় না যা যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহনযোগ্য । আবার সমাজ অনেক কিছু স্বীকৃতি দেয় যা আদৌ যুক্তিসঙ্গত গ্রহনযোগ্য নয় । যেমন বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত মতামত গ্রহণ করা । বয়েসের অনুপ্রেরণায় একজন নারী পুরুষ হৃদয়ের সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে । একটি পুরুষের হৃদয়ের কাছে খুজে একটু ঠায় । একটু আশ্রয় । কিন্তু বাধ সাধে তার পারিবারিক অবস্থা , সামাজিক অপবাদ , ধর্মীয় বাধা নিষেধের দুর্লঘ্য দেয়াল । কিন্তু প্রেমের কোন যুক্তি নেই , নেই কোন আত্মসম্মান বোধ । দুর্নিবার মিলন মোহ স্রোত বয়ে চলে মিলন-মোহনার দিকে । তাই দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা নারী হৃদয় কে দিন দিন ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে । মানে না তখন ধর্মিয় শাসন , মানে না সামাজিক প্রচলিত প্রথা । এক অজানা অন্ধ আবেগের মোহে ছুটে চলে গতিশীল নদীর মত । জানে না হয়ত চলার পথে মরুভুমি আছে । থাকতে পারে পাহাড় সমান বাধা । নিশ্চিন্তে নিঃসস্কোচে নারী হৃদয় ছুটে চলে মিলন মোহনার দিকে । যেই মাত্র মিলন মোহনা গিয়ে উপনীত হবার উপক্রম ; তখনই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ভোগে । এ প্রসঙ্গে বলা চলেঃ সেক্সপিয়ারের উক্তি –“ প্রেম পুরুষের বিলাসিতা; নারীর সমগ্র তার আশ্রয় স্থল ।“ পুরুষের হৃদয় কতটুকু বিশ্বাসী , কতই বা অকৃত্রিম স্নেহ আর মমতায় গড়া – এ দোদুল্যমান মানসিকতার তীব্র দ্বন্দ্বে হেরে গিয়ে নারী হৃদয় নিতে থাকে ছলনার আশ্রয় ; এ ছলনার আশ্রয় নিতে গিয়ে বারবার বিভিন্ন দুয়ারে হানা দেয় নারী । আসে চরম বিপর্যয় । কখন হয় ব্যর্থ , কখনও হয় সফল । আবার কখনও সর্বনাশ ডেকে আনে । জানে না সে কী ঘটতে যাচ্ছে । আবেগের তোড়ে অনেক সময় এক দুখের সংসার রচনা করে । মুহুর্তে তা তাসের ঘরের মত ভেঙে যায় ।
ঃযখন নারী জননীঃ
একটি নারী অত্যন্ত আবেগ প্রবণ । সে পারে না তার আবেগের দুরন্ত ঘোড়া কে বশে রাখতে । পারে না সে নিজেকে স্থির রাখতে । প্রতিটি মুহুর্তে সে পরিবর্তনশীল । সংসারের ঘটন –অঘটন কে সামাল দিতে গিয়ে সময়-অসময়ে ছলনার আশ্রয় নিতেই হয় । হয়ত সে সংসারের শান্তির জন্য । নয়ত হিংস্ররুপী পুরুষ কে তার হিংস্রতাকে সামাল দিতে গিয়ে এ কাজ নারী কে প্রতি ক্ষণে করতে হয় । আবার কখনও সংসারের দুঃসহ যন্ত্রণাকে নিরবে সহে যায় । তার দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষীত পুরুষের কাছে যখন সে আশ্রয় স্থল গড়ে তোলে তখন সে ধীরে ধীরে স্বপ্ন বুনে চিরায়ত স্নেহময়ী জননীর । তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে মাতৃত্বের ছাপ পড়ে । তখন সে সুস্থির , নিথর জলের মত নিশ্চুপ ।তার জৈবিক চাহিদার উত্তাল সাগর শান্ত হয়ে আসে ।মেধা-মননে পূর্ণ মার্তৃত্বের আদলে গড়ে ওঠে । তখন সে স্নেহময়ী মা –জননী । তখন থাকে না জৈবিক চাহিদার মোহময় ভূবনে । স্নেহময়ী মায়ের ভূমিকায় গড়ে তোলে এক অনন্য ভুবন । পরম মার্তৃত্বের আত্মবিশ্বাসের কোমল তুলি দিয়ে যৌবনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কালোরেখা মুছে দেয় । মার্তৃত্বের আর নারীত্বের মাঝে রচনা করে স্পষ্ট বিভাজন রেখা । পরম মার্তৃত্বের পরশে তাবৎ পৃথিবীর মানূষ কে সেবা আর পরম স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলে । সেই আমার শিরোমণি পরম শ্রদ্ধাতুল্য মা-জননী । সেখানে রচিত হয় বিপরীতমুখী দুটো সত্তার –সুখের সংসার ।