নিপীড়িত শ্রমজীবীদের রক্তঝরা দিন, মহান মে দিবস

পহেলা মে বিশ্বব্যাপী মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরম্ন করে। এতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়, তা চূড়ানত্মরূপ লাভ করে ৩ ও ৪ মে। এই দুইদিনে শিকাগোতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় ১০ জন শ্রমিক। আহত হয় অনেকে। পুলিশ অনেক শ্রমিককে গ্রেফতার করে। এই শ্রমিকদের মধ্যে ৬ জনকে পরে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। কারাগারে বন্দীদশায় আত্মহনন করেন একজন শ্রমিক নেতা। শ্রমিক আন্দোলনের এই গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৯০ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে মে দিবস।
শ্রমিকদের আত্মত্যাগের স্মারক এ মহান মে দিবস। আত্মত্যাগের বিনিময়েই মালিকরা স্বীকার করে নিয়েছিল শ্রমিকরাও মানুষ। তারা যন্ত্র নয়, তাদেরও বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন আছে। বিশ্বের সকল দেশেই দিবসটি পালিত হয়।
আজ পহেলা মে, মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস। সব বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় দিন আজ। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেট চত্বরে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। দেশে দেশে গড়ে ওঠে মেহনতি জনতার ঐক্য। অবশেষে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে মে দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশে আজ সাধারণ ছুটি। সব ধরনের শিল্পকারখানা থাকবে বন্ধ। সংবাদপত্র কার্যালয় বন্ধ থাকার কারণে আগামীকাল কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। বেতার-টিভিসহ বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেল দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ার মূলে রয়েছে শ্রমিকদের বিশাল অবদান। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, সততা ও কর্মনিষ্ঠার ফলে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্পকারখানা। মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল শ্রমিকদের বিশেষ অবদান। বিভিন্ন সংগ্রামে শ্রমিকরা পথে নেমে এসেছেন চিরকালই। কিন্ত স্বাধীন দেশে শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্নগুলো আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতির কশাঘাতে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ প্রতিনিয়ত বাঁচার সংগ্রাম করছেন। বিদ্যুত্, গ্যাস ও বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অগণিত শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। বেকারত্বের অভিশাপে লাখো শ্রমিকের পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। শ্রম আইন থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা নেই। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ঠিকমত মজুরি দেয়া হয় না। নারী শ্রমিকদের মজুরি কম, নানাভাবে বঞ্চিত তারা।
মহান মে দিবমে স্মরণ করছি দেশ বিদেশের সব শ্রমজীবীদের, শুধু বলবো – তোমাদের শ্রমের বিনিময়েই আজ আমাদের এই সভ্যতা।

মহান মে দিবস : বঞ্চনার মাঝে অধিকার আদায়- মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

গ্রীষ্মের প্রচন্ড উষ্ণতায় মানুষ থেকে প্রানী সবাই হিমেল ছায়ার সন্ধানে ছুটে চলে। তপ্ত রোদ থেকে নিস্কৃতি পেতে পাখিরা আশ্রয় নেয় গাছের মগডালে পত্র-পল্লবের ছায়ায়। বাগানে গাছের ছায়ায় কুকুর ছানারা আশ্রয় নিলেও একহাত জিহ্বা বের করে গরম যন্ত্রনায় লালা ছেড়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করে। বনের রাজা সিংহ সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ার পরও গরম তাকে এতই কাবু করে যে শেষ পর্যন্ত একটু প্রশান্তি খুঁজতে তাকে পানিতে নেমে পড়তে হয়। গরমের নিকট সবাই কাবু হয়ে যখন প্রশান্তির ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে তখন শ্রমজীবি মানুষগুলোকে এতটুকু পর্যন্ত টলাতে পারেনা গ্রীষ্মের উষ্ণতা। শ্রমজীবি মানুষ গুলো গরমকে উপেক্ষা করে তাদের কর্মে থাকছে অবিচল। এই চিত্র গ্রীষ্মের হলেও শীতের চিত্রও তার বিপরীত নয়। কনকনে শীতের সকালে কম্বল-কাঁথা মুড়ি দিয়ে যখন সবাই বদ্ধ ঘরে আরামের জন্য একটু উষ্ণতা খোঁজে তখন এদেশের মেহনতি কৃষক কনকনে শীতকে চাদর বানিয়ে ছুটে যায় লাঙগল-জোয়াল কাঁধে মাঠে ফসল বুনতে। নিজের সত্তার কথা চিন্তা না করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্তকে পানিতে পরিণত করে যারা জীবনের বাঁকে শ্রমের তরীর মাঝি হিসেবে তরীকে তার গন্তব্যে নিয়ে যেতে অকান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আজ সেই সকল মেহনতি মানুষের প্রতীক মহান মে দিবস আমাদের সামনে উপস্থিত। মহান দিবস সারা বিশ্বে পালিত হবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি বেসরকারি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন শ্রমিক সমাবেশের মাধ্যমে এই দিবসটি উদযাপন করবে। কিন্তু আমরা যদি ইতিহাসের বাঁকে ফিরে দেখি যে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই মহান মে দিবস সেই সকল মেহনতি শ্রমিকের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নানা বঞ্চনা আর বৈষম্যের শিকার শ্রমিকরা তখনো জানতোনা তারা কিভাবে নির্যাতন আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবে। তাদের ক্ষোভ শুধু ধুমায়িত হতে থাকে, একের পর এক লাঞ্চনা বঞ্চনা নির্যাতনে যখন শ্রমিক সমাজের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল তখন অধিকার আদায়ে

১৮৬০ সালে প্রথম রাস্তায় নামে শ্রমিক সমাজ। কিন্তু সংগঠিত না থাকায় শ্রমিক মানুষেরা তাদের ন্যয্য অধিকার গুলো আদায় করতে পারেনি। ১৮৮১ সালে শ্রমিকরা তাদের দাবী জোরালো ভাবে তুলে ধরে এবং সে বছরেই ন্যয্য দাবী-দাওয়া আদায়ের লক্ষে আমেরিকা ও কানাডায় গঠিত হয় দুটি শ্রমিক সংগঠন। এই দুটি সংগঠন বিভিন্ন ভাবে শ্রমিকদের ন্যার্য দাবি গুলো তুলে ধরে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৪ সালে দু-দেশের শ্রমিক সংগঠন একটি প্রস্তাবনা পাশ করে, এতে বলা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে শ্রমিকদের কর্মদিবস হবে ৮ ঘন্টা। ৮ ঘন্টার বেশী কোন শ্রমিক কাজ করবেনা। দুটি দেশের শ্রমিক সংগঠনের এই ঘোষনায় উদ্বেলিত হয় শ্রমিক সমাজ। তারা তাদের অবস্থানে থেকে এ ব্যপারে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের ৮ ঘন্টার বেশী কাজ না করতে উৎসাহ যোগায়। কিন্তু মালিক ও সরকার পক্ষ শ্রমিকদের এই প্রস্তাবনায় সাড়া না দিয়ে নির্যাতন ও নিপিড়নের পথ বেছে নেয়। এমতাবস্থায় ১৮৮৬ সালের ১ মে মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত শ্রমিকদের প থেকে কতক ন্যয্য দাবি আদায়ে শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটের সামনে বিশাল সমাবেশের ডাক দেয়। শিকাগো শহরের ৭ টি সংগঠনসহ ২২ টি শ্রমিক সংগঠন এদিন মিছিলে মিছিলে ‘হে’ মার্কেটের সামনে সমবেত হতে থাকে। শ্রমিকদের এই ন্যয্য দাবীর সাথে সরকার ও মালিক পক্ষ ঐক্যমত না হওয়ায় সমাবেশ বানচাল করতে পুলিশ গুলি চালালে এতে অনেক শ্রমিক নিহত হয়। কিন্তু শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে জীবনের শেষ রক্তবিন্ধু ঢেলে দিতে প্রস্তুত তবুও তাদের ন্যয্য দাবী থেকে একচুল পরিমানও পিছপা হতে রাজী নয়। শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আর মরিয়া ভাবের নিকট পরাজিত হয় সরকার। মেনে নেয়া হয় সকল দাবী-দাওয়া। পরবর্তীতে মার্কিন সরকার ১ মে কে ‘ল ডে’ হিসেবে ঘোষনা করে। বঞ্চনার মাঝে অধিকার আদায় করে নেয় শ্রমিকরা। তখন থেকেই মে দিবস সকলের নিকট শ্রমিক অধিকার আদায়ে আন্দোলনের প্রতিক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
শুধু আমেরিকা আর কানাডা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সরকারি ভাবে পালিত হচ্ছে মে দিবস । বাংলাদেশেও সরকারি ভাবে পালিত হয় মে দিবস। বাংলাদেশ লেবার ফোর্স এর সার্ভে অনুযায়ি দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি, এর মধ্যে এক চতুথাংশ মহিলা শ্রমিক। বাংলাদেশের এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রতিশ্রতি দিয়ে প্রতিবছরই আমাদের দেশে মে দিবস পালিত হলেও এদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে যারা সবচেয়ে বড় অংশিদার তাদের অধিকারের কথা গুলো সরকার থেকে শুরু করে আমরা সবাই ভুলে যাই। ফলে মে দিবস আসে মে দিবস চলে যায় কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়না, জীবন যাত্রার চাকা ঘোরেনা এদেশের শ্রমিক সমাজের। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা বিভিন্ন সেক্টরে তাদের শ্রম দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিচ্ছেন। শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরেও বিশাল সংখ্যক শ্রমিক জনগোষ্ঠী অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করছেন । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রবাসী এ শ্রমিকরা তাদের ন্যয্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধু অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া বললে ভুল হবে তাদের চিত্র আরো ভয়াবহ। সম্প্রতি সাভার ট্রাজেডীর দিকে তাকালেই তা সকলের নিকট স্পষ্ট। যাদের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে নিজের ভাগ্য গড়ে মালিক আর সরকার তখন তাদেরকে রাজনৈতিক বলির পাঠা বানিয়ে মারাত্নক পাটল ধরা ভবনে জোর করে ডুকিয়ে কাজে বাধ্য করা হল। ফলশ্রুতিতে ভবন বিধ্বস্ত হয়ে প্রায় ৪ শতাধিক শ্রমিককে হত্যা করা হল।এ যেন ডেকে নিয়ে খুন করা। হাজার খানেকের মতো এখনো নিখোঁজ। এত বড় ঘটনায় শোক পালন হল কিন্তু রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা হলনা।শ্রমিক বলেই তাদের কোন অধিকার থাকতে নেই। তাদের প্রাপ্য হল ভবন ধসে কিংবা আগুনে পুড়ে লাশ হওয়া।দেশের ভেতর যখন এই অবস্থা তখন ভালো নেই দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে ভুমিকা পালনকারী প্রবাসী শ্রমিকেরা। মাঠের ফসলি জমি, ঘোয়লের গরু, পুকুরের মাছ, এমনকি নিজের ভিটে-মাটি বিক্রি করে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গ্রামের সহজ সরল যে শ্রমিকটি জীবন-জীবিকার সন্ধানে, ভাগ্য উন্নয়নে প্রবাশে পাড়ি জমায় তখন দালালদের খপ্পরে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করে কিংবা বিদেশী দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে জীবন বাঁচানোর প্রার্থনা করে তখন আমাদের দুতাবাসের কর্তা ব্যাক্তিরা শ্রমিকদের এই দুর্দশায় যেই পথে শ্রমিকটি দূতাবাসে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে আবার সেই পথেই চলে যেতে বলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। কারন এরা তাদের জন্য বোঝা। তারা শুধু অর্থ উপার্জন কারীদের আয়েই দেশীয় রেমিটেন্স বাড়াতে চায় মানবতের জীবন যাপন কারী এবং বিদগ্রস্থদের দায় তাদের উপর বর্তায়না । এইতো গত কয়েকদিন আগের ঘটনা লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশী শ্রমিকদের দুরবস্থায় পাশে দাঁড়াতে পারেনি আমাদের দেশের দুতাবাস কিংবা সরকার। ফলে দেশের সমৃদ্ধিতে অংশিদার মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা অনাহারে অর্ধাহারে তাদেও দিনাতিপাত করে নিঃস্ব, অসহায় হয়ে দেশে ফিরেছে। কাউকে খাদ্যের অভাবে প্রান দিতে হয়েছে। এখনো অনেক শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে আটকা পড়ে আছে। অসহায় অবস্থায় দেশে ফিরে এসে যখন সু-শৃংখল ভাবে মানব বন্ধন করে প্রতারক চক্রের বিচার দাবী এবং তিপুরন চায় তখন সরকারের ভূমিকা রাখার কোন ইচ্ছে থাকেনা, মহান মে দিবসের তাৎপর্যও আর স্মরণ থাকেনা সরকারের। দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিদেশী বাজার অথচ সরকার শুধু মন্ত্রী এমপিদের সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠিয়ে সেই দেশের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে সাাৎ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করে। দুর্দশাগ্রস্থ প্রবাসী শ্রমিক সমাজের এই প্রতিচ্ছবির চেয়ে ভালো নেই দেশীয় শ্রমিক সমাজ। দেশে শিশুশ্রমের ব্যাপক ব্যবহার চলছে। ঘরের ঝিয়ের কাজ থেকে শুরু করে রি-রোলিং ও ইস্পাত কারখানার মত মারাত্তক ঝুকিপূর্ন কাজ করানো হচ্ছে শিশু শ্রমিকদের দিয়ে। কোমলমতি যেই শিশুদের হাতে থাকার কথা ছিল খাতা, কলম আর বই আজ তাদের হাতে মেশিন তৈরীর ভারী যন্ত্র, লোহার আগুনে দগ্ধ কচি হাত গুলো। অন্যান্ন শিশুর মত যে শিশুটির অধিকার ছিল মা-বাবার আদর-স্নেহে পালিত হওয়া, জীবিকার সন্ধানে সে শিশুটি আজ ফজরের আজানের শব্দে ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে যায়। অকান্ত পরিশ্রমের পরও সামান্য অসচেতনতায় নেমে আসে গালি-গালা, নির্যাতন। যে শিশুটি দুরন্ত হওয়ার কথা ছিল, যার অধিকার ছিল অন্যান্য শিশুর মত হেসে খেলে বড় হওয়া সেই শিশুটি যখন পরের ঘরে কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতা বসত একটি পাত্র ভেঙ্গে ফেলে, তখন গৃহকর্তী কর্তক অবুঝ শিশুটির উপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। লোহার শিক গরম করে শরীরে সেক দেয়ার ঘটনা এই সমাজের শিশু শ্রমিকদের জন্য বিরল নয়। যে গৃহকর্তীরা অপরের শিশু সন্তানের সাথে এমন নির্মম আচরন করেন তাদের সন্তান কিংবা ছোট ভাই-বোন যদি এমন অসাবধানতা বসত কোন পাত্র ভেংগে ফেলতো তাহলে নিশ্চয় তাদের সাথে আচরণ এমন জঘন্য হতোনা। বাংলাদেশের ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার আয় হয় তৈরী পোশাক শিল্পে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। তাদের বোনাসতো দেয়াই হয়না বরং কাজের নিদ্দিষ্ট বেতন ও ঠিকমতো পরিষোধ করেনা মালিক প। ফলে তাদের বেছে নিতে হয় আন্দোলন। আর শ্রমিকদের এই অসন্তোষের সুযোগ নেয় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল। যারা পাশ্ববর্তী দেশের বিদেশী বাজার চাঙ্গা রাখতে চায় তারা শ্রমিক অসন্তোষের এই সুযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ফলে একদিকে তৈরী পোষাক শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে অন্যদিকে শ্রমিক বঞ্চিত হয় বেতন ভাতা থেকে তারা পরিনত হয় স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রিড়নকে। আমাদের এই দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কৃষকের বাস হলেও কৃষকের অধিকার আজও আমাদের সমাজে অধরাই থেকে গেছে। আজও সারের জন্য, সেচপাম্পের মাধ্যমে জমিতে পানি দেয়ার জন্য বিদ্যুতের দাবিতে কৃষককে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। যে কৃষক শুধু নিজের জন্য চাষাবাদ করেনা, ঝড়, বৃষ্টি, সাইকোন, বন্যা, খরা মোকাবিলা করে দেশের জন্য সম্পদ তৈরীতে জমিতে ফসল বুনে সেই কৃষক যখন দুঃখ দুর্দশায় পতিত হয় তখন মহান মে দিবসের কথা আমাদের মনে থাকেনা, দাঁড়াতে পারিনা আমরা সেই কৃষকের পাশে। আমারা সেই কৃষকের পরিশ্রমের মুল্য দিতে জানিনা। দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতি সহ জীবন যাত্রার ব্যয় যখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছেনা এদেশের শ্রমিক সমাজের আয়, ফলে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেউ একবেলা খেতে পারছে তো অন্য বেলা উপোস থাকছে। দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতিতে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবার অবস্থা। বেতন ভ্রাতা বৃদ্ধি না হলে এবং শ্রমিকদের এ ভাবে মানবেতর জীবন যাপন চলতে থাকলে মানসিক এবং শারিরিক ভাবে দুর্বল হতে থাকবে শ্রমিক জনগোষ্ঠী, ফলে ব্যহত হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। কৃষক শ্রমিক চাষা মজুর থেকে শুরু করে হাজারো শ্রমিকের মাঝে আমাদের বসবাস। এই সকল শ্রমিক থেকে আমরা সেবা গ্রহন করলেও আমারা তাদের পরিশ্রমের মুল্য দিতে জানিনা। জানিনা তাদের মর্যাদার মুল্যায়ন করতে। আমাদের সমাজের বাথরুমের ক্লিনার(মেথর) থেকে শুরু করে বাসের হেলপার কিংবা নৌকার মাঝি সকলেরই অবস্থা একই । পদে পদে অধিকার হারা লাঞ্চনা আর নির্যাতনের শিকার তারা। অথচ আজ থেকে যদি ১৪শত বছর পূর্বে ফিরে যাই তাহলে দেখবো মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ) তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেছেন“শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি দিয়ে দাও” চির শাশ্বত সেই বানী আমাদের শ্রমিকের মর্যাদা দানে আরো উৎসাহিত করে যে“তারা(শ্রমিক) তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধিন করে দিয়েছেন, তাই তোমরা যা খাবে তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদের তা পরতে দিবে”। তাছাড়া আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মেষ চরাতেন। খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় নিজের কাঁধে পাথর বহন করে শ্রমের উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শ্রমিকদের প্রতি মর্যাদাবোধ ও অধিকার প্রদানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমাদের আরো কর্তব্য পরায়ন করে তুলেছেন মানবতার এই মহান বন্ধু। এমনকি অসংখ্য নবী এবং রাসুল আছেন যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। আমরা আমাদের শ্রমিকদের মর্যাদার মুল্যায়ন এখান থেকেই করতে পারি। আমরা তাদের ভাই হিসেবে তাদের সুঃখ-দুখে অংশিদার হব, বিপদে পাশে দাড়াব আমাদের নবী রাসুলদের ইতিহাস এমন শিক্ষাই আমাদেরকে দেয়। দেড়শত বছর আগে থেকে মহান মে দিবস পালিত হয়ে আসলেও শ্রমিকরা তাদের ন্যয্য অধিকার থেকে এখনো বঞ্চিত বরং নির্যাতন আর নিষ্পেষনের যাতাকলে পিষ্ট তারা। শ্রমিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এই প্রতীকও শ্রমিকদের ন্যয্য অধিকার আদায় করতে পারেনি। শ্রমিক সমাজ কি নির্যাতন আর নিষ্পেষনের যাতাকল থেকে কখনই মুক্তি পাবেনা? তাদের মুক্তির অধিকার কি অধরাই থেকে যাবে? হ্যাঁ শ্রমিক সমাজ মুক্তি পেতে পারে এমন একটি কল্যানধর্মী সমাজ ব্যবস্থা থেকে যে সমাজ শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মুজুরি দিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়, যে সমাজ শ্রমিকদের মানব সম্পদ হিসেবে মুল্যায়ন ও মর্যাদা প্রদান করে। যে সমাজ ব্যবস্থা নিজে যা খাব শ্রমিককেও তা খাওয়াতে বলে, নিজে যা পরবো শ্রমিককেও তা পরতে দিতে বলে এমন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকলে শামিল হলে শুধুমাত্র শ্রমিক সমস্যার সমাধানই নয় বরং গোটা মানব সমাজের মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.