নূপুর পায়ে বর্ষার ছন্দে এলো আষাঢ়

প্রকৃতির আবর্তে জলের নূপুর পায়ে বর্ষার ছন্দ নিয়ে এল আষাঢ়।  দ্বিতীয় ঋতু বর্ষায় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থাকে কদম-কেয়ায় শিহরিত।

গ্রীষ্মের তপ্ততা ও দাবাদাহ থেকে মুক্তি দিতে জলজ স্বস্তিতে বর্ষার আমেজ শুরু হয়েছে আজ থেকেই।

এ দেশের মানুষের ভাব উস্কে দেওয়া ঋতু বর্ষা। সৃষ্টিশীল মানুষের উপর বর্ষার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। সেই প্রাচীন কাল থেকেই কবি-সাহিত্যিক, গীতিকারসহ সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টি ঐশ্বর্যে বর্ষা এসেছে নানান ঢঙ্গে।

আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে জলীয়বাষ্পবাহী মৌসুমী বায়ু দেশের আকাশে বিস্তার লাভ করায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষার স্পর্শে সিক্ত প্রকৃতি যৌবন দীপ্ততায় বদলে যায়। শাণিত সবুজে মুগ্ধতার রেশ যেন ছড়িয়ে পড়ে বনে বনে।

বাহারী জলজ ফুলের সঙ্গে বর্ষায় চারপাশ মোহিত করে বেলী, কেয়া, গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা, জুঁই, বকুল, হাসনাহেনাসহ নানান ফুল। স্নিগ্ধ কদমের দেখা মেলে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজপথের ধারেও। বর্ষার পেয়ারা, ডেউয়া, জাম, গাব, জামরুলের স্বাদ তুলনাহীন।খিচুরীসহ নানা রসনায় ডুবে ঝরো ঝরো বরষার দিনে নাগরিক জীবনে হয়ত কারো কারো মনে জাগে—

‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন
ছল ছল জলধারে
বেনু বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ
মন যেন চায় কারে।’

কিন্তু এ ঋতু কারো কারো কাছে নিয়ে আসে কর্মহীনতায় অভাবের কষ্ট।আর তুমুল বর্ষার পর রাস্তায় পা রাখলেই থৈ থৈ পথ দেখে রাজধানীবাসীর সব ভাব নিমিষে উবে যায়। বর্ষায় ঢাকাবাসীর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের ফিরিস্তি বহু পুরনো। বৃষ্টি নিত্য যানজটকে তীব্র করে ভোগান্তির ষোলকলা পূর্ণ করে ঢাকাবাসীর। তাই আবেগহীন কঠোর বাস্তববাদী মানুষ যদি বর্ষাকে দুর্ভোগ মনে করে তবে তাকে দোষও দেওয়া যায় না। অতি বৃষ্টিতে পাহাড় ধস, কিংবা বন্যায় জনজীবনের দুর্যোগের যোগও এই বর্ষায়ই।

হয়ত অনেকেই দেখিনি কিন্তু আষাঢ়ে মেঘের গুড়গুড় শব্দে ময়ূরের পেখম মেলে নাচবার কথা জানি না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বৃষ্টির নব জলধারায় গ্রাম্য বালকের হুটোপুটি কিংবা নাগরিক জীবনে ইট-পাথরের ভবনের ছাদে বৃষ্টি বিলাস যেন একান্তই আমাদের।বর্ষা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতামাতিটা একটু বেশীই। তাঁর গানে ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’ কিংবা কবিতায় ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’ এভাবে ঘুরে ফিরে বর্ষা এসেছে বার বার। কিংবা বৃষ্টি ছুঁয়ে আকুল বুকেই কবির আনন্দ যেন ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়/এমন দিনে মন খোলা যায়/এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে/তপনহীন ঘন তমশায়।’

আমরা উদ্বেলিত হই কাজী নজরুল ইসলামের— ‘দোলে শিহরে কদম, বিদরে কেয়া/নামিল দেয়া’। কবি নজরুল আরও লিখেছেন— ‘বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা/তোমার শ্যামল শোভা বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা/তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফলের ডালা।’‘কাননের পথে লহর খেলিছে, অবিরাম জলধারা/তারই স্রোতে আজি শুকনো পাতারা, ছুটিয়াছে ঘরছাড়া’ বর্ষায় গ্রামের খুব পরিচিত চিত্র হলেও কবি জসীমউদদীনের ‘গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আজি— মোড়লের দলিজায়/গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে—

আজিকার দিনটায়!/কেউ বসে বসে বাখাড়ি চাছিছে, কেউ পাকাইছে রশি/কেউবা নতুন দুয়ারির গায়ে, চাকা বাঁধে কসি কসি/… মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুন ভাটির সুরে/আমির সাধুর কাহিনী কহিছে, সারাটি দলিজা জুড়ে’ চিত্র এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.