পণ্যবাহী জাহাজের অন্ধকার সময়: ভাড়া কমেছে ৭৪ শতাংশ
বাল্টিক ড্রাই ইনডেক্সে (বিডিআই) কেপসাইজ জাহাজের দৈনিক ভাড়া গতকাল কমেছে ২৭ ডলার। ৩১ বছরের ইতিহাসে সূচকটি সবচেয়ে নিচে নেমেছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। গত বছরের তুলনায় পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া এখন ৭৪ শতাংশ কম। বিশ্বজুড়ে পণ্য বাণিজ্যের মন্দার কারণে জাহাজ ব্যবসায় এ দুর্দশা নেমে এসেছে। খবর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও শিপ অ্যান্ড বাঙ্কার।
আকরিক লোহা, সিমেন্ট, বক্সাইট, ক্লিংকার, কয়লা, জ্বালানি তেল ইত্যাদি বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজের দীর্ঘ সারি দেখা যায় বিভিন্ন দেশের উপকূলে। ভাড়ায় নিযুক্ত জাহাজের বাজারে চাহিদা এত কম যে, অনেক কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবছে। বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানি এরই মধ্যে দেউলিয়াত্বের আবেদন জানিয়েছে।
জাহাজ অলস রাখাও ভীষণ ব্যয়সাপেক্ষ। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিষ্ক্রিয় করে তিনজন নাবিকসহ কোনো জাহাজ ছয় মাস থামিয়ে রাখাকে কোল্ড লেআপ বলা হয়। এ সময় একটি জাহাজে মৌলিক রক্ষণাবেক্ষণে মাসিক অন্তত ২০ হাজার ডলার ব্যয় হয়। তবে বড় খরচটি আসে আরো পরে। কোল্ড লেআপ থেকে ফিরিয়ে এনে একটি জাহাজকে সমুদ্রগামিতার উপযোগী করতে ১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে। এ কারণে অনেক কোম্পানি নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই জাহাজ স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম জাহাজ পরিচালন সংস্থা গোল্ডেন ওশেন এ বছর ২৫টি জাহাজ স্ক্র্যাপ করবে। আর্কটিক সিকিউরিটিজের মতে, চলতি বছর মোট জাহাজ স্ক্র্যাপ হবে ৫০ মিলিয়ন ডিডব্লিউটি।
গোল্ডেন ওশেন গ্রুপের সিইও হারম্যান বিলুং জানান, চাহিদা মন্দার কারণে তিন-পাঁচ বছরের পুরনো সব জাহাজ বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শিপিং ব্রোকাররা জানান, বৈশ্বিক বাল্ক বহরের ৭ শতাংশ এখন অলস পড়ে আছে। ভাড়ার অভাবে বসে রয়েছে ৬৯০টি ড্রাই বাল্ক ক্যারিয়ার। এথেন্সভিত্তিক অ্যালাইড শিপব্রোকিংয়ের রিসার্চ অ্যান্ড ভ্যালুয়েশন বিভাগের প্রধান জর্জ লাজারিদিস বলেন, চাহিদা ও সক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে এর চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক জাহাজ পার্ক করতে হবে।
ব্যবসার এ মন্দাবস্থায় ভাটা নেমেছে জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও। জাহাজ মালিকদের অনেকে নতুন নির্মাণ-আদেশ দিতে ও সরবরাহ নিতে কালক্ষেপণ করছেন। হারম্যান বিলুং জানান, বছরের শুরুতে অর্ডার বুক ছিল ১২৬ মিলিয়ন ডিডব্লিউটি (ডেড ওয়েইট টনেজ)। বর্তমানে তা কমে হয়েছে ৯০ মিলিয়ন ডিডব্লিউটি।
জাহাজ শিল্পের এ দুর্দশা কাটতে কমপক্ষে দু-তিন বছর সময় লাগবে বলে মনে করছেন কানেক্টিকাটভিত্তিক ইন্ট্রেপিড শিপিংয়ের স্বত্বাধিকারী রিচার্ড দুমুলিন। তবে সুসময় ফেরার আগে দুর্দশা আরো গভীর হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কমোডিটি পণ্যের বৃহত্তম আমদানিকারক চীন। সে দেশের শিল্প খাতের শ্লথগতি শিপিং লাইনারদের এ দুর্গতির কারণ। চীনের শ্লথগতির প্রভাব পড়েছে খনি থেকে পরিবহন পর্যন্ত সব খাতেই।
ধাতব, শস্য ও জীবাশ্ম পণ্যের পরিবহন ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় বাল্টিক ড্রাই বাল্ক ইনডেক্স (বিডিআই)। লন্ডনভিত্তিক এ সূচকের নির্ণায়ক তিনটি চলক: রুট, পণ্য ও গতি (সরবরাহ-সময়)। বিডিআই সূচকের ওঠানামায় প্রতিফলিত হয় বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিধারা। নিউইয়র্কভিত্তিক স্কপিও বাল্কারসের প্রধান নির্বাহী এমানুয়েল লরো বলেন, বিডিআই প্রতিদিন নতুন থেকে নতুনতর তলানিতে ঠেকছে। এটা ভয়ানক।
শিপিং লাইনসগুলো শুধু ভাড়ার পতনেই ভুগছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারেও কষ্টে আছে। গত এক বছরে স্কর্পিও বাল্কারস ও স্টার বাল্ক ক্যারিয়ার ৯০ শতাংশ বাজারমূল্য হারিয়েছে।
নিইউয়র্কভিত্তিক মেরিটাইম পরামর্শক বাসিল কারাতজাস বলেন, ঋণ বাজারেও শিপিং কোম্পানিগুলো ভালো নেই।
তবে অঢেল সম্পদ ও ঝুঁকির ক্ষুধা আছে, এমন কোম্পানিগুলো এ অবস্থায় কিছু সম্ভাবনা দেখছে। গ্রিসের ট্যাংকার অপারেটর অ্যাটলাস মেরিটাইমের প্রধান নির্বাহী লিয়ন পাতিতসাস বলেন, বাজার খুব খারাপ হওয়ায় এখনই কেনাকাটার ভালো সময় মনে করছি।
ঋণখেলাপের কারণে ব্যাংকের কাছে জব্দ রয়েছে, এমন ড্রাই-বাল্ক জাহাজ খুঁজছেন পাতিতসাস। তার ভাষায়, অদ্ভুত সময় এখন। রাস্তায় রক্ত দেখে আপনি বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়েছেন। হোক না সে রক্ত আপনার নিজের।বণিক বার্তা।