পপগুরু আযম খান

পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম নেয় শুধু সবাইকে সবকিছু দিয়ে যাওয়ার জন্য। বিনিময়ে মানুষের নামমাত্র ভালোবাসা ছাড়া জীবনে আর কিছুই পায়না। যারা অর্থ-বিত্ত আর ক্ষমতা পাওয়ার পেছনে ছুটে না। অরথ-বিত্তের কাছে নিজেকে বিক্রি করে না। খুব অল্পতেই সন্তুষ্টি থাকেন সবসময়। জীবনে সত্যিকারের এমন একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব এই দেশে খুব বিরল। লাখো মানুষে ভিড়ে এমন মানুষের দেখা পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যর। ঠিক তেমনই একজন বিরল মানুষ ছিলেন পপগুরু, পপসম্রাট নামে সবার কাছে পরিচিত একজন সত্যিকারের খাঁটি মুক্তিযুদ্ধা প্রিয় আজম খান । আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে যিনি আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন। আর কখনও সদা হাসিমুখে চিরসবুজ তারুণ্যর অধিকারী এই মানুষটির নতুন কোন গান আমরা শুনতে পাবো না , দেখতে পাবো না সারাজীবন জীবনের সাথে যুদ্ধকরে যাওয়া সেই সহজ সরল মুখটি। শুনতে পাবো না ‘সালেকা মালেকা’র দুঃখের কথা, ‘আলাল দুলাল’ নামক দুই দুষ্ট বালকের কথা, অথবা শুনতে পাবোনা ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে’ জন্ম নেয়া ও মারা যাওয়া সেই ছেলেটির কথা। ৫ জুন গুরু আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী, তাই গুরুর কিছু কথা আপনাদের জানাবো এবং গুরুর ঋণ শোধ না করতে পারা অক্ষম আমরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবো।
১৯৫০ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে জন্ম নেন বাংলার এই পপ্সম্রাট গুরু আজম খান যার পুরো নাম ছিল মাহবুবুল হক খান আজম। যিনি পরবর্তীতে আজম খান হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠেন। যার বড় ভাই এই দেশের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী সুরকার আলম খান।
১৯৭১ সালে মাত্র ২০ পার করে ২১ বয়সের তরুণ আজম খান দেশকে স্বাধীন করতে ঘর থেকে বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। ভারতে প্রশিক্ষন নিয়ে ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যেখানে তাঁর হাতের বন্দুক বেজেছিল গীটারের মতো এরপর যার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর জীবন যুদ্ধে গীটার বেজেছিল বন্দুকের মতো।
এরপর ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরে আসেন। স্বাধীন দেশে ফিরেই নানা প্রতিকুলতা ও অস্থিরতার মাঝে পড়লেন। চোখের সামনে অনেক যুবকরাই তখন অনেক অপরাধে লিপ্ত হয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। তখনই আজম খান আরও একটি যুদ্ধ শুরু করলেন। তিনি ঐ ক্ষয়ে যাওয়া যুবকদের বিপরীত পথে হাঁটতে লাগলেন। শুরু করলেন গান দিয়ে নতুন এক জাগরণের যুদ্ধ। সাথে নিলেন বন্ধু ফিরোজ সাই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ ও নাজমা জামান কে। শুরু করলেন এমন একটি ধারার গান যা আগে এই বাংলার সাধারন মানুষ পরিচিত ছিল না। শুধু উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা সেই ধারার বিদেশী শিল্পীদের গান শুনতো ও জানতো। সেই পপ ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গুটিকয়েক মানুষের পরিবেশনা করা ‘ব্যান্ড’ ধারার গান শুরু করলেন তরুন আজম খান। বাংলার মানুষ তখন বুঝতে পারলো আমাদের ছেলেরাও পারে বিদেশীদের মতো ‘ব্যান্ড’ ধারার গান গাইতে। সেই শুরুর সময়ে আজম খান ও তাঁর দল ‘উচ্চারন’ ঢাকায় গান দিয়ে মাতানো শুরু করলেন।।

তখনও সাধারন মানুষের মাঝে আজকের মতো ব্যান্ড গানের এতো কদর ও চাহিদা ছিল না। বহু মঞ্চে নিমন্ত্রন পেয়ে গিয়েছেন গান গাওয়ার জন্য কিন্তু পরবিবেশনা করার সুযোগ পেলো অনুষ্ঠানের শেষে তাও ১/২ টি গান। অনেক সময় প্রাপ্য টাকাও দেয়নি আয়োজকরা। তবু গুরু ও তাঁর দল হাসি মুখে চলে এসেছিল কোন অভিযোগ না করে রাস্তা দিয়ে দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে। গান শোনাতে পেরেছেন এতেই আনন্দিত সবাই, অর্থের আর কি দরকার? এই ছিল গুরু আজম খানের সহজ সরল মনোভাব। এমনও দিন গিয়েছে যে গান পরিবেশনা করে যা পেয়েছেন বাড়ী ফেরার পথে গরীব অনাহারে কাউকে রাস্তায় পেয়েছেন তাঁর সেই ক্ষুধা মেটানোর জন্য হাসিমুখে পকেটের সব টাকা দিয়ে শুন্য পকেটে ঘরে ফিরেছেন। এই হলো সহজ সরল ব্যক্তি আজম খান, যার মাঝে উপরে উঠার জন্য কোন অসৎ ইচ্ছা বা পন্থা কোনটাই ছিল না। মানুষের মুখের হাসি দেখলে নিজের দুঃখটা সহজে ভুলে যেতেন। ছিলনা কোন অর্থের লোভ। তাঁর সেই সংগ্রামের দিনগুলোর কথা ও দিনবদলের নবজাগরণের কথা নিয়ে এই দশকে বাংলাদের মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ‘বাংলালিংক’ তাঁদের একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল যা আজকের বর্তমান প্রজন্মের কাছে গুরুর সেই সংগ্রামী দিনগুলোর অতি সামান্য এক দলিলও বলা যায়, যেখানে গুরুর জীবনে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনার একটি চিত্র মাত্র যা আজকের বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানাছিল।

Azam Khan

Azam Khan

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম গুরু আযম খান ও তাঁর ব্যান্ড উচ্চারনের গান প্রচার করে। যার মধ্য ছিল – আসি আসি বলে তুমি – আযম খান (১৯৭২)
আলাল ও দুলাল – আজম খান (১৯৭২)
কাঙ্গাল হইলে ভবে – আজম খান (১৯৭২)
সহ আরও বেশকিছু জনপ্রিয় গান। সেদিন প্রথম সারা বাংলাদেশ জানলো যে আজম খান নামক এক লম্বা চুল ও দাঁড়িওয়ালা তরুণ বাংলাদেশের সঙ্গীতের নতুন এক ধারার গানের জনক। সেই থেকে ‘গুরু’ শব্দটি তাঁর নামের পাশে স্থান করে নিলো যা ছিল ভক্তদেরই দেয়া নাম। সেই ভালোবাসা পেয়ে গুরু আজম খান হয়ে গেলেন অপ্রতিরোধ্য, দুর্দান্ত এক ভক্ত পাগল শিল্পী। যিনি ভক্তদের ভালোবাসার বিনিময়ে নিজেকে গানের মাঝে উজার করে দিলেন। অর্থের দিকে তাকালেন না। তাঁর কাছে অর্থের চেয়ে ভক্তদের ভালবাসাই বড় হয়ে রইলো সারা জীবন। যিনি ভক্তদের ডাকে বিনে পয়সায়ও বহু জায়গায় গান গেয়েছিলেন। তাঁর এই সরলতার সুযোগে অনেকে তাকে ঠকিয়েছিল কিন্তু কোনদিন কারো নামে অভিযোগ করেননি। এমনও গেছে ক্যাসেট বের হয়ে হিট হয়েছে কিন্তু গুরু আজম খান সেই লাভের অংশ পায়নি। আবার কোন কোন দিন ক্যাসেটের বের হওয়ার পর বাকী অর্ধেক টাকাও পায়নি। তবু কোনদিন কেউ গানের জন্য গুরুর কাছে গেলে তাকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দেননি। এভাবেই কেটে গেলো সঙ্গীতের জীবন।
এই শতকের শুরুর দিকে অর্থের প্রয়োজনে বাংলা ছায়াছবি ‘গডফাদার’ এ ভিলেন/ খলচরিত্রে অভিনয় করেন। জীবনের শেষ বছরগুলোতে গানের চাহিদা কমে যাওয়ায় ঘরমুখো হয়ে গেলেন। কখনও পাড়ার তরুণদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন, কখনও সাঁতার কেটে পুকুরে/ সুইমিংপুলে দাপিয়ে বেড়াতেন যা ছিল তাঁর নিরহংকার , সহজ ,সরল মনেরই বহিঃপ্রকাশ। অথচ তাঁর চেয়ে অনেক অনেক জুনিয়র শিল্পী, এই প্রজন্মের শিল্পীরা আজ টাকার উপরে ঘুমায়, ভক্তদের দেখলে সুপারস্টার ভাব নিয়ে চলে, ভক্তরা যাদের ধারেকাছে যেতে পারেনা এরাই আজকের সঙ্গীতের বাহক ও ধারক হয়ে আছে যা গুরু জীবিত অবস্থায় দেখে গেছেন। সেই জন্য গান থেকে দূরে সরে ছিলেন। কখনও কখনও কেউ মনে করে গানের আমন্ত্রন জানাতে গেলে তাঁদের সেই আবেদনে অতি অল্পটাকায় গান পরিবেশনা করে এসেছেন। জীবনে যিনি শুধু নিঃস্বার্থ ভাবে দিয়ে গেছেন বিনিময়ে নিজের জীবনের শেষ রোগ ‘লিভার ক্যানসার’এর চিকিৎসার পুরো টাকাটাও সংগ্রহ করতে পারেননি। তাকে ভালোবেসে তাঁর প্রিয় কাছের শিল্পীরা, ছোট ভাইয়েরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে টাকা যোগাড় করেছেন যাদের মধ্য ছিল জীবন্ত কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চু, ফকির আলমগীর, কবির বকুল, কুমার বিশ্বজিৎ, পার্থ বড়ুয়া,প্রিন্স মাহমুদ, মনি জামান সহ তাঁর কাছের ও স্নেহের শিল্পীরা। যারা অত্তান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বিদেশে প্রথম পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য ১৫ লাখ টাকার মতো যোগাড় করে দিয়েছিলেন। সেই চিকিৎসা শেষে সম্পূর্ণ চিকিৎসা শেষ না করেই একটু সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ টেলিভিশন এর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে সর্বশেষ নতুন গান ” আমি বাংলাদেশের আজম খান ” পরিবেশনা করেন যার কথা,সুর ও সঙ্গীত ছিল সিম্ফনি ব্যান্ড এর মনি জামান এর । এরপর গুরু আবার ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যার জুন এর ২০.২০১১ তারিখের দিকে আবারো দেশের বাহিরে ২য় পর্যায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য যাওয়ার কথাছিল। অথচ তখনও বিদেশে চিকিৎসার জন্য ১৫ লাখ টাকা যোগাড় হয়নি। কাছের মানুষগুলো হন্য হয়ে বিভিন্ন জনের কাছে টাকা যোগাড় করতে ধরনা দিয়ে যাচ্ছিল আর অন্যদিকে অসুস্থ গুরু আজম খান হাসপাতালে শুয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে ছিলেন। কাছের মানুষগুলোর দিক্বিদিক ছুটোছুটি করতে দেখে গুরু কিছু বলতে পারছিলেন না, বলার সেই শক্তি তাঁর ছিলনা। তাই তো সবার ছুটোছুটি বন্ধ করতে আর অকৃতজ্ঞ বাংলার মানুষের কাছে পরাজিত না হয়ে চুপচাপ অভিমানে বিদায় নিলেন ৫ই জুন ২০১১ তে। শেষ হয়ে গেলো বাংলার এক সংগ্রামী শিল্পীর জীবন। যিনি সারাটা জীবন বাংলার মানুষকে সর্বোপরি বাংলার সঙ্গীত এর ভাণ্ডারে দু হাতে দান করে ভাণ্ডারকে পূর্ণ করে গেছেন। যার বিনিময়ে শুধুমাত্র কবরে শায়িত হবার আগে সরকার তথা বাংলাদেশের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নামক ‘সেনা বাহিনীর’ বন্দুক উপরে তুলে তিনটা ফাঁকা আওয়াজ এর তোপধ্বনি , বন্দুক কাঁধের নিচে নামিয়ে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো পুষ্প সজ্জিত কফিনের সামনে জাতীয় সঙ্গীতের সুরের ধ্বনি শুনে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। এইটুকু দিয়েই আমরা পুরো জাতি আজম খানের ঋণ পরিশোধ করে দিলাম। বড় চমৎকার এক জাতি আমরা!!!
গুরু তোমার এই অকৃতজ্ঞ বাংলার মানুষদের তুমি ক্ষমা করে দিও। জীবনে যেমন করে সব হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলে। নাহলে যে তোমার আত্মার কষ্টে বাংলার গানে কালো ছায়া পড়বে যা ধীরে ধীরে সবাইকে গ্রাস করে ফেলবে যা তুমি কোনদিন চাওনি…… তোমাকে কষ্ট দেয়ার কারনে আজ বাংলার গান এর এক দুঃসময় চলছে ………… যা দেখলে তুমি কষ্ট পেতে। প্লিজ গুরু তুমি আমাদের অক্ষমতা ও ভুলগুলো ক্ষমা করে দাও………ক্ষমা করে দাও………ক্ষমা করে দাও ।।

এবার অন্য প্রসঙ্গঃ পপসম্রাট প্রিয় গুরু আজম খানের মৃত্যু আমাকে প্রচণ্ড ভাবে একটি মানসিক ধাক্কা দেয় যার কারনে ৬ই জুন ২০১১ তে “প্রথম আলোর বন্ধুসভা” ব্লগ ও এই ‘সামু’ ব্লগে গুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি কবিতা দিয়ে প্রকাশ করেছিলাম যেটি ছিল আমার সামু ব্লগের প্রথম লিখা বা পোস্ট – গুরুকে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি – যার কথাগুলো ছিল- গুরু’কে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি

একদিন যখন পৃথিবীর বুক
জেগেছিল এক নতুন ধারার গানে
বাংলা’তখনো গাইতো না
সেই গান পুরনোদের টানে
তখনি এক দামাল ছেলে
সেই গানকেই নিলো তুলে
তাঁর মনে প্রানে ।

শুনলো সেইদিন বাংলার মানুষ
এক আগুন ঝরা গান
উঠলো জেগে ঘরে ঘরে
সব বাংলার নওজোয়ান।
সেদিন থেকে সেই ছেলেকে
সবাই ‘গুরু’বলে ডাকে
আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব
দেখলো অবাক চোখে
সবাই’কে শুধু দিয়েই গেলো
একজীবনে না কিছুই পেলো!
নিঃস্ব হয়েও গেয়ে যেত
প্রতিদিন জীবনের জয়গান
পেলোনা তো কোনদিনও
তাঁর প্রাপ্য সম্মান।
সেই ছেলেটাই আজকে নিলো
পৃথিবী থেকে ছুটি
তাঁর কথা মনে করে
অশ্রু ভরা আমার নয়ন দুটি।
সারাজীবন বয়েই গেলো
এক নিরব অভিমান,
তিনি মোদের আর কেউ নয়
একজনই গুরু ‘আযম খান’

তারপরেও কিছুতেই মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না। বারবার খুঁজতে লাগলাম গুরুর অপরাধ কি ছিল? কেন তাকে এমন কষ্ট নিয়ে অভিমানে চলে যেতে হলো? তিনি তো কাউকে ঠকাননি! কারো সাথে প্রতারণা করেননি! সারাটাজীবন নির্লোভ মানুষের মতো সহজ সরল জীবন যাপন করেছেন। অর্থ- বিত্তের পেছনে ছুটে ভক্তদের ছেড়ে যায়নি। দারিদ্র্যর সাথে লড়াই করে গেছেন সব সময়! অথচ আজকে যেসব নবীন শিল্পীদের সিডি বাজারে লাভের মুখ দেখেনা ,যেখানে মানুষ পয়সা ছাড়াই গান শুনতে ও সংগ্রহ করতে পারে তাঁরা কাউকে তো দারিদ্র্যর সাথে যুদ্ধ করতে দেখিনা, তাঁদের কাউকে তো নিজের গাড়ী ছাড়া রাস্তায় বের হতে দেখিনা, কেউ টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেলে তাঁদের সাক্ষাতকার হয়, তাঁরা ২/৩ টি অ্যালবাম অথবা ১/২ টি গান দিয়ে সুপারহিট তারকা হয়ে যায় আর বারবার শুধু কম্পিউটারে মিশ্রিত ডিজিটাল সুরের বেসুরো গান দিয়ে যায়!!!! কিন্তু গুরু আজম খান প্রায় ৪ দশক গান গেয়েও একটি গাড়ির মালিক হতে পারেনি, যার ক্যাসেট তৎকালীন আশি ও ৯০ দশকে স্রোতারা হুমড়ি খেয়ে কিনেছে সেই কিনা চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন !! এমন অনেক প্রশ্ন মনে এসে ভিড় করতো। সবশেষে একটি উত্তরই সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম যা হলো গুরু আজম খান ভুলবশত এই বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করে ফেলেছিলেন যার কারনে যোগ্যসম্মানটুকু এই বাংলার মানুষ দেয়নি। এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র পাপ। তিনি যদি এই বাংলায় জন্মগ্রহন না করে ইউরোপ আমেরিকা অথবা আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে জন্মগ্রহন করতেন আর সেখানে এইরুপ অবদান রাখতেন তাহলে গুরু আজম খানকে শুধু ভারত কেন সারা বিশ্ববাসী চিনতো ও জানতো। তাকে এভাবে চিকিৎসার অর্থের জন্য মানুষের দারে দারে ধরনা দেয়া লাগতো না। তাকে সবাই মাথায় তুলে রাখতো। কারন তাঁরা জানে কি করে গুণীর সম্মান দিতে হয়। কি করে গুণীকে রাখতে হয়। কি করে গুণীকে সারাবিশ্বের সব মানুষের সামনে তুলে ধরতে হয় এমনকি যুগ যুগান্তর অনাগত প্রজন্মের কাছে গুরুকে চেনানো লাগবে তাঁর সব কিছুই তাঁরা করতো যা এই বাংলার মানুষ করেনি। বুকে হাত দিয়ে এই নতুন প্রজন্মের কয়টা তরুন যুবক বলতে পারবে যে তাঁর কাছে পপসম্রাট গুরু আজম খানের সব গান আছে? সব গান সে শুনেছে? কেউ পারবেনা। কারন এই প্রজন্ম কোথা থেকে সেইসব গান শুনবে যে পপগুরুকে তাঁরা চিনবে জানবে? কে দিবে তাঁদের পপগুরুর সব গান? পপগুরু পুরনো সব অ্যালবাম তো বাজারেই নাই, যেখানে ৯০ দশকের সব অ্যালবামই পাওয়া যায়না সেখানে ৮০র দশকের অ্যালবাম খোঁজা তো বোকামি? কেউ কি সংরক্ষন করে রেখেছে ? এমন কাউকে বা কোন ওয়েবসাইটকেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর জন্যই তো আজকে বাংলাদেশে ‘ডিস্ক বান্দর এর গান হয় আর বিদেশের ‘কলাভেরি’ গান নিয়ে হয় মাতামাতি। যেখানে গুরুর চিকিৎসার জন্য টাকা যোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছে তাঁর আপনজনেরা সেই দেশের মানুষেরাই ৫০ কোটি টাকা দিয়ে শাহরুখ ও তাঁর নর্তকীর দলকে দিয়ে বাংলাদেশের এলিট শ্রেণীর মনোরঞ্জন এর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে!!!!! হায়রে দেশ! হায়রে জাতি! এতো অধপতনের মুল কারন আমাদের দেশের সংস্কৃতি ,দেশের সম্পদকে না জানা, না শোনা। তাই অনেক ভেবেচিন্তে গুরুর মতো গান দিয়ে একটি যুদ্ধ শুরু করলাম এই দেশের ঘুমিয়ে থাকা ,ভুল পথে থাকা, বিদেশের মায়াজালে আচ্ছাদিত থাকা বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তোলার। তাই ১০ই জুলাই ২০১১ তে শুরু করলাম গুরুকে স্মরণ করেই ও সাথে নিয়েই একটি যুদ্ধ যার নাম দিয়েছিলাম ‘RaDiO bg24’ (রেডিও বাংলার গুরু২৪) যেখানে থাকবে বাংলার সব হারানো দুর্লভ গান এবং আমাদের সব কিংবদন্তির গান যাদের জন্য আমরা আজ গর্বিত। যা গড়ার পেছনের আসল গল্প এতদিন কাউকে জানতে দেইনি, কাউকে বলিনি। কেউ জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেতাম। ব্লগে অনেক ব্যান্ড তারকার গল্প লিখেছিলাম কিন্তু গুরুকে নিয়ে গত একটি বছর কিছুই লিখিনি আজ লিখবো বলে এই আশায়। শুধুমাত্র এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। যেদিন প্রিয় পপসম্রাট গুরু আজম খান এর মৃত্যু দিবস আসবে সেদিন বুকের ভেতর থাকা সব সত্য ,সব ক্ষোভ সবাইকে বলবো! এই একটি বছর নিজের সংগ্রহে থাকা সব ঘুমিয়ে যাওয়া ,নষ্ট হয়ে যাওয়া অডিও ক্যাসেটগুলোকে ঠিক করতে লাগলাম আর সবার কাছে পৌঁছে দিতে লাগলাম রাত জেগে জেগে। গত ৩৬৫ টি রাতের মধ্য দুর্ঘটনা বশত হাতে গোনা ৭/৮ রাত ছাড়া এমন কোন রাত নেই যে আমি ভোর চারটার আগে ঘুমাতে গিয়েছি। অথচ প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ৯/১০ টা পর্যন্ত আমাকে জীবনের প্রয়োজনে নিজ কাজে বের হতে হয়, ফিরে এসে কোন বিশ্রাম ছাড়াই বন্ধুদের একের পর এক গান দিয়ে গেছি। যা আজ কোন আজ পর্যন্ত কোন ওয়েবসাইটে ছিলনা, ছিলনা বাজারে। এবং বন্ধুদের সাথে সবসময় আন্তরিক ছিলাম। ইচ্ছা ছিল এবং আছে বাংলা গান দিয়ে সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে। ভেবেছিলাম এই নবজাগরণে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা পাবো। কিন্তু না! আমার সেই ধারনা আজ এক বছর পর মিথ্যে হতে যাচ্ছে যা ভেবে খুব কষ্ট পাই কিন্তু নিজের পথ থেকে সরে দাঁড়াইনি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সরে দাঁড়াবো না এই আমার ওয়াদা। আমার সাথে সহযোগিতায় কেউ আসুক আর আসুক আমি আমার কাজ করে যাবোই। কারন এ মার গুরুর শিক্ষা। পপসম্রাট এর কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা। গুরু চাইতেন সবাই সব কাজে অংশহন করুক, সবাইকে মিলে গুরু কিছু করার চেষ্টা করতেন। গুরুর সেই ধারনা থেকে আমিও সবার কাছে ওয়েবসাইট খোলার জন্য এবং আরও বড় পরসিরে আমাদের বাংলা গান ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রম এর জন্য সবার কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলাম কিন্তু হাতে মাত্র ৫ জন ব্যক্তি ছাড়া গত প্রায় একমাসে একজন ব্যক্তিও এগিয়ে আসেনি। যা দেখে খুব কষ্ট পাই। আমি শুধু দেখলাম যে আসলে সবাই এগিয়ে আসে কিনা? এখনও সবাই বাংলাদেশর জন্য অতি নগণ্য কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারে কিনা ? অন্য কিছু নয়। কেউ সাহায্য করুক আর নাই করুক গুরুর মৃত্যুর পর যে কাজটি করা শুরু করেছিলাম সেই কাজ চলছে এবং চলবে ইনশাল্লাহ। আজ নয় কাল আমি আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সব কিছু করে যাবো ইনশাল্লাহ। বিনিময়ে কোন বন্ধুর কাছ থেকে কিছু চাইবো না। শুধু সবার কাছে একটাই অনুরোধ বলেন বা দাবী বলেন সেটা হলো এই বাংলাদেশকে সত্যি সত্যি ভালবাসতে শিখুন। সত্যি সত্যি এই দেশের সবকিছুকে ভালবাসুন, ভালবাসুন এবং ভালোবাসুন। আমাদের দেশ অনেক দুখী, ভালোবাসা দিয়ে এমন কিছু করুন যেন এই দেশের প্রতি স্রদ্ধায় অবনত হয়ে যায় পুরো বিশ্ব ও পুরো বিশ্ববাসী। গুরুর এই মৃত্যুদিবসে সকলের কাছে শুধু আমার এই আহবান । Source: Somewhereinblog.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.