পপ গুরু আযম খান
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুরকার, গীতিকার ও গায়ক – সবকিছু ছাপিয়ে তিনি পপ সম্রাট বা পপ গুরু হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি আযম খান। আযম খানকে নতুন করে পরিচয় করে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই শুধু জন্মদিনে তাকে আমরা শ্রদ্ধাভারে স্মরণ করছি। তিনি রেখে গেছেন তাঁর সংগ্রামী জীবনের অনন্য কীর্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বীর সেনানীকে হারিয়ে শোকাহত আজ সমগ্র জাতি। দেশজ লোকসংগীত, পল্লিগীতি, আধুনিক অথবা সমাজ সচেতন গানের সাথে পপ শৈলীর মিশ্রণ দিয়ে গানের এক বিরাট সম্ভার রেখে গেছেন তিনি৷
আজম খান ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক৷ বাংলাদেশে পপ সংগীতের অন্যতম পথপ্রদর্শক৷ তাঁর চটুল পপ আঙ্গিকের সংগীত বাংলাদেশের যুব সমাজের কাছে পেয়েছে বিপুল সমাদর৷ শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা উপ মহাদেশেও আজম খান পেয়েছেন অসাধারণ জনপ্রিয়তা৷
জনপ্রিয় গায়ক আজম খান ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জম্মগ্রহণ করেন। পপ ও ব্যান্ডসঙ্গীতের এই অন্যতম অগ্রপথিককে ‘গুরু’ নামে ডাকা হয়। বাংলা লোকসঙ্গীত, আধুনিক ও সমাজ সচেতন গানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের পপরীতির স্বার্থক সম্মিলন ঘটিয়েছেন তিনি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাতে অস্ত্র তুলে নেন তিনি ৷ স্বাধীনতার পর অস্ত্র ফেলে কন্ঠে তুলে নেন সংগীত৷ আজম খান ষাটের দশকে সঙ্গীত জগতে পা রাখেন। এ সময় তিনি ক্রান্তি সঙ্গীত গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। নতুন ধরনের সঙ্গীত নিয়ে ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু ও মনসুর গিটারে, সাদেক ড্রামে এবং নিজেকে প্রধান ভোকাল করে ব্যান্ডটি গড়েন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি প্রচার হলে দেশব্যাপী প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা পান। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে টেলিভিশনে ‘বাংলাদেশ’ (রেললাইনের ওই বস্তিতে) গানটি গেয়ে হৈচৈ ফেলে দেন। তার পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম হার্ডরক ধারা প্রবর্তন করেন তিনিই। ‘জীবনে কিছু পাবো না’-এমনই একটি হার্ডরক। আজম খানের অন্যান্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’ ইত্যাদি।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করেন আজম খান৷ ১৭টিরও বেশি হিট গানের এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল তার। ‘গডফাদার’ নামের একটি চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছাড়াও তিনি বেশকিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হন। ক্রিকেট খেলা ছিল তার খুবই প্রিয়। তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন ১৯৯১সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। এছাড়াও তিনি দেশের বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ৪১ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটে তিনি ছিলেন একজন অলরাউন্ডার।
খুব সহজ সরল জীবন যাপন করতেন আজম খান। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের সংগে লড়াই করে অবশেষে ২০১১ সালের ৫ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা পপ সংগীতের এক পথ প্রদর্শক আজম খান।
আজম খান
আজম খান | |
---|---|
জন্ম | ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ সাল ১০নং সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনি, ঢাকা |
মৃত্যু | ৫ই জুন, ২০১১ সাল ঢাকা, বাংলাদেশ |
পেশা | সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার |
যে জন্য পরিচিত | পপ সম্রাট,গুরু |
আজম খান (জন্ম: ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০; মৃত্যু: ৫ই জুন, ২০১১, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ঢাকা) একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশী গায়ক। তাঁর পুরো নাম “মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান”। তাঁকে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একজন অগ্রপথিক বা গুরু হিসেবে গণ্য করা হয়।[১] আজম খানের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে – বাংলাদেশ (রেল লাইনের ঐ বস্তিতে), ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে ইত্যাদি। সর্বোপরি তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় সংঘটিত কয়েকটি গেরিলা অভিযানে তিনি অংশ নেন। প্রথম কনসার্ট প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭২ সালে।
পরিচ্ছেদসমূহ
ছেলেবেলা
আজম খান ১৯৫০ সালে আজিমপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম “মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান”, মা “জোবেদা খাতুন”। সেখানে তারা ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। তার বাবা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিত্সক ছিলেন। তার তিন ভাই ও এক বোন ছিল। বড় ভাই “সাইদ খান” (সরকারি চাকরিজীবী), মেজো ভাই “আলম খান” (সুরকার), ছোট ভাই “লিয়াকত আলী খান” (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন “শামীমা আক্তার খানম”। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাদের। সেখানে তিনি কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।[২]
মুক্তিযোদ্ধা আজম খান
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি।[৩] ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন।[৩] এর কিছুদিন পর তিনি পুণরায় আগরতলায় ফিরে আসেন। এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ।[৩] আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি–গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত “অপারেশান তিতাস“। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল), হোটেল পূর্বাণী’র গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যা পরবর্তীতে তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।[১]
গায়ক আজম খান
আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে করলেন অনুষ্ঠান। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে সেই অনুষ্ঠানের এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে ও চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দু’টি সরাসরি প্রচার হলো প্রচার হলো। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দু’টো গান। দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাদের দল।[৩] ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। তার পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তার মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তারা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে! তিনি দাবী করেন এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক![৩]
পারিবারিক জীবন
১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে তিনি “সাহেদা বেগম” কে বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রথম সন্তানের নাম “ইমা খান” এবং দ্বিতীয় সন্তানের “হৃদয় খান” এবং তৃতীয় সন্তানের নাম “অরণী খান”। সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবনযাপন তার। আজম খান দুই মেয়ে এবং এক ছেলের জনক। এছাড়া আছেন চার ভাই ও এক বোন।
অন্যান্য ভূমিকায় আজম খান
১৯৯১—২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন।[২] তিনি গড ফাদার নামক একটি বাংলা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেল হিসেবে কাজ করেন।
মৃত্যু
পপসম্রাট আজম খান দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সাথে লড়াই করে ৫ই জুন, ২০১১ইং তারিখ, রবিবার সকাল ১০টা বেজে ২০ মিনিটে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [৪]
তথ্যসূত্র
- ↑ ঝাঁপ দাও:১.০ ১.১ The Daily Star, Rock star looks back with nostalgia.
- ↑ ঝাঁপ দাও:২.০ ২.১ প্রথম আলো, গুরুকাহিনী, প্রকাশিত হয়েছে: ০৩-১২-২০০৯
- ↑ ঝাঁপ দাও:৩.০ ৩.১ ৩.২ ৩.৩ ৩.৪ glitz.bdnews24.com, আজম খানের মুক্তিযুদ্ধ।
- ঝাঁপ দাও↑ প্রথম আলো, পপসম্রাট আজম খান আর নেই, প্রকাশিত হয়েছে:০৫-০৬-২০১১