পরিকল্পনাতেই আটকে থাকছে সমুদ্রসম্পদ আহরণ
ইসমাইল আলী ও জেসমিন মলি
সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর বিপুল উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় দেশে। সমুদ্রসম্পদ আহরণে নেয়া হয় নানা পরিকল্পনা। যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির তিন বছর পরও পরিকল্পনাতেই আটকে আছে বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ আহরণ। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিরও এক বছর পেরিয়ে গেছে। যদিও সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিজেদের ২০টি ব্লকে কাজ শুরু করে দিয়েছে মিয়ানমার।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১২ সালে। আর ভারতের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা হয় ২০১৪ সালে। এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটারে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের।
সমুদ্রসীমায় অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও সাগরে মত্স্যসম্পদ আহরণে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। যদিও সমুদ্র বিজয়ের পর সাগরে মত্স্য আহরণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়। মত্স্যসম্পদ অনুসন্ধানে উদ্যোগ নেয়া হয় মালয়েশিয়া থেকে জরিপ জাহাজ কেনার। এখনো তা দেশে আসেনি। এছাড়া গড়ে ওঠেনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিপিং কোম্পানিও। ফলে সমুদ্রে মত্স্যসম্পদ আহরণও তেমন একটা বাড়েনি।
মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে সাগর থেকে মত্স্যসম্পদ আহরণ হয় ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৩ টন। তিন বছরের ব্যবধানে মাত্র ৪৯ হাজার টন বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা পৌঁছে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৫ টনে। অথচ গত বছর ভারত-থাইল্যান্ড-মিয়ানমার-মালয়েশিয়া বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৮০ লাখ টন মাছ আহরণ করে।
মত্স্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মুহাম্মদ ছায়েদুল হক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেন, বঙ্গোপসাগরে মত্স্য আহরণ বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সামুদ্রিক মত্স্য নীতিমালাও প্রণয়ন করা হচ্ছে। এর বাইরে মত্স্যসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, কৌশল, পদ্ধতি ও আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে জরিপ জাহাজ আনার প্রক্রিয়া। এগুলো সম্পন্ন হলে সামুদ্রিক মত্স্য আহরণ অনেক বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক মাছ ধরার ট্রলার এবং উপযুক্ত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে সমুদ্রাঞ্চল থেকে মত্স্যসম্পদ আহরণ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ৬৬৪ কিলোমিটার সমুদ্রসীমার মধ্যে মাছ ধরার কাঠের ট্রলারগুলো ২৫-৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। গভীর সমুদ্রে মত্স্যসম্পদ আহরণে ‘ডিপ সি ফিশিং ভেসেল’ ও ‘লং-লাইন শিপ’ সংগ্রহেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ও মত্স্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হোসেইন জামাল বলেন, প্রথমেই প্রয়োজন সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা নির্ধারণ করা। আধুনিক জরিপ জাহাজের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব কাজটি করতে হবে। জরিপ জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ আরো আগে নেয়া হলেও এখনো কেন কাজ শুরু হয়নি তা বোধগম্য নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্লু-ইকোনমির যে দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে, টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে তা কাজে লাগাতে হবে।
একই অবস্থা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির পর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েক দফা দরপত্র ডাকে পেট্রোবাংলা। একাধিকবার দরপত্র ডাকার পর অগভীর সমুদ্রের ১২টি ব্লকের মধ্যে ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে কাজ পেয়েছে ভারতের ওএনজিসি। ৭ নম্বর ব্লকে কনোকোফিলিপস মনোনীত হলেও পরবর্তীতে চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। আর ১১ নম্বর ব্লকে সান্তোস ও কৃশ এনার্জি যৌথভাবে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।
গ্যাসের দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সম্প্রতি গভীর সমুদ্রের দুটি ব্লক ছেড়ে দিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি কনোকোফিলিপস। যদিও গভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান চালিয়ে একটি গ্যাস স্তর খুঁজে পেয়েছিল তারা।
গভীর সমুদ্রে সর্বশেষ গত মার্চে দরপত্র আহ্বান করা হলে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এপ্রিলেই নির্বাচিত দর প্রস্তাবকারীর সঙ্গে চুক্তি করার কথা ছিল। দরপত্র মূল্যায়ন করে নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস ও ফ্রান্সের সক্লামবার কনসোর্টিয়ামকে কাজ দেয়ার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত করা হয়। চুক্তির পর জরিপ শেষ করার সময়সীমা ধরা হয় ২০ মাস। আর জরিপের ফল ইতিবাচক হলে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম দফা দরপত্রে নির্বাচিত ওই কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর না করে তা বাতিল করা হয়। এখন বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপের জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা।
গত ২০ অক্টোবর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের টাস্কফোর্সের এক সভায় দেশের সমুদ্রাঞ্চলে অগভীর অংশের পশ্চিমভাগে এবং গভীর সমুদ্রের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ‘মাল্টি-ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে’-এর বিষয়ে আলোচনা হয়। এজন্য পেট্রোবাংলাকে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের নির্দেশ দেয়া হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, তথ্য না থাকার কারণে একাধিকবার দরপত্র ডেকেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। আগামী দেড় বছরের মধ্যে বহুমাত্রিক জরিপ শেষ হবে। এর পর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়বে। এজন্য সিসমিক জরিপ পরিচালনায় দরপত্র আহ্বানে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বারবার ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বলে জানান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম। তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমরা। বহুমাত্রিক জরিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরো অনেক আগেই এটি করা উচিত ছিল। জরিপের প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। তাই কোনোভাবেই আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনেকটাই এগিয়ে গেছে মিয়ানমার। সমুদ্র থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২০টি ব্লকে এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা। অগভীর সমুদ্রে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে— যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলীয় কোম্পানি বিজি এশিয়া প্যাসিফিক অ্যান্ড উডসাইড এনার্জি, মার্কিন কোম্পানি শেভরন, ভারতের অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড, অস্ট্রেলিয়ার আরওসি অয়েল অ্যান্ড ট্যাপ অয়েল, নেদারল্যান্ডসের বারলাঙ্গা হোল্ডিং, অস্ট্রেলিয়ার ট্রান্সকন্টিনেন্টাল গ্রুপ এবং ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। আর গভীর সমুদ্রে আছে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলীয় কোম্পানি বিজি এশিয়া প্যাসিফিক অ্যান্ড উডসাইড এনার্জি, যুক্তরাজ্যের অফির এনার্জি পিএলসি, নেদারল্যান্ডসের শেল মিয়ানমার এনার্জি অ্যান্ড মোয়েকো, নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ কোম্পানি স্ট্যাটঅয়েল অ্যান্ড কনোকোফিলিপস, ইতালির ইনি মিয়ানমার এবং ফ্রান্সের টোটাল ইঅ্যান্ডপি মিয়ানমার। সূত্র: বণিক বার্তা ।