পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ ভারত

আবুধাবি (বাসস) : পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ১৪তম আসরের ফাইনালে উঠলো গেলবারের রানার্স-আপ বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের সুপার ফোরের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে ৩৭ রানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে টাইগাররা। আগামী শুক্রবার ভারতের বিপক্ষে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামবে মাশরাফির দল।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ম্যাচে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করে ২৩৯ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৯৯ রান করেন মুশফিক। এছাড়া মোহাম্মদ মিথুন ৬০ ও মাহমুুদুল্লাহ ২৫ রান করেন। জবাবে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২০২ রান করতে পারে পাকিস্তান। মুস্তাফিজুর ৪৩ রানে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নেন।

জিতলেই ফাইনালে। কিন্তু ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে নামার আগেই বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ছাড়া একাদশ সাজাতে হয় টাইগারদের। আঙ্গুলের ইনজুরির কারনে এ ম্যাচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন সাকিব। পাশাপাশি আরও দু’টি পরিবর্তন নিয়ে খেলতে নামে বাংলাদেশ। বাঁ-হাতি স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু ও নাজমুল হোসেন শান্ত’কে একাদশে রাখেনি বাংলাদেশ। তাই তাদের পরিবর্তে একাদশে জায়গা পান দুই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান মোমিনুল হক-সৌম্য সরকার ও ডান-হাতি পেসার রুবেল হোসেনের।

সাকিবকে হারানোর ধাক্কা সাথে নিয়ে টস লড়াইয়ে নামেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। এই লড়াইয়ে জয় পান মাশরাফি। দলের ব্যাটসম্যানদের নির্ভার হয়ে খেলার সুযোগ করে দিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন ম্যাশ। কিন্তু অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিতে পারেনি বাংলাদেশের টপ-অর্ডার।

লিটন দাসের সাথে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন এশিয়া কাপের মাঝপথে দলে সুযোগ পাওয়া সৌম্য সরকার। ইনিংসের তৃতীয় ওভারের পঞ্চম বলে প্যাভিলিয়নে ফিরেন তিনি। পাকিস্তানের বাঁ-হাতি পেসার জুনাইদের শিকার হয়ে শুন্য রানে ফিরতে হয় সৌম্যকে।

এরপর প্যাভিলিয়নে সৌম্যর সঙ্গী হন আরেক ওপেনার লিটন ও তিন নম্বরে ব্যাট হাতে নামা মোমিনুল হক। পাকিস্তানের আরেক বাঁ-হাতি পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদির স্টাম্পের ডেলিভারিতে বলের লাইনে পা নিতে না পেরে বোল্ড হন মোমিনুল। ১টি বাউন্ডারিতে ৪ বলে ৫ রান করেন তিনি।

মোমিনুলের মত একইভাবে আউট হন লিটনও। তবে লিটনকে শিকার করেন জুনায়েদ। ১৬ বল মোকাবেলা করে ৬ রান করেন লিটন। এ সময় ৪ দশমিক ২ ওভারে ১২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যায় বাংলাদেশ।

এই অবস্থায় দলকে খেলায় ফেরানোর দায়িত্ব নেন সাবেক অধিনায়ক মুশফিক ও মিথুন। প্রতিপক্ষ বোলারদের দেখে শুনে খেলে স্কোর বোর্ডকে শক্তপোক্ত করতে থাকেন তারা। ফলে ২৫তম ওভারে শতরানে পৌঁছায় বাংলাদেশের স্কোর। সেটি পরবর্তীতে আরও বড় হয়েছে। ৩৩তম ওভারে দেড়শ রানের কোটা স্পর্শ করে টাইগাররা। এ সময় মুশফিক ও মিথুন, দু’জনই হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন।

মুশফিক ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩০তম ও মিথুন দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান। চলমান টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন মিথুন। অর্ধশতকের পর নিজের ইনিংসটাকে ৬০ রানে বেশি বড় করতে পারেননি। পাকিস্তানের ডান-হাতি পেসার হাসান আলীর বলে আউট হন তিনি। মিথুনকে ফিরিয়ে মুশফিক-মিথুন জুটি ভাঙ্গেন হাসান। ততক্ষণে চতুর্থ উইকেটে জুটি বেঁেধ ১৭৬ বলে ১৪৪ রান যোগ করেন তারা। ফলে ১৯৯৭ সালে কলম্বোতে পাকিস্তানের বিপক্ষে চতুর্থ উইকেটে আকরাম খান ও আতাহার আলী খানের করা ১১০ রানের জুটির রেকর্ডটি ভেঙ্গে যায়।

মিথুনের বিদায়ে ক্রিজে আসেন গেল ম্যাচে অপরাজিত ৭২ রানের নান্দনিক ইনিংস খেলা ইমরুল। এবার আর নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। ১০ বলে ৯ রান করেন ইমরুল।

এরপর মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে আবারো বড় জুটির চেষ্টা করেন মুশফিক। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রানের গতি ধরে রেখেছিলেন তারা। ফলে ক্যারিয়ারের সপ্তম ও এবারের আসরে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দিকেই এগোচ্ছিলেন মুশফিক। কিন্তু সেঞ্চুরি থেকে ১ রান দূরে থাকতে আউট হন মুশি। ক্যারিয়ারে এই তৃতীয়বারের মত নাভার্স-নাইন্টিতে ফিরলেন মুশফিক। আগের দু’টি ইনিংস ছিলো- ৯৮ ও ৯০। ৯টি চারে ১১৬ বলে ৯৯ রান করেন মুশফিক।

দলীয় ১৯৭ রানে মুশফিকুরের বিদায়ের পর মেহেদি হাসান মিরাজকে নিয়ে দলের চাকা ঘুড়াচ্ছিলেন মাহমুদুল্লাহ। ফলে লড়াকু স্কোরের দিকেই এগোচ্ছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু ২৩০ রানের মধ্যে মাহমুদুল্লাহ ও মিরাজকে বিদায় দিয়ে বাংলাদেশের রান তোলার পথ কঠিন করে তুলেন পাকিস্তানের জুনায়েদ খান। তারপরও শেষদিকে দলকে আড়াইশ রানের কাছাকাছি নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। ১টি ছক্কাও মারেন তিনি। কিন্তু ৪৯তম ওভারের পঞ্চম বলে থেমে যেতে হয় ম্যাশকে। ফলে ২৩৯ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশও। ১৩ বলে ১৩ রান করেন মাশরাফি। মাহমুদুল্লাহ ২৫ ও মিরাজ ১২ রান করেন। পাকিস্তানের জুনাইদ ১৯ রানে ৪ উইকেট নেন।

২৪০ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমেই বাংলাদেশ বোলারদের তোপের মুখে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। ইনিংসের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে ওপেনার ফখর জামানকে তুলে নেন বাংলাদেশের অফ-স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ। অবশ্য জামানকে ফেরাতে বড় ভূমিকা রাখেন রুবেল হোসেন। মিড-অনে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন তিনি।

পরের ওভারে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় উইকেট এনে দেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। তিন নম্বরে ব্যাট হাতে নামা বাবর আজমকে ১ রানে থামিয়ে দেন তিনি। ৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় পাকিস্তান। সেখান থেকে ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন পাকিস্তানের আরেক ওপেনার ইমাম উল হক ও অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। ২টি বাউন্ডারিতে বাংলাদেশের উপর আক্রমনাত্মক হবার ইঙ্গিত দেন সরফরাজ। কিন্তু সরফরাজকে ভয়ংকর হবার আগেই বিদায় দেন মুস্তাফিজ। দুর্দান্ত কাটারে সরফরাজকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন ফিজ। মুশফিকের তালুবন্দি হওয়ার আগে ৭ বলে ১০ রান করেন সরফরাজ।

১৮ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর পাকিস্তানের পালে রানের হাওয়া যোগান ইমাম ও শোয়েব মালিক। বাংলাদেশ বোলারদের দেখেশুনে খেলে রানের চাকা সচল রাখেন তারা।এই জুটির কল্যাণে শতরানের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো পাকিস্তান। কিন্তু এমন সময় মালিককে আউট করে এই জুটিতে ভাঙ্গন ধরান রুবেল হোসেন। অবশ্য এই আউটের পেছনে বড় অবদান মাশরাফির। রুবেলের বলের সুপারম্যানের মত ঝাপ দিয়ে মিড-উইকেটে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ৫১ বলে ৩০ রান করেন মালিক।

মালিকের ফিরে যাবার পর উইকেটে গিয়ে বেশিক্ষণ ঠিকতে পারেননি শাদাব খান। অকেশনাল বোলার সৌম্য সরকারের শিকার হন তিনি। ৪ রান করে শাদাব সাজ ঘরে ফিরে গেলে ৯৪ রানে পঞ্চম উইকেট হারায় পাকিস্তান।

ষষ্ঠ উইকেটে আবারো বড় জুটির চেষ্টা করেন ইমাম। সঙ্গী হিসেবে সাথে পান আসিফ আলিকে। দ্রুত উইকেটে সেট হয়ে ইমামের সাথে রান তোলার কাজটা ভালোই করছিলেন আসিফ। তাতে লড়াইয়ে ফিরে পাকিস্তান। কারন ৩৯ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ১৬৫ রানে পৌঁছে যায় পাকিস্তান। এ অবস্থায় ম্যাচ জিততে ১১ ওভারে ৭৫ রান প্রয়োজন পড়ে পাকিস্তানের।

কিন্তু ৪০তম ওভারে আক্রমনে এসে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেক-থ্রু এনে দেন মিরাজ। ৩১ রান করা আসিফকে ফেরান তিনি। ইমামের সাথে ষষ্ঠ উইকেটে ৭১ রান যোগ করেন আসিফ। পরের ওভারে বাংলাদেশের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। পাকিস্তানের আশা ভরসার শেষ প্রতীক ইমামকে আউট করেন মাহমুদুল্লাহ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় হাফ-সেঞ্চুরি তুলে উইকেটে সাথে সখ্য গড়ে তোলা ইমাম থামেন ৮৩ রানে। ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ১০৫ বলে নিজের ইনিংসটি সাজান ইমাম।

দলীয় ১৬৭ রানে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ইমামের বিদায়ের পর ম্যাচের লাগাম পুরোপুরিভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে ৯ উইকেটে ২০২ রানের বেশি করতে দেয়নি বাংলাদেশ। ম্যাচ জিতে ফাইনালে নাম লেখায় টাইগাররা। মুস্তাফিজ ৪৩ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট শিকার করেন। এছাড়া ্ মিরাজ ২টি, রুবেল-মাহমুদুল্লাহ-সৌম্য ১টি করে উইকেট নেন।

স্কোর কার্ড :

বাংলাদেশ ইনিংস :

লিটন দাস বোল্ড ব জুনাইদ ৬

সৌম্য সরকার ক জামান ব জুনাইদ ০

মোমিনুল হক বোল্ড ব শাহিন ৫

মুশফিকুর রহিম ক সরফরাজ ব শাহিন ৯৯

মোহাম্মদ মিথুন ক এন্ড ব হাসান ৬০

ইমরুল এলবিডব্লু ব শাদাব ৯

মাহমুদুল্লাহ বোল্ড ব জুনাইদ ২৫

মেহেদি হাসান মিরাজ ক শান ব জুনাইদ ১২

মাশরাফি বিন মর্তুজা ক জামান ব হাসান ১৩

রুবেল হোসেন রান আউট (হাসান) ১

মুস্তাফিজ অপরাজিত ০

অতিরিক্ত (লে বা-৮, ও-১) ৯

মোট : (অলআউট, ৪৮.৫ ওভার) ২৩৯

উইকেট পতন : ১/৫ (সৌম্য), ২/১২ (মোমিনুল), ৩/১২ (লিটন), ৪/১৫৬ (মিথুন), ৫/১৬৭ (ইমরুল), ৬/১৯৭ (মুশফিকুর), ৭/২২১ (মিরাজ), ৮/২৩০ (মাহমুদুল্লাহ), ৯/২৩৯ (রুবেল), ১০/২৩৯ (মাশরাফি)।

পাকিস্তান বোলিং :

জুনাইদ : ৯-১-১৯-৪ (ও-১),

শাহিন : ১০-১-৪৭-২,

হাসান : ৯.৫-০-৬০-২,

নওয়াজ : ৮-০-৩৯-০,

মালিক : ২-০-১৪-০,

শাদাব : ১০-০-৫২-১।

পাকিস্তান ব্যাটিং :

ফখর ক রুবেল ব মিরাজ ১

ইমাম স্টাম্পড লিটন ব মাহমুদুল্লাহ ৮৩

বাবর এলবিডব্ল্ ুব মুস্তাফিজ ১

সরফরাজ ক মুশফিক ব মুস্তাফিজ ১০

মালিক ক মাশরাফি ব রুবেল ৩০

শাদাব ক লিটন ব সৌম্য ৪

আসিফ স্টাম্পড লিটন ব মিরাজ ৩১

নওয়াজ ক শান্ত ব মুস্তাফিজ ৮

হাসান ক মাশরাফি ব মুস্তাফিজ ৮

শাহিন অপরাজিত ১৪

জুনাইদ অপরাজিত ৩

অতিরিক্ত (বা-১, লে বা-২, নো-১ ও-৫) ৯

মোট : (৯ উইকেট, ৫০ ওভার) ২০২

উইকেট পতন : ১/২ (ফখর), ২/৩২ (বাবর), ৩/১৮ (সরফরাজ), ৪/৮৫ (মালিক), ৫/৯৪ (শাদাব), ৬/১৬৫ (আসিফ), ৭/১৬৭ (ইমাম), ৮/১৮১ (হাসান), ৯/১৮৬ (নওয়াজ)।

বাংলাদেশ বোলিং :

মিরাজ : ১০-১-২৮-২,

মুস্তাফিজ : ১০-২-৪৩-৪ (ও-২),

মাশরাফি : ৭-১-৩৩-০ (নো-১),

রুবেল : ৮-০-৩৮-১ (ও-২),

মাহমুদুল্লাহ : ১০-১-৩৮-১ (ও-১),

সৌম্য : ৫-০-১৯-১।

ফল : বাংলাদেশ ৩৭ রানে জয়ী।

ম্যাচ সেরা : মুশফিকুর রহিম (বাংলাদেশ)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.