পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারে কেমন আছে মানুষ?

গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত এমন একটি এলাকা, যা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই এলাকাটি ৪১ কিলোমিটার (২৫ মাইল) দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার চওড়া। এর একদিকে ভূমধ্যসাগর, তিন দিকে ইসরায়েল এবং দক্ষিণ দিকে মিশরের সিনাই সীমান্ত।

”অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ” হিসেবে গাজা এলাকাটি কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা।

অবরুদ্ধ এই ছোট্ট এলাকাটির মধ্যে কি ভাবে দিন কাটাচ্ছেন গাজার অধিবাসীরা। কেমন জীবন তাদের?

শ’খানেক বর্গমাইল আয়তনের এই ছোট এলাকাটুকুর মধ্যে বাস করেন প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। এরা বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর। তাদের অনেকেই এখনো বাস করেন শরণার্থী শিবিরে, আর স্বপ্ন দেখেন নিজের হারানো বসতভূমি – যা এখন ইসরায়েলে – সেখানে ফিরে যাবার।

এরা বলেন, গাজা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার।

গাজায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ৫,৪৭৯ জন লোক, আগামী তিন বছরে তা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হয়।

এখানে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব খুবই বেশি। আর কঠোর সীমান্ত প্রহরা ও চেক পয়েন্ট পেরিয়ে বাইরে যাবার সুযোগও অতি সীমিত।

চিকিৎসার জন্য এখানকার লোকদের আগে মিশরে বা ইসরায়েলে যাবার সুযোগ ছিল। কিন্তু সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে তাও এখন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ওষুধ বা ডায়ালাইসিস মেশিনের মতো চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও এখন গাজায় আসা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

সীমান্ত পার হওয়ার যে কোনো রকম চেষ্টাকেই ইসরায়েল তার প্রতি সরাসরি হুমকি বলে মনে করে।

গাজার ভেতর থেকে ইসরায়েলে রকেট হামলার জবাবে তিনবার এখানে অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল। প্রতিবারই বিপুলসংখ্যক বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়েছে।

গাজায় প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। গাজাবাসী প্রতিদিন গড়ে মাত্র ছয় ঘন্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। গাজার একটি নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, তবে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আসে ইসরায়েল থেকে, আর কিছু আসে মিশর থেকে। অনেক লোক ডিজেলের জেনারেটর ব্যবহার করে – তবে তা খুবই ব্যয়বহুল। বিদ্যুতের অভাবে গাজার তিনটি হাসপাতাল এবং ১০টি মেডিক্যাল সেন্টার তাদের সেবা স্থগিত করে দিয়েছে।

গাজার লোকেরা কিছু খাদ্যসাহায্য পায়, কিন্তু তা সত্বেও এখানে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। গাজায় আবাসনের ঘাটতিও প্রকট।

সীমান্ত-সংলগ্ন প্রায় একমাইলের মতো এলাকাকে বাফার জোন ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। কাজেই ফিলিস্তিনিরা সেখানে চাষবাস করতে পারে না।

সমুদ্রে তীর থেকে একটা নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গাজার মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতেও পারেন না।

গাজা থেকে রকেট হামলা হলেই ইসরায়েল এই মাছ ধরার এলাকা কমিয়ে দেয়। আর কোনো ফিলিস্তিনি জেলে নৌকা সেই সীমার কাছাকাছি এলেই ইসরাইলি নৌবাহিনীর সৈন্যরা প্রায়ই গুলি চালায়।

গাজায় বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। মিঠা পানির বড় কোনো জলাধার নেই। গাজার বাড়িগুলোতে পাইপে যে পানি আসে তার সরবরাহও অনিয়মিত। ৯৭ শতাংশ বাড়িকেই নির্ভর করতে হয় ট্যাংকার দিয়ে সরবরাহ করা পানির ওপর।

পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা হচ্ছে আরেকটি গুরুতর সমস্যা। প্রায় ৯ কোটি লিটার বর্জ্য পাম্প করে ভূমধ্যসাগরে বা খোলা পুকুরে ফেলা হয়। ফলে গাজার পানির স্তরের ৯৫ শতাংশই দূষিত।

এরকম পরিবেশের মধ্যেই বাস করছেন গাজার লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি।

গাজার জনসংখ্যা ২০১৫ সালের ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ৩১ লক্ষে গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হয়।

গাজা এক সময় মিশরের অধিকারে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল এলাকাটি দখল করে নেয়। পরে ২০০৫ সালে ইসরায়েল এলাকাটির দখল ছেড়ে দেয়, সেখান থেকে চলে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা এবং প্রায় ৭ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারী।

এই এলাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে, তবে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গাজা শাসন করতো হামাস। হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে জয়ী হয়। কিন্তু তার পর প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সাথে তাদের সংঘাত সৃষ্টির পর তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

হামাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর খুব দ্রুত ইসরায়েল এই এলাকাটির ওপর অবরোধ আরোপ করে। গাজা ও ফিলিস্তিনের অন্য এলাকার মধ্যে লোকজন ও পণ্যের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মিশরও গাজার দক্ষিণ সীমান্তে অবরোধ আরোপ করে।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এক সংক্ষিপ্ত সামরিক সংঘাত হয় ২০১৪ সালে। ইসরায়েলের চেষ্টা ছিল গাজা থেকে রকেট হামলা থামানো , অন্যদিকে হামাসের লক্ষ্য ছিল তাদের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো।

মিশর ও গাজার মধ্যে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে সে সময় গড়ে ওঠে চোরাচালানের এক সুড়ঙ্গ (টানেল) নেটওয়ার্ক। এগুলো দিয়ে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য মিশর থেকে গাজায় ঢুকতো। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি রাফাহ সীমান্তে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে মিশর এবং সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কগুলো বন্ধ করে দেয়ার অভিযান চালায়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ২০১৪ সালে অক্টোবর থেকেই মিশর গাজা সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছে।

গাজা থেকে সীমান্ত ক্রসিং পার হয়ে ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপরও আছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে এরেৎজ ক্রসিং দিয়ে পারাপার করতো প্রতিদিন ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি। আর ২০১৭ সালের প্রথম ৬ মাসে এরেৎজ দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকেছে ২৪০ জনেরও কম।

এ রকম বন্দী অবস্থায় থেকে গাজার বাসিন্দাদের গড় আয়ও কমে গেছে। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে গাজার একজন অধিবাসীয় গড় বার্ষিক আয় ছিল ২,৬৫৯ ডলার। ২০১৮ সালে সে আয় কমে নেমে এসেছে ১,৮২৬ ডলারে।

গত বছরের এক হিসেব অনুযায়ী গাজার ৪৪% লোকই বেকার। বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশেরও বেশি।

গাজায় দারিদ্র্যের হার ৩৯%, যা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের তুলনায় দ্বিগুণ। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সামাজিক ভাতা না থাকলে এ হার আরো বেড়ে যেতো বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। ধারণা করা হয় যে গাজার ৮০% লোকই কোনো-না-কোনোভাবে সামাজিক কল্যাণভাতার ওপর নির্ভরশীল।

গাজার স্কুলগুলোর ওপর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার প্রচন্ড চাপের কারণে ৯৪% স্কুলই দু’শিফট করে চলে – একটি সকালে আরেকটি বিকালে। সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.