প্রকৃতিতে রোজার সাক্ষ্য
জিয়াউদ্দিন সাইমুম।
তথ্যটি কারো কারো কাছে অপরিচিত ঠেকতে পারে। তারপরও এটা সত্য, পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণী খাবার না গ্রহণ করেই জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করে দেয়। এতে তাদের শক্তিও কমে না, দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতায়ও সমস্যা হয় না। অনেক বিজ্ঞানী রোজাকে উপোস হিসেবে না দেখে মনোদৈহিক বিশ্রাম হিসেবেই দেখেন। আর এ জাতীয় বিশ্রাম দেহ থেকে টক্সিন বা বিষ বের হয়ে যেতে সহায়তা দেয়।
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, জীবের জীবনধারণে রোজা একটি সাধারণ অংশ নয়, অনিবার্য অংশ। তাই এটা ভাবার কোনই কারণ নেই যে, একমাত্র মানুষই রোজা রাখে, আর কেউ রাখে না। পার্থক্য শুধু এতটুকু, মানুষের রোজা উপলক্ষ বা নিয়তকেন্দ্রিক আর প্রাণীর রোজা পারিপার্শ্বিক ও শারীরিক অবস্থাকেন্দ্রিক।
শীতপ্রধান দেশে অধিকাংশ প্রজাতির কাঠবিড়ালি গাছের পরিবর্তে মাটিতে গর্ত করে থাকে। শীতকালের আগে তারা পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে গর্তে আশ্রয় নেয় এবং এ সময় তারা শীতনিদ্রায় চার থেকে আট মাস পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়। এ সময় তাদের হার্টবিট কমে যায়। চার কি পাঁচ দিন পর জেগে ওঠে এবং সঞ্চিত খাদ্য থেকে সামান্য খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
জলজ প্রাণীর মাঝেও রোজার সাক্ষ রয়েছে। বিশেষত লাল স্যামন মাছের ব্যাপারটি খুবই আগ্রহ উদ্দীপক। এ মাছ মিঠা পানিতে জন্ম নেয় অথচ চার থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নদীর মোহনায় ডিম পাড়ে। ডিম থেকে পোনা জন্ম নেয়ার পর তারা আবার সাগরের লবণাক্ত পানিতে ফিরে আসে। ফিরতে তাদের তিন-চার মাস সময় লাগে। এ সময় তারা কিছুই খায় না। এতোটা দীর্ঘ সময় এ মাছ কিভাবে না খেয়ে কাটিয়ে দেয়, তা একটি পরম বিস্ময়।
শামুকের জন্য শীতকাল যেমন বিপদজনক তেমনি গরমকালও বিপদজনক। অত্যধিক শীতে তারা চলাফেরা করতে পারে না, আবার অত্যধিক গরমে তারা ডিহাইড্রেশন সমস্যায় ভোগে। রাতে অথবা মেঘলা দিনে তারা চলাফেরা করে। অবশ্য শীতকালে তারা শীতনিদ্রায় কাটায়। এ সময় তারা কিছুই খায় না। এ সময় তারা দেহের বাড়তি চর্বি হারিয়ে ফেলে এবং আবারও কর্মতৎপর হয়ে উঠে।
কাঁটাযুক্ত অ্যান্টইটার বা ইকিডনা দেখা যায় অস্ট্রেলিয়া, তাসমেনিয়া ও নিউগিনিতে। এটা নিশাচর প্রাণী গর্তে থাকে। এ প্রাণীর দাঁত নেই। দেহটি সজারুর মতো কাঁটায় ঘেরা। এটার যেমন লম্বা থুতনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে আঁঠালো জিহবা। এ জিহবাকে সে বেশ খানিকটা বাড়াতে পারে। এরা পিঁপড়া ও পোকামাকড় খায়। এ প্রাণী ভীষণ লোভী। বেশি খাবার গ্রহণের কারণে দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমে। এ কারণে এরা মাসখানেক না খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারে।
কানাডার উপকূল প্লুভার বা টিট্টিভ পাখির মূল নিবাস। এরা পরিযায়ী পাখি। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে তিন হাজার মাইল উড়ে শীতকালে এরা আমেরিকা এসে হাজির হয়। এ দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে তারা কিছুই খায় না। ননস্টপ ওড়ার এতো শক্তি এরা কোত্থেকে পায়, তা একটি চরম বিস্ময়।
পৃথিবীতে ১৭ প্রজাতির পেঙ্গুইন রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র একটি প্রজাতি উত্তর গোলার্ধে স্থায়ীভাবে থাকে। বাকি প্রজাতি দক্ষিণ গোলার্ধ্ব, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় বাস করে। তবে বসন্তের শুরুতে এ ষোল প্রজাতির পেঙ্গুইন উত্তর মেরুতে এসে জড়ো হয়। এখানে তারা ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর পুরুষ পেঙ্গুইন সন্তানের পরিচর্যার জন্য দুই সপ্তাহ না খেয়ে থাকে। পেঙ্গুইন শিশুরাও পালক গজানোর আগ পর্যন্ত কিছু খায় না।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রকৃতিতে বেশ কিছু প্রাণীর কাছে জীবনধারণের মতো রোজাও অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা তাদের জীবনধারারই অংশ, ফ্যাশন নয়।
বিজ্ঞানীরা তথ্য দিয়েছেন, প্রজননঋতুতে পুরুষ স্যামন, পেঙ্গুইন, আলাস্কার সিল মাছ, শীতনিদ্রাকালে ব্যাজার, ভালুক, বাঁদুর, অধিকাংশ কাঠবিড়ালী ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণী ও অধিকাংশ কীট উপবাসে কাটায়। ডিমে তা দেওয়ার সময় কুমির ও কয়েক প্রজাতির ব্যাঙ, শামুক ও অনেক কীট, রূপান্তরকালে অনেক কীট, ব্যাঙাচি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। আবার বড় ধরনের আঘাত পেয়ে শারীরিকভাবে আহত হবার পরও অনেক প্রাণী খাবার খায় না। অসুস্থ অবস্থায়ও অনেক প্রাণী খাবার গ্রহণ করে না। শুধু তাই নয়, খাদ্যাভাব, খরা, বন্যা, ঝড়, তুষারপাত অথবা হিমবাহের কারণে আটকা পড়া অবস্থায়ও প্রাণীও খাবার গ্রহণ করে না।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, রাগ, উত্তেজনা অথবা শারীরিক ব্যথার সময়ও কোনো কোনো প্রাণী খাবার খায় না। ব্যথা না থাকলেও কেউ কেউ খাবার গ্রহণ করে না, বিশেষত সাপ দীর্ঘ বিরতির পর খাবার খায়। কিছু প্রজাতির মাকড়সা, অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী ও কিছু পাখি ডিম ফোটানোর পর খাবার গ্রহণ করে না। আবার বয়স বেড়ে গেলেও কোনো কোনো প্রাণী হজমক্রিয়ার সমস্যা দেখা দিলে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। আর বন্দি অবস্থায় জলজ গিরগিটি খাবার খায় না।