প্রচন্ড গরমে সুস্থ্য থাকুন……
এখন চারদিকে প্রচণ্ড গরম ও উত্তাপ। এসবের প্রচণ্ডতায় তৃষ্ণার্ত বুক যেন চৌচির হয়ে ফেটে যাওয়া ফসলের মাঠ। রোদ যেন শরীরে চাবুকের আঘাত হয়ে বিঁধে। সর্বত্র বিরাজমান এক অবসাদ ভাব। গরমের এই বৈরী প্রভাব কিন্তু সহজেই একজন মানুষকে অসুস্থ্য করে তুলতে পারে।
গরমে যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারেঃ
গরমের কারণে শরীরে প্রচুর ঘাম হয়। এ ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যায় শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান লবণ ও পানি। শরীর থেকে এই লবণ ও পানি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের রক্তচাপও কমে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে প্রস্রাবের পরিমাণও কমে যেতে থাকে। পাশাপাশি অবসাদ এসে শরীরে ভর করে। সবকিছু মিলিয়ে এক পর্যায়ে গরমের কারণে কোনো ব্যক্তি জ্ঞান হারাতে পারেন। তাছাড়া গরমের সময় ঘামাচি এবং ঘামের দুর্গন্ধও সমস্যার সৃষ্টি করে। গরমে এ অসুস্থতার পর্যায়ক্রমিক কিছু ধাপ রয়েছে।
গরমে অসুস্থতার পর্যায়ক্রমিক ধাপঃ
গরমের সময় হঠাত্ করে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন না। গরমে আক্রান্ত হওয়ার পর ক্রমেই একজন মানুষ অসুস্থ হতে থাকেন। সাধারণভাবে গরমের কারণে সৃষ্ট এ অসুস্থতাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
১ম পর্যায় : প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে সৃষ্ট সমস্যা
—প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে শরীর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
— শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
— মাংসপেশিতে খিঁচুনি বা ক্র্যাম্প হতে পারে।
—গাঢ় হলুদ বর্ণের প্রস্রাব হতে পারে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে এবং প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
এটি গরমের কারণে সৃষ্ট প্রাথমিক অবস্থা। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমূহ বিপদ এড়ানো সম্ভব।
এ অবস্থায় করণীয়
— গরমে যতটা সম্ভব রোদে চলাফেরা বন্ধ করতে হবে।
— মাথায় ছাতা ব্যবহার করা যেতে পারে।
— ঢিলেঢালা সুতি পোশাক পরিধান করতে হবে।
— সিনথেটিক এবং আঁটসাঁট পোশাক না পরাই ভালো। কারণ সিনথেটিক কাপড়ের মধ্য দিয়ে বাতাস সুবিধাজনকভাবে চলাচল করতে পারে না।
— পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। যারা কায়িক পরিশ্রমের কাজ করেন এবং যাদের বেশি ঘাম হওয়ার প্রবণতা আছে, তাদের ক্ষেত্রে পানি পানের পরিমাণ একটু বাড়িয়ে দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে ৩ লিটার পানি পান করা দরকার। গরমের সময় পানি পানের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। মোট কথা, যতক্ষণ না প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক হবে ততক্ষণ পানি পান করে যেতেই হবে।
—শরীরে ঘাম বেশি হলে সেক্ষেত্রে পানিতে খানিকটা লবণ মিশিয়ে পান করা যেতে পারে। তবে খাবার স্যালাইন পান করলে ভালো হয়।
২য় পর্যায় : উত্তাপজনিত গুরুতর অসুস্থতা
— এ অবস্থায় শরীরে প্রচুর ঘাম হয় ।
— শরীর সাধারণত ভেজা ও ঠাণ্ডা থাকবে।
— এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
— শরীর থেকে প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে লবণ-পানির অভাবে রক্তচাপ কমে যায় এবং যার ফলে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থাটিকে মারাত্মক অবস্থা বলেই গণ্য করতে হবে।
এ অবস্থায় করণীয়
— আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত ঠাণ্ডা পরিবেশে বা এসি রুমে নিয়ে যেতে হবে। কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো খোলা রুমে নিয়ে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
— শরীরের কাপড়-চোপড় যতটুকু সম্ভব খুলে দিতে হবে।
— আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে, কারণ হাসপাতালে নেয়ার পর রোগীকে শিরা পথে স্যালাইন দেয়ার প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া রোগীকে অক্সিজেন দেয়ারও দরকার পড়তে পারে।
—জ্ঞান ফিরলে রোগীকে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
৩য় পর্যায় : হিটস্ট্রোক—তীব্র গরমে মারাত্মক পরিণতি
এটি গরমের কারণে সৃষ্ট সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা। হিটস্ট্রোক হলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, এমনকি এ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
— হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়ে।
— শরীরের ত্বক তখন শুষ্ক ও গরম থাকবে, যা দ্বিতীয় পর্যায়ে ঠিক বিপরীতধর্মী উপসর্গ।
— চোখ দুটি স্থির ও ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকবে।
— এ অবস্থায় রোগীর খিঁচুনিও হতে পারে।
— শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়ার ফলে শরীর বিশেষ করে মুখমণ্ডল নীলাভ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থাকে আরও বেশি খারাপ অবস্থা বলে গণ্য করতে হবে।
— অজ্ঞান বলে রোগী প্রস্রাব-পায়খানা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই অজ্ঞান অবস্থায় রোগী পায়খানা-প্রস্রাব করে দিতে পারে।
— তাছাড়া প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গিয়ে তা কিডনির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
হিটস্ট্রোক হলে করণীয়ঃ
হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি স্প্র্রে কিংবা ঢেলে শরীর ভিজিয়ে দিতে হবে। রোগী অজ্ঞান হলেও এ কাজটি করতে হবে। রোগীর শরীরে যে পানির প্রদাহ দেয়া হবে তা ঠাণ্ডা হওয়ার দরকার নেই। পানি খুব ঠাণ্ডা হলে সমস্যা আছে। ঠাণ্ডা পানি শরীরের প্রান্তীয় রক্তনালীগুলোকে সঙ্কুচিত করে ফেলে, এতে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। আর কোথাও রক্তপ্রবাহ কম থাকা মানেই সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ কম থাকা, যা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়।
এছাড়া রোগীর শরীরের পরিধেয় যতটুক সম্ভব খুলে ফেলতে হবে এবং ঘরের ফ্যান কিংবা এসি চালিয়ে দিতে হবে। এসবের ব্যবস্থা না থাকলে পাখা দিয়ে বাতাস দিতে হবে।
এরই মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, হিটস্ট্রোক একটি মেডিকেল ইমারজেন্সি। হিটস্ট্রোকে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো খুবই জরুরি।
হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করে, বিশেষ করে নাড়িস্পন্দন (পালস), রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি দেখবেন। সেই সঙ্গে শিরাপথে স্যালাইন চালু করে উপসর্গ অনুযায়ী অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
গরমে ঘামাচিঃ
গরমে ঘামাচিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। স্বাভাবিক ঘাম তৈরি হওয়ার পর তা ঘর্মগ্রন্থি থেকে সরু নালীর মাধ্যমে ত্বকের উপরিভাগে অর্থাত্ শরীরের বাইরে চলে আসে। গরমের সময় অতিরিক্ত ঘামের চাপে ঘর্মগ্রন্থিটি কিংবা ঘাম শরীরের বাইরে বহনকারী সেই নালীটিই ফেটে যায় এবং ত্বকের নিচে ঘাম জমতে থাকে। ত্বকের নিচে জমে থাকা এ ঘামই ঘামাচি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঘামাচির বেশক’টি ধরন রয়েছে। ঘামাচি সৃষ্টির ফলে শরীর থেকে ঘাম ঠিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারে না। সেই সঙ্গে শরীরে সৃষ্ট বাড়তি তাপ বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে গরম আরও বেশি অনুভূত হয়, মাথা ঘোরায়, মাথাব্যথা করে, বমিভাব হয়, জ্বরজ্বর লাগে। সেই সঙ্গে শরীর চুলকাতে থাকে, চুলকাতে চুলকাতে ঘামাচিতে ইনফেকশন হয়ে একজিমার আকার ধারণ করে। অনেক সময় ঘামাচি বড় হয়ে ফোড়ায় রূপান্তর হয়। উল্লেখ্য, ঘামাচি কখনও লোমের গোড়াকে আক্রান্ত করবে না।
ঘামাচি হলে করণীয়ঃ
— ঠাণ্ডা পরিবেশে থাকতে হবে। তাই প্রচলিত আছে, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে গোসল করলে ঘামাচি সেরে যায়। এয়ার কন্ডিশনড্ রুম হলে ভালো হয়, তবে ফ্যানের বাতাসও উপকারী।
— দিনে কয়েকবার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করা যেতে পারে।
— বেবি ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে।
— ঢিলেঢালা সুতি জামা-কাপড় পরতে হবে। প্রয়োজনে খালি গায়েও থাকা যেতে পারে।
— ক্যালামিলন লোশন ঝাঁকিয়ে ঘামাচি-আক্রান্ত শরীরে ঘণ্টাখানেক সময় ধরে লাগিয়ে রেখে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। এরকম ৩/৪ দিনের বেশি করা যাবে না।
— ঘামাচিতে লালা ভাব দেখা দিলে কিছুদিন কিউরল অয়েন্টমেন্ট দিনে ২ বার করে ব্যবহার করে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
— আর যদি ফোড়া হয়ে যায় তখন এন্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে।
ঘামের দুর্গন্ধঃ
ঘামের দুর্গন্ধের পেছনে ব্যাকটেরিয়াই দায়ী। এজন্য করণীয় হচ্ছে—
— প্রতিদিনের কাপড় প্রতিদিন বদলিয়ে নিতে হবে।
— প্রতিদিন গোসল করতে হবে, প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করা যেতে পারে।
— বগল শেভ করে রাখাও দরকার। আন্ডার শেভও করতে হবে।
— ডিওডোরেন্ট, এন্টি পারস্পপিরেন্ট স্প্রে/বার/লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
— গোসলে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল সোপ, যেমন—খবাবত্-২০০০ ঝড়ধঢ়/কার্বলিক সোপ ব্যবহার করা যেতে পারে।
— প্রয়োজনে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
গরমে খাবার-দাবারঃ
গরমের সময় গুরুপাক না খাওয়াই ভালো। অতিরিক্ত গরমে অনেক সময় হজমে সমস্যা হয়। তাই সাধারণ খাবার, যেমন—ভাত, মাছ, ডাল, ভর্তা ইত্যাদি খাওয়াই ভালো। গরমে প্রচুর পানি পান করা উচিত। ঠাণ্ডা লেবুর শরবত কিংবা তরমুজ জাতীয় রসালো ফলও এ সময় খাওয়া যেতে পারে।
তবে পরিস্থিতি যাই হোক, গরমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হয়ে এড়িয়ে চলতে হবে রুদ্র বৈশাখের উত্তাপজনিত অসুস্থতা।