প্রতিরোধ্য অবৈধ কার পার্কিং
প্রতিরোধ্য অবৈধ কার পার্কিং
সায়ীদ আবদুল মালিক : ঢাকা শহরজুড়ে চলছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ব্যবসা। এ যেন দেখার কেউ নেই। মতিঝিল অফিস পাড়া থেকে শুরু করে দিলকুশা বাণজ্যিক এলাকা, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, গুলশান, বনানী, মহাখালী ও উত্তরার ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর একই দৃশ্য। প্রত্যেক ব্যস্ততম এলাকায় রয়েছে সংঘবদ্ধ চক্র। তারা রাস্তাগুলোর দু’পাশে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে নির্দিষ্ট হারে টাকা নিচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একমাত্র নিউমার্কেট এলাকার কার পাকিং ছাড়া আর কোথায়ও কার পার্কিয়ের অনুমতি না থাকলেও এরা সিটি কর্পোরেশনের নাম ভাঙিয়ে এ ব্যবসা করে যাচ্ছে। নিউমার্কেটের কার পার্কিংটি নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। অন্যদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বনানী কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় একটি, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার ও টাউন হল মার্কেট এলাকায় দু’টি এবং কারওয়ান বাজার এলাকায় একটিসহ মোট চারটি কার পার্কিংয়ের অনুমোদন দেয়া আছে। অথচ এরা সারা ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকেই কার পার্কিং বানিয়ে নিয়েছে। এরা এতই প্রভাবশালী যে, উভয় সিটি কর্পোরেশনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার পরও এদেরকে রোখা যাচ্ছে না। এদের বিরুদ্ধে নেয়া কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। সবই যেন এদের কাছে থোড়াই কেয়ার।দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তাদ্বয়ের মুখেও একই রকম হতাশার বাণী। তারা বলছেন, অবৈধ কার পার্কিং ব্যবসায়ীরা এতটাই ক্ষমতাধর এদের বিরুদ্ধে নেয়া কোনো ব্যবস্থাই কাজে আসছে না। এদেরকে সকালে উচ্ছেদ করলে আবার দুপুরে চলে আসে। দুপুরে উচ্ছেদ করলে রাতে চলে আসে।দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় হলুদ পোশাক পরা এক ব্যক্তি লাঠি হাতে রাস্তার দু’পাশে গাড়ি পার্কিং করে টাকা নিতে দেখা গেল। টাকা কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সিটি কর্পোরেশন থেকে লিজ নেয়া আছে। তাই এখানে গাড়ি রাখলে আমাদের ঘণ্টা হারে টাকা দিতে হয়। এ বাবদ তার কাছে কোনো রশিদ আছে কি না জানতে চাইলে সে নানা টালবাহনা করে সটকে পড়ে। পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহম্মেদ বলেন, অবৈধ কার পার্কিং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে করতে আমরা এখন অনেকটা ক্লান্ত। নানা কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েই আমরা পেরে উঠতে পারছি না। অন্যদিকে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ পলিশের প্রয়োজন, সব সময় আমরা সে পুলিশ পাই না। যে কারণে অনেক সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে আমাদের সমস্যা হয়। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের কোথাও কোনো ফুটপাত ব্যবহার করে গাড়ি পার্কিং করা অনুমতি দেয়া হয়নি। এ কাজটি সম্পূর্ণ অবৈধ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানী কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মতিঝিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার প্রধান রাস্তাগুলো বেশিরভাগ অংশ দখল করে গাড়ি পার্কিং করা হয়েছে। কোথাও কোথাও পুরা রাস্তাটিকে গাড়ি পার্কিং বলেই মনে হয়েছে। দু’পাশে সারি সারি গাড়ি রাখা মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তার মতো ফাঁকা জায়গা দিয়ে কোনো রকম মানুষ ও গাড়ি ছুটাছুটি করছে। নেই কোনো ফুটওভার ব্রিজ। রাস্তা পারাপার ও চলাচলে নিতে হচ্ছে ঝুঁকি। জ্যামে আটকে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিনের এই একই অবস্থা যেন নিরুপায় হয়ে মেনে নিচ্ছে। ফুটপাতজুড়ে বসেছে ফল, কাপড়, জুতা, টুথব্রাশ, ব্যাগ, কসমেটিক, চা-সিগারেট এমনকি খাবারের দোকানের রমরমা ব্যবসা। ব্যবহার্য এমন কিছু নেই যা মতিঝিল ফুটপাতে পাওয়া যায় না। ব্যস্ত এই এলাকাটিতে মানুষের চলাফেরার জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফুটপাত ও পার্কিংবিহীন রাজপথ। কিন্তু এ এলাকার অবস্থা পুরোটাই তার বিপরীত। রাজউক ১৯৮৪ সালে ভবন নির্মাণে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা রাখার নিয়ম চালু করে। কিন্তু মতিঝিলের অধিকাংশ ভবন ১৯৮৪ সালের আগের তৈরি। ফলে সেখানে এখন পর্যন্ত পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি ১৯৮৪ সালের পরে তৈরি ভবনেও নেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এ নিয়ে কয়েক দফা সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের রাজউক, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের উপস্থিতিতে আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজপথ থেকে পার্কিং উচ্ছেদ করার কার্যক্রমও পরিচালিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু পার্কিং করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করায় পুলিশ প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ উভয়কেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ বলেন, ঢাকা শহরের ব্যস্ততম রাস্তার আশপাশে ও ফুটপাতে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে আমরা ধারাবাহিকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসছি। আমাদের লোকবল কম ও পুলিশ সাপোর্ট পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না বিধায় মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি বলেন, বহু আগে এ অপরাধের জরিমানা ও শাস্তির বিধান হওয়ায় ঢাকা শহরের কিছু কিছু এলাকায় অবৈধ পার্কিংয়ের অপরাধের জরিমানা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এ যেন ওদের কাছে কিছুই না। তারা এটাকে পাত্তাই দেয় না। তাই বারবার তারা এ অপরাধ করে যাচ্ছে। যানজটের প্রধান যে কারণগুলোকে বিশেষজ্ঞগণ চিহ্নিত করেছেন তার মধ্যে অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিং বা যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা। এতে করে নগরীর অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থা আরো সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে। রাস্তাগুলো হারাচ্ছে তার প্রশস্ততা। অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিংয়ের ভয়াবহ রূপটা দেখা যায় বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিল, দিলকুশা, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকায়। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এই এলাকাটিতে। দেশের প্রধান প্রধান সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও বীমার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিসসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ অফিস এই এলাকাগুলোতে অবস্থানের জন্য ব্যবসায়ীদের যাতায়াত অনেক বেশি। ব্যস্ততম দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার বিশেষ করে সেনা কল্যাণ ভবন, সাধারণ বীমা ভবন, বিসিআইসি ভবনসহ সকল বাণিজ্যিক ভবনের সামনে যত্রতত্র অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। অথচ এ সকল ভবনের নিজস্ব গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের নিজস্ব গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধাসহ অন্যান্য প্রাইভেট গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে ভবনটিতে। নামমাত্র ভাড়ায় প্রাইভেট গাড়িগুলো এখানে পার্কিং করা যায়। এখানে ৫৪৫টি গাড়ি একবারে পার্কিং করার ব্যবস্থা আছে। কাউন্টারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী ইনকিলাবকে জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ গাড়ি এখানে পার্কিং করা যায়। এখানে প্রথম দুই ঘণ্টার জন্য প্রতিটি গাড়ির জন্য ১৫ টাকা হারে ভাড়া নেওয়া হয় এবং পরবর্তী প্রতি এক ঘণ্টার জন্য ৫ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। তিনি জানান, অনেকেই গাড়ি এই ভবনটিতে পার্কিং না করে ভবনটির সামনে অবৈধভাবে রেখে দেয়।এ সময় সেনা কল্যাণ ভবন ও সাধারণ বীমা ভবনের সামনে কয়েকশ’ গাড়ি অবৈধভাবে পার্কিং করা ছিল। অথচ সেখানে লেখা আছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং করবেন না। সাধারণ বীমা ভবনের সামনে অবৈধভাবে রাখা এক ব্যবসায়ীর গাড়ি চালককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, প্রায় ৩০ মিনিটের বেশি সময় সেখানে গাড়ি পার্কিং করে রেখেছেন। আরো কতক্ষণ রাখতে হবে তা জানেন না। গাড়ির মালিক ব্যবসার কাজে সেনা কল্যাণ ভবনে গেছেন বলে তিনি জানান।এদিকে সারা দিন ২০ টাকা ভাড়ায় অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করার সুযোগ রয়েছে বিসিআইসি ও সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে। সেখানে আর এক ব্যবসায়ীর গাড়ি চালক জানান, তিনি সেখানে ২০ টাকায় পার্কিংয়ের চুক্তিতে গাড়ি রেখেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভাড়া আদায়কারী জানায়, সিটি কর্পোরেশন থেকে তাদের এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, কে কোন এলাকার ভাড়া আদায় করবে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের তত্ত¡াবধানে এই ভাড়া আদায় করা হয়। কিন্তু পরে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের খোঁজ করা হলে তিনি বলেন, মাসিক কিছু টাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের দেওয়া হয় তাদের এই কর্মকান্ড পরিচলনা করার জন্য।ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এরা অবৈধ কার পার্কিংয়ের ব্যবসা করে থাকে। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া কোনো ব্যবস্থাই কাজে আসছে না। তাদের শক্তি অনেক গভীরে। উচ্ছেদ করে আসতে দেরি তাদের আবার ফিরে আসতে দেরি হয় না।