ফুটবলে মাতলো বন্দর নগরী
ফুটবলে মাতলো বন্দর নগরী
চট্টগ্রাম ক্রীড়াঙ্গন এমনিই মুখরিত। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ ২৯ ডিসিপ্লিনের ঘরোয়া কার্যক্রম চলে বছরজুড়েই। হালের ক্রিকেট জনপ্রিয়তায় বাকি ডিসিপ্লিনগুলোকে নাজুকই মনে করা হচ্ছিল। বন্দর নগরীর সংগঠকদের ভুল ভাঙল শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ।
‘অনেকেই বলেন ফুটবলের জনপ্রিয়তা নেই। ক্লাব প্রমাণ করল খেলাটির আবেদন একটুও কমেনি। ফুটবলের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকেই কিন্তু গ্যালারিতে দর্শকরে ঢল’— ম্যাচ শুরুর আগে বণিক বার্তাকে বলেছেন তৃপ্ত স্থানীয় সংগঠক মোহাম্মদ ইউসুফ। যোগ করেন, ‘ক্রিকেট এখানে নিয়মিতই হচ্ছে, দীর্ঘদিন পর আন্তর্জাতিক ফুটবল হলো। খেলাটিকে জাগিয়ে তুলতে যে ঝাঁকুনি প্রয়োজন ছিল, আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ কিন্তু তা দিয়েছে। ফুটবল উন্নয়নে এখন ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।’
বন্দর নগরীতে ছুটির দিনের সকালটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। দুপুরে হলো ভারি বর্ষণ। মাঠের বিভিন্ন অংশে জমা পানি-কাদা দেখে দুশ্চিন্তায় ছিলেন আয়োজকরা। মাঠকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রস্তুত হয় মাঠ, কেটে যায় শঙ্কার মেঘ। দুপুরের পর থেকে শুরু হয় দর্শক স্রোত। সন্ধ্যায় যা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। ম্যাচ শুরুর ৪০ মিনিট আগে গ্যালারিতে ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই। বাধ্য হয়ে ফটকগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
‘সত্যিই আমরা অবিভূত। দর্শক আগ্রহ আমাদের প্রত্যাশাকেও হার মানিয়েছে। শেখ কামাল ক্লাব কাপকে ঘিরে চট্টগ্রামবাসী যাতে প্রতি বছরই উত্সবে মেতে উঠতে পারে আমরা সে ব্যবস্থা করব’— বণিক বার্তাকে বলেছেন আয়োজক কমিটির সমন্বয়ক তরফদার রুহুল আমীন। এ সংগঠক যোগ করেন, ‘আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সঙ্গে আলোচনা করেছি। ফুটবল সূচিতে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সম্মতিও দিয়েছেন ফুটবল কর্তারা। আগামী বছর অক্টোবরে আমরা পরবর্তী আসর আয়োজন করব।’
বর্ণিল আয়োজনের সাক্ষী হতে আসা দর্শক-সমর্থকরা রঙ-ঢঙে গ্যালারি রাঙিয়ে তুলেছিলেন। নগরীর হালিশহর থেকে ছুটে আসা সালাউদ্দিন-সুরাইয়া দম্পতির সঙ্গে ছিল আট বছরের ছেলে ফাহিমও। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে জনস্রোত দেখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত চল্লিশোর্ধ্ব ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন। তার সহধর্মিণী সুরাইয়া বলেন, ‘প্রতিযোগিতার শুরু থেকে সব খেলাই গ্যালারিতে বসে দেখেছি। ক্রিকেটের তুলনায় আমি ফুটবলটাই বেশি পছন্দ করি। ঘরের মাঠে চট্টগ্রামের দলকে সমর্থন জানাতে এখানে এসেছি।’ বণিক বার্তা।
আনন্দবাজার পত্রিকায় গতকালকের খেলা নিয়ে প্রতিবেদন:
ইস্টবেঙ্গল-১ (অভিনব)
চট্টগ্রাম আবাহনী-৩ (এলিটা-২, হেমন্ত)
চট্টগ্রাম আবাহনী ‘লুন্ঠন’। আর শেখ কামাল আন্তর্জাতিক গোল্ড কাপ নিয়ে ও পার বাংলা থেকে এ পার বাংলায় ফেরা— এই স্বপ্নে শুক্রবার দিনভর মশগুল ছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা।
র্যান্টি মার্টিন্স গোলের মধ্যে ফেরায় লাল-হলুদ সমর্থকরা আরও আশাবাদী ছিলেন, র্যান্টি-ম্যাজিকে এক যুগ পর ফের একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতে কলকাতায় ফিরবে তাঁদের প্রিয় দল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ইস্টবেঙ্গল কলকাতা ফিরছে স্বপ্নভঙ্গের তীব্র বেদনা নিয়ে।
কারণ, র্যান্টি আছেন র্যান্টিতেই! আসল দিনে জ্বলে ওঠার বদলে কেমন যেন মিইয়ে রইলেন সারাক্ষণ। আর তাঁর প্রতিপক্ষ দলে দেশোয়ালি নাইজিরিয়ান এলিটা কিংসলে দাপিয়ে বেড়ালেন গোটা ম্যাচ। নিটফল— ফাইনালের শুরুতেই এগিয়ে গিয়েও ১-৩ হেরে বাংলাদেশ থেকে ট্রফি জিতে আসার সুযোগ হাতছাড়া করল বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের দল। গ্রুপ লিগ অভিযান যাদের বিরুদ্ধে ২-১ জিতে শুরু করেছিল লাল-হলুদ, তাদের কাছেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে নাস্তানাবুদ হয়ে হারল লাল-হলুদ। তিপ্পান্ন থেকে ছাপ্পান্ন—মাত্র তিন মিনিটে দু’গোল খেয়ে ম্যাচ থেকেই হারিয়ে যান দীপক-ওরোকরা।
অথচ শুরুটা এ দিন ভালই করেছিল ইস্টবেঙ্গল। এগারো মিনিটে অভিনব বাগের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য়ের ছেলেরা। ইস্টবেঙ্গল রাইট ব্যাকের শট আবাহনীর লিটনের মাথায় লেগে দিক পরিবর্তন করে গোলে ঢুকে যায়। তখন একবারও মনে হয়নি এই ম্যাচ হেরে মাঠ ছাড়তে পারে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু হাফটাইমের বাঁশি বাজার সামান্য আগে আবাহনীর মিঠুনের ক্রস থেকে হেডে বাংলাদেশের ক্লাবকে সমতায় ফেরান তাদের নাইজিরিয়ান ফরোয়ার্ড এলিটা।
“ফাইনালে হারায় কষ্ট একটা থাকেই। কিন্তু কোনও কোনও দিন গেমপ্ল্যান কাজ করে না। আজ সেটাই হল। তবে আই লিগের আগে আমাদের রিজার্ভ বেঞ্চ অনেককে পেল। আপাতত লাভ এটাই।” —বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য। |
দ্বিতীয়ার্ধের গোড়ায় জাহিদের ফ্রিকিকে পা ছুঁইয়ে স্থানীয় দলকে এগিয়ে দেন ওই বিদেশিই। দু’মিনিট পরেই ফের গোল খায় লাল-হলুদ রক্ষণ। বেলো-দীপকদের ভুল বোঝাবুঝিতে এলিটার ক্রসে হেডে ৩-১ করে যান হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস।
ম্যাচ শেষে চরম হতাশ অ্যালভিটো ডি’কুনহা ফোনে বললেন, ‘‘প্রথমার্ধের একদম শেষ মুহূর্তে গোলটা হজম করে ছেলেদের কনফিডেন্সটা পরের পঁয়তাল্লিশ নষ্ট হয়ে গেল। তাতেই সব বিপত্তি।’’ চট্টগ্রামের দলটায় শেখ রাসেল থেকে লিয়েনে নেওয়া বেশ কয়েক জন ফুটবলার আছেন। তার সঙ্গে গ্যালারির তুমুল সমর্থন। আর মাঠের ভেতর তাদের দুই সাইডব্যাকের মারাত্মক ওভারল্যাপ। তবু এ সব কিছু প্রথমার্ধে ঠিক মতোই ম্যানেজ করে নিয়েছিল দীপক মণ্ডলরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এক বার এগিয়ে যেতেই প্রেসিং ফুটবল খেলতে শুরু করে আবাহনী। বিশ্বজিতের দল এই সময় চেষ্টা করেছিল প্রতি-আক্রমণে রাস্তায় গিয়ে গোল তুলে আনার। কিন্তু র্যান্টি নিষ্প্রভ থাকায় সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। গোলের সুযোগ নষ্ট করেন ওরোক, রফিকরাও।
বাংলাদেশের এই টুর্নামেন্টে প্রথম দিন থেকেই কিপার দিব্যেন্দু, মিডিও প্রহ্লাদ, অবিনাশ, অ্যান্টনি, সাইড ব্যাক অভিনবদের মতো বঙ্গসন্তানরা পারফরম্যান্সের শিখরে ছিলেন। কিন্তু আসল দিনেই সেই বঙ্গসন্তানরা স্বপ্নভঙ্গের শরিক। যদিও লাল-হলুদ কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য সেটা মানতে নারাজ। ফোনে বললেন, ‘‘ফাইনালে হারায় কষ্ট একটা থাকেই। কিন্তু কোনও কোনও দিন গেমপ্ল্যান কাজ করে না। আজ সেটাই হল। তবে আই লিগের আগে আমাদের রিজার্ভ বেঞ্চ অনেককে পেল। আপাতত লাভ এটাই। আমি তো মনে করি এই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স আই লিগে হতাশার প্রভাব ফেলার বদলে ফুটবলারদের বরং মোটিভেট করবে।’’