বর্ণিল সিঙ্গাপুরে বিবর্ণ জীবন

পরিচ্ছন্ন শহর। অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলা কড়াকড়ির কারণে সবকিছুই চলে নিয়ম মেনে। বহুজাতিক সংস্কৃতির সুবাদে পর্যটকদের জন্য সিঙ্গাপুর তাই আদর্শ দেশ। ব্যবসাবান্ধব নীতির কারণে বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রেও এটি। এত সব চাকচিক্যের মধ্যেও সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জীবন অন্য রকম। কোম্পানি পরিবেশিত পচা, বাসি আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে দিন পার করছেন দেশটিতে কর্মরত লাখো বাংলাদেশী শ্রমিক। ফলে বছরের বড় একটা সময় তাদের সঙ্গী হচ্ছে অসুস্থতা।

সিঙ্গাপুরে কর্মরত ৫০০ বাংলাদেশী শ্রমিকের খাবারের মান নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। টানা দুই বছর শ্রমিকদের সাক্ষাত্কার, খাবার তৈরির স্থান, খাবারের প্যাকেজিং, সরবরাহ ও পরিবেশিত খাবার পরীক্ষা করে গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সেখানে প্রতি ১০ জন শ্রমিকের নয়জনই অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন। আর এসব খাবার সরবরাহ করছে মালিকের পছন্দের ক্যাটারিং সার্ভিসগুলো।

গবেষণার ফলাফল বলছে, ক্যাটারিংয়ের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন দেশটিতে কর্মরত ৮৬ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক। ৯৩ শতাংশ শ্রমিক পাচ্ছেন অপরিচ্ছন্ন খাবার। আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন ৯৪ শতাংশ শ্রমিক।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রবাসী কল্যাণ সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আগামীকাল (আজ) সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হবে।’

জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের জাহাজ নির্মাণ শ্রমিকদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হয় সকাল ৬টায়। দুপুরে খাওয়ার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নষ্ট হয়ে যায়। আর নির্মাণ শ্রমিকদের দুপুরের খাবার কর্মস্থলে রেখে আসা হয়। এসব খাবার বেশির ভাগ সময় পলিথিন ব্যাগে খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায় পড়ে থাকে। শ্রমিকরা খাওয়ার আগেই কখনো কখনো তা পিঁপড়া, তেলাপোকা বা ইঁদুরের খাবারে পরিণত হয়।

গতকাল টেলিফোনে কথা হয় নির্মাণ শ্রমিক নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের বাইরেটা যত ঝকঝকে, ভেতরটা সে রকম নয়। শ্রমিকদের পদে পদে বঞ্চিত করা হয়। মাসে খাওয়ার জন্য ৭ হাজার টাকা কোম্পানি কেটে রাখে। এ টাকায় অনেক ভালো মানের খাবার পাওয়ার কথা। অথচ খেতে হচ্ছে বাসি, পচা আর অস্বাস্থ্যকর খাবার।

তিনি বলেন, শ্রমিকরা ইচ্ছা করলেও নিজের পছন্দমতো রান্না করে খাবার খেতে পারেন না। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর চাইলেও রান্না করা সম্ভব নয়। তাই ক্যাটারিংয়ে যা পাওয়া যায়, তা-ই খেতে হয়। মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে এটি খেতে হয় তাদের।

আধুনিক সিঙ্গাপুরে সবকিছু সাজানো গোছানো হলেও এর মধ্যে সুকৌশলে শ্রমিক নির্যাতন করে আসছে দেশটির স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানি। দেশটির সাবেক জনশক্তিমন্ত্রী তান সুয়ান জিনও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, সিঙ্গাপুরে সাত লাখ বৈধ শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে অল্প সংখ্যক শ্রমিক নির্যাতিত হচ্ছেন।

ডব্লিউএআরবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকরা কোম্পানির মাধ্যমে নিম্নমানের খাবার খাচ্ছেন, এটি দুঃখজনক ও উদ্বেগের। শ্রমিকরা দীর্ঘদিন অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাবেন। গ্যাস্ট্রিক, আলসারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অবশেষে তারা দেশে আসবেন। বিষয়টি সিঙ্গাপুর সরকারকে জানানো প্রয়োজন। সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

জাহাজ নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, তারা কখনো দিনের আলো দেখতে পারেন না। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সবকিছু হয় কাজের সময়। প্র্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তারা ব্যস্ত থাকেন। ভোর সাড়ে ৪টায় কাজের উদ্দেশ্যে লরিতে উঠতে হয়। সকাল ৫টায় ইয়ার্ডে পৌঁছার পর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আবার লরিতে করে বাসায় ফিরতে বেজে যায় সন্ধ্যা ৭টা। এত পরিশ্রম সত্ত্বেও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না তারা। সপ্তাহে ৬৫-৭০ ঘণ্টা কাজ করেও প্রতি মাসে তারা দেশে পাঠাতে পারছেন ১৫ হাজার টাকা।

নির্মাণ সুপাইভাইজার জাকির হোসেন খোকন বলেন, আপনি কনস্ট্রাকশন সাইট আর শিপইয়ার্ডে গেলেই দেখতে পাবেন, শ্রমিকদের দুপুরের খাবার কীভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে। খাবারের প্যাকেট খুললেই খাওয়ার ইচ্ছা উবে যায়। তার পরও এসব খাবার দিয়েই বছরের পর বছর পার করছেন তারা।

নরসিংদীর আবদুল হালিম বলেন, সিঙ্গাপুরের চোখ ধাঁধানো ক্যাসিনো, বিলাসবহুল মার্কেট আর মনোরম পরিবেশে সবাই মুগ্ধ হন। তাই শ্রমিক নির্যাতনের কাহিনী অনেকেরই বিশ্বাস হয় না। যদিও এখানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.