বস্ত্র ও পোশাক খাত: মাসে গড় বিনিয়োগ ৬১৩ কোটি টাকা

বদরুল আলম |
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে দেশের তৈরি পোশাক খাত। প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক চাপে শঙ্কার মধ্যে পড়ে এ খাতের ভবিষ্যত্। তবে এত কিছুর মধ্যেও বিনিয়োগ অব্যাহত ছিল বস্ত্র ও পোশাক খাতে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ৬১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে এ খাতে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক শিল্পের সংকটময় সময়ে এ খাতের কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব ফিরে পায় বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বস্ত্র পরিদপ্তর। সংস্থাটির দেয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে শতভাগ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে ৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। যৌথ বিনিয়োগ হয়েছে ৬ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আর স্থানীয় বিনিয়োগ হয়েছে ২৩৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে গত ৩২ মাসে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ২৫১ কোটি ৬৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে বস্ত্র পরিদপ্তরের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইসমাইল বণিক বার্তাকে বলেন, গত আড়াই বছরে দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে। এসব বিনিয়োগের একটি বড় অংশই ছিল প্রকল্প সম্প্রসারণ। অর্থাত্ যার একটি কারখানা আছে, তিনি আরো দুটি ইউনিট করেছেন। অনেকে ডেফার্ড এলসিতে পণ্য এনে দাম পরিশোধ করেছেন। আবার নিরাপত্তা উপকরণের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশে বস্ত্র ও পোশাক কারখানাগুলোয় মাসে গড় বিনিয়োগ হয়েছে ৬১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পোশাক খাতে বেশকিছু সেবা দিচ্ছে বস্ত্র পরিদপ্তর। এর মধ্যে আছে— নিবন্ধন, আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ছাড়করণের সুপারিশ, কাঁচামাল অনুমোদনে সুপারিশ, অ্যাডহক ও নিয়মিত শিল্প আমদানি সনদ সুপারিশ, শিল্প প্লট বরাদ্দের সুপারিশ, ইনডেমনিটি বন্ড অবমুক্তকরণের সুপারিশ, ইম্পোর্ট পারমিটের সুপারিশ, বাকি বা ডেফার্ড পেমেন্টের জন্য অনাপত্তি, বৈদেশিক ঋণের জন্য অনাপত্তি, ভিসা প্রদানের সুপারিশ, ওয়ার্ক পারমিট ও মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ বা অনাপত্তি।

গত আড়াই বছরে পোশাক খাতে যেসব বিনিয়োগ এসেছে, তা হয়েছে যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ আমদানি, কাঁচামাল, বৈদেশিক ঋণ হিসেবেই। তবে এর মধ্যে আমদানি করা মূলধনি যন্ত্রপাতির পরিমাণই বেশি। আমদানি হওয়া মূলধনি যন্ত্রের মধ্যে আছে— নিটিং, ডায়িং, সুইং, স্পিন্ডল, ড্রায়ার, অটো কম্প্যাক্ট, স্বয়ংক্রিয় সোয়েটার মেশিন ও স্টেনটার মেশিন।

আড়াই বছরে যে পরিমাণ মূলধনি যন্ত্র আমদানি হয়েছে, তার প্রায় ৩০ শতাংশ নিরাপত্তা উপকরণ। নিরাপত্তা উপকরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ফায়ার ডোর, ফায়ার পাম্প, বাসবার ট্রাংকিং সিস্টেম, স্কোক ডিটেক্টর। এসব যন্ত্রাংশ আমদানি হয়ে দেশে পৌঁছানোর পর ঋণপত্র ও জাহাজীকরণ-সংক্রান্ত নথি যাচাই-বাছাই করে কাস্টমস বরাবর আমদানি ছাড় করার সুপারিশ করে বস্ত্র পরিদপ্তর।

সূত্র জানায়, গত ৩২ মাসে নিয়মিত ও বিপুল পরিমাণ আমদানি করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে— আল-মুসলিম, স্ট্যান্ডার্ড, হা-মীম, এনভয়, গ্লোবাল আউটওয়্যার, ইসলাম, ডিভাইন গ্রুপ, ইন্টারস্টপ অ্যাপারেল, ব্রাদার্স, দীপ্ত, আলিফ, সিম, মাইক্রো ফাইবার, এপিএস, থার্মেক্স, ইনট্রেড, এপিলিয়ন, ভিয়েলাটেক্স, এমঅ্যান্ডজে, একেএইচ, অনন্ত, স্টারলিং গ্রুপ, ড্রেসম্যান অ্যাপারেল, অনুরিমা গ্রুপ, ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট, যমুনা ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড ও দিগন্ত সোয়েটার। সব প্রতিষ্ঠানই স্থানীয় বিনিয়োগ করেছে।

এছাড়া যৌথ বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে— ডিকাটেক্স, কাইলক নিউএজ বাংলাদেশ লিমিটেড, রিজভী ফ্যাশন, সিজি অ্যাপারেল, ডিকে গ্লোবাল ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড।

আর শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে— ফু-ইউ স্পোর্টসওয়্যার, জেজেএইচ টেক্সটাইল বিডি, জেমি লিমিটেড।

বস্ত্র পরিদপ্তরে তথ্যভাণ্ডার আছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ হাজার ১০০। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকেই প্রতি মাসে বিনিয়োগ হয়েছে ৬১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বস্ত্র পরিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৪-১৫ সময়ে বিনিয়োগ বেড়েছে ব্যাপক হারে। স্থানীয়, শতভাগ বিদেশী ও যৌথ মিলিয়ে ২০১৪ সালে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ২৯৭ কোটি ৪৭ লাখ ৩৬ হাজার ৭০০ টাকা। আর ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৬০ কোটি ৯৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এ হিসাবে ২০১৫ সালে বিনিয়োগ বেড়েছে ২৫০ শতাংশ।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গত প্রায় তিন বছরে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এর মধ্যে মূল হলো নিরাপত্তা উপকরণ। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় চাপসহ উদ্যোক্তাদের সচেতনতার ফলেই এ বিনিয়োগগুলো হচ্ছে। আবার অনেকেই নতুন স্থানে কারখানা স্থানান্তর করেছেন। আর নতুন আধুনিক যন্ত্রাংশ স্থাপন করেছেন সেসব কারখানায়। ফলে পোশাক খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে।

শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে ও তা টেকসই করতে বস্ত্র এবং পোশাক খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন উদ্যোক্তারা। শিল্প টেকসই করতে এর প্রয়োজনও আছে। তবে এক্ষেত্রে আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সহায়তায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাজস্ব কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধিও প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি কয়েক বছরে বেশকিছু মূলধনি যন্ত্রপাতির অস্বাভাবিক আমদানি বেড়েছে। এগুলো সবই শূন্য শুল্কের। এছাড়া দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে বলেও সম্প্রতি জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাই মূলধনি যন্ত্র কেনার নামে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে বিদেশে টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা, তা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত খতিয়ে দেখা।

তবে কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে অর্থ পাচারের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করেন না বস্ত্র পরিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল। তিনি বলেন, ব্যাংকিং নথি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দলিল যাচাই-বাছাই করেই আমরা এগুলো ছাড়ের সুপারিশ করি। অসঙ্গতি আছে সন্দেহ হলে সরেজমিন পরিদর্শনও করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.