বাংলাদেশে কি সময় এসেছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের?

শায়লা রুখসানা, বিবিসি বাংলা ।
বাংলাদেশে টানা বৃষ্টি হলেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বর্ষার মৌসুমে তা আরও হতে পারে।

কিন্তু বৃষ্টির ফলে জলজট এবং যানজট আতঙ্কিত করে তুলছে মানুষকে।

তবে বলা হচ্ছে, বৃষ্টিপাতের এধরনের নেতিবাচক ফলাফল এড়ানো সম্ভব একে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে। কিভাবে?

“সকাল সাড়ে আটটা। ঢাকার গ্রীনরোড এলাকার একটি সাততলা ভবনের ছাদের ওপরে, দাঁড়িয়ে আছি। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ছাদের ভেতরে বৃষ্টির যে পানি জমছে, খুব দ্রুতই তা গড়িয়ে চলে যাচ্ছে পাইপের ভেতর দিয়ে নিচে রাস্তায়…”

বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি রাস্তার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত ঢালু বা নিচু অংশের দিকে।

আর এভাবে টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তিন-চার ফুট উঁচু পানি জমে যাচ্ছে রাস্তায়। তার ভেতর দিয়ে চলাচল করছে রিক্সা-গাড়ি। কোনও কোনও যানবাহনের ভেতরও পানি ঢুকে যাচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আওয়াজ জোরদার হচ্ছে বৃষ্টির পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেয়ার দাবিতে।

‘রাস্তায় পানি ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমে যেত’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার ভাইস প্রেসিডেন্ট স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেছিলেন, কেন তারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের দাবিটি তুলে ধরছেন।

“ঢাকা শহরের পানির একটি বড় অংশ রাস্তায় নেমে এসেছে বলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। মানুষের বাড়ির ছাদের পানি রাস্তায় নেমে আসছে। মানুষের বাড়ি-ঘরে আগে ছিল উঠোন। সেখান থেকে পানি নেমে চলে যেত। কিন্তু এখন সেই উঠোন নেই। খোলা মাঠ নেই। আছে ছাদ। ছাদের থেকে পানি চলে যাচ্ছে রাস্তায় কিন্তু সেখান থেকে আর পানি নামার পথ পাচ্ছে না। এর ফলে তৈরি হচ্ছে জলজট।”
স্থপতি মি. হোসেন বলেন, “একটি শহরে চার থেকে পাঁচ মিনিট বৃষ্টির পর আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পানি পাই যেটা সরাসরি পান করার মতো। প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া এই বৃষ্টির পানি যদি সংরক্ষণ করা যেত তাহলে রাস্তায় পানি ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমে যেত।”

আলোচনায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার ব্যর্থতার পাশাপাশি বৃষ্টির পানির অপচয় প্রসঙ্গ

বৃষ্টির পানি নামতে না পারার জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা নিয়ে নানা অভিযোগ ও কথা-বার্তা হচ্ছে দীর্ঘদিন।

তেমনি পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, বৃষ্টির পানিকে অপচয় হতে না দিয়ে তাকে ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা।

বৃষ্টির পানিকে বহুদিন ধরেই দেশের গ্রামীণ এলাকার মানুষ বিভিন্ন ঘরোয়া পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে আসছেন।

উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে বৃষ্টির পানির গুরুত্ব খুব বেশি। এমনই একটি স্থান খুলনার দাকোপের বাজুয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি প্রক্রিয়াজাত করে তা বিক্রিও হচ্ছে।

সেখানকার কর্মকর্তা প্রসেন ব্রায়ান জানান, চার বিঘার পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার পর, সেখান থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে পানি একটি বড় ট্যাংকে নেওয়া হয় এবং সেখান থেকে পাত্রে ভরে তা পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়।
‘রাজধানীর ১৫ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ সম্ভব’

অনেক এলাকায় পানিতে আয়রনের কারণে মাটির বড় পাত্রে ধরে রাখা বৃষ্টির পানি রান্না ও পানের জন্য ব্যবহার হচ্ছে এখনো।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মোস্তফা আলী বলছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামনের দিনগুলোতে অল্প সময়ে বৃষ্টিপাত বেশি হবে, আবার খরার সময়কালও বেড়ে যাবে-এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে এখন থেকেই।

“বৃষ্টির পানির কথা যদি বলি শুধু ঢাকা শহরে নয়, সারা বাংলাদেশেই যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু নগরে বিশেষ করে ঢাকার কথা বললে ১০/১২ মিলিয়ন মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে সিংহভাগ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। এরফলে প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। সব মিলিয়ে পানির চাহিদা এবং জলাবদ্ধতা বাড়বে যদি এখন থেকেই ব্যবস্থা নেয়া না হয়।”
অধ্যাপক মোস্তফা আলী বলেন, “বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মোট পানির চাহিদার প্রায় ১০-১৫ ভাগ পূরণ সম্ভব বৃষ্টির পানি থেকে। সেইসাথে বৃষ্টির পানি নেমে যেতে না পারায় যে জলাবদ্ধতা হচ্ছে সেই চাপও কমবে।”

কী উদ্যোগ আছে?

নগরাঞ্চলে এই বৃষ্টির পানি ধরের রাখার বিষয়টি উপেক্ষিত বলা চলে। এনিয়ে কাজ করছে ওয়াটার এইড বাংলাদেশ। তারপরও বিষয়টি কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।

ঢাকার কাছে সাভারে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ভার্ক-এর কার্যালয়ে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশ-এর সহায়তায়।

সেখানে জলাধারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় ২৬ হাজার মিলিলিটার পর্যন্ত যা বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহারের উপযোগী। আর রয়েছে বৃষ্টির পানি রিচার্জ করে ভূগর্ভে পাঠানোর ব্যবস্থাও।
ভার্কের কর্মকর্তা মাসুদ হাসান বলছিলেন, পুরো বিষয়টি কীভাবে কাজ করে এবং তারা কীভাবে ব্যবহার করতে পারছেন বৃষ্টির পানিকে।

“আমাদের অফিস ভবন ৩৩০০ বর্গফুট এরিয়ার এবং পঞ্চম তলার ছাদে চারদিক দিয়ে পাইপের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করি। পেছনে ফিল্টারে নিয়ে পরে সেখান থকে জলাধারে সংরক্ষণ করা হয়। মাসে একবার মেইনটেইন করতে হয়। পানির সংকট হলে আমরা ওয়াশরুম বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করি।”
ঢাকার মত জনবহুল শহরে যেখানে প্রায়ই পানযোগ্য পানির অভাব সংকট হয়ে দেখা দেয়, সেখানে বৃষ্টির পানিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং বিতরণের বিষয়টিও আলোচনায় আনছেন পরিবেশ প্রকৌশলীরা।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান মানেন যে পানির অপচয় হচ্ছে।

মি. খান বলেন, “আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই গ্রামাঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু ঢাকা শহরের পানিটা সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। এর অপচয় হচ্ছে।”

তবে এই পানি পানের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ ওয়াসার নেই বলে জানিয়ে মি. খান গুরুত্ব দেন এই পানিকে রিচার্জ করার ওপর।

“কৃত্রিম উপায়ে পানিটা ধরে রাখতে হবে। তারপর ছাদের পানি পাইপের সাহায্যে মাটির নিচে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেই পানিই আবার খাবারের জন্য উত্তোলন করা হবে। এই বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে এবং আমরা সফল। তবে এখানে বিনিয়োগের ব্যাপার আছে। এজন্য একটি পদ্ধতি বের করতে হবে,” যোগ করেন ওয়াসার এমডি।

বৃষ্টির পানিকে রিচার্জ করে পুনরায় মাটির গর্ভে পাঠানোর এই পদ্ধতি কিছু কিছু ভবনে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে তার পরিসর খুবই সামান্য।
বাড়ির নকশায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আসছে: রাজউক

এমন প্রেক্ষাপটে বাড়ির নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক বলে মনে করছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট এবং পানি সম্পদ প্রকৌশলীরা।

এজন্য ভবিষ্যতে বহুতল বাড়ির নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকাকে বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

রাজউক ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা যেটি প্রচলিত আছে, সেটিকে সংশোধন করে ‘ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবর্তন, সংরক্ষণ, অপসারণ) বিধিমালা-২০১৬’ নামে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির পরিকল্পনা সদস্য সচিব জিয়াউল হাসান।

বিবিসি বাংলাকে জিয়াউল হাসান বলেন, সংশোধিত বিধিমালায় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ করার জন্য ‘বিধান’ (প্রভিশন) রাখা হয়েছে। বিধিতে বলা হয়েছে, নির্মীয়মান ইমারতের ছাদে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং তার ব্যবহারের জন্য এই ব্যবস্থা ইমারত কনস্ট্রাকশনের অংশ হিসেবে গণ্য হবে। ভবন নির্মাণের জন্য যখন আমরা অনুমোদন দেবো তখন এই শর্তটি থাকতে হবে যে তারা আবশ্যিকভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং ব্যবহারে উদ্দেশ্যে রিচার্জ সামগ্রী থাকতে হবে।”

তিনি জানান, গ্রাউন্ডে যে এলাকা থাকবে সেখানে ৫০০ বর্গমিটার বা তার ঊর্ধ্বে হলে এই বিধানটির বাধ্যবাধকতা থাকবে।

রাজউকের কর্মকর্তা বলছেন, পুরনো ভবনের ক্ষেত্রে সেটা বাধ্যতামূলক না হলেও কেউ আগ্রহী হলে সেই নকশা নবায়ন করে দেয়া হবে।

আর গেজেট আকারে বিধিমালা প্রকাশের পর ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে বলেও জানান তিনি।

পানির সংকট মেটাতে প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেকও দেশে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের নজির রয়েছে। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফেরও উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশে মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে প্রধানত নির্ভর করতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই। কিন্তু সেই পানির স্তর প্রতিবছর কয়েক মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.