বাংলাদেশ এখন আশাবাদের দেশ

এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সার্বিকভাবে কনজ্যুমার কনফিডেন্স বা ভোক্তাদের আস্থা অটুট বা স্থিতিশীল রয়েছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে এই অঞ্চলের ১৭টি মার্কেট বা দেশের ওপর পরিচালিত মাস্টারকার্ডের জরিপে ৯টি দেশেই স্থিতিশীলতার তথ্য উঠে এসেছে।

ভোক্তা আস্থা সূচকে চীনের স্কোর ১ দশমিক ৪ পয়েন্ট বেড়ে ৭৬ পয়েন্টে উন্নীত হওয়ায় দেশটি আশাবাদ থেকে ভীষণ আশাবাদের দেশ হয়ে উঠেছে বলা যায়। আর বাংলাদেশের স্কোর ৪ দশমিক ৩ পয়েন্ট বেড়ে ৭১ দশমিক ৬ পয়েন্টে উঠেছে। এর মানে হলো ভোক্তাদের বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন আশাবাদের দেশ।

বৃহস্পতিবার মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব কনজ্যুমার কনফিডেন্স বা মাস্টারকার্ড ভোক্তা আস্থা সূচক এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। আলোচ্য ছয় মাসেও এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভোক্তা আস্থা সূচকে অগ্রগতি অব্যাহত ছিল। তবে তা খুবই নগণ্য। যেমন, এই সময়ে সূচকটি বেড়েছে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ পয়েন্ট। আবার এটি ৬০ পয়েন্টের কাছাকাছি একটি নিরপেক্ষ আশাব্যঞ্জক পর্যায় বলেও বিবেচিত। বলে রাখা ভালো, মাস্টারকার্ডের তৈরি করা এই ভোক্তা আস্থা সূচক ও প্রতিবেদন কোনোভাবেই মাস্টারকার্ডের আর্থিক কার্যক্রমের প্রতিফলন বা ফলাফল নয়।

প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে মাস্টারকার্ড ভোক্তা আস্থা সূচকে সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৩ পয়েন্ট বেড়েছে তাইওয়ানের। এর ফলে দেশটির স্কোর বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ পয়েন্টে। এর আগের অর্থাৎ ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধের জরিপে ১৭টি দেশের মধ্যে তাইওয়ানের অবস্থান ছিল সবার নিচে। সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতির সুবাদে তাইওয়ানের চিত্র এমন পাল্টে গেছে।

বিশেষ করে শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা ও অবিচল আশাবাদই তাইওয়ানকে মাস্টারকার্ড সূচকে সামনের দিকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। ফিলিপাইনও গত মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর মাস্টারকার্ড সূচকে যথেষ্ট এগিয়েছে। এই দেশটির স্কোর ১২ দশমিক ৯ পয়েন্ট বেড়ে ৯৫ দশমিক ২ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রথম ফিলিপাইনকে এই জরিপের আওতায় আনার পরে এটিই মাস্টারকার্ড সূচকে দেশটির সর্বোচ্চ পয়েন্ট। এর ফলে ফিলিপাইন এখন সেখানকার মানুষের কাছে ভীষণ আশাবাদের দেশ হয়ে উঠেছে বলা যায়।

অন্যদিকে জরিপে ১৭টি দেশের মধ্যে ৭টিতে ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধের তুলনায় এ বছরের প্রথমার্ধে ভোক্তাদের আস্থা কমেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এর মধ্যে আস্থা বা আশাবাদ সবচেয়ে বেশি কমেছে ইন্দোনেশিয়ায়। এর পেছনেই রয়েছে হংকং ও সিঙ্গাপুর। এসব দেশে কর্মসংস্থানের দুর্বল সম্ভাবনাই ভোক্তাদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।

গত জুন ও জুলাই মাসে মাস্টারকার্ড এই জরিপ চালায়। এতে ১৭টি দেশের ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মোট ৮ হাজার ৭৪৬ জন লোকের মতামত নেওয়া হয়। এসব মানুষকে তাঁদের নিজ নিজ দেশের পাঁচটি অর্থনৈতিক বিষয়ে ছয় মাসের পূর্বাভাস জানাতে বা ভবিষ্যতবাণী করতে বলা হয়। বিষয়গুলো হচ্ছে- অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা, নিয়মিত বা দৈনন্দিন আয়ের সম্ভাবনা, শেয়ারবাজার ও জীবনযাত্রার মান। শূন্য থেকে ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এই সূচকের পয়েন্ট হিসাব করা হয়। এর মধ্যে শূন্য হলো একেবারে নিরাশার বা চরম হতাশাপূর্ণ, ১০০ হলো সর্বোচ্চ আশাবাদে পরিপূর্ণ এবং ৫০ হলো নিরপেক্ষ অবস্থান।

মাস্টারকার্ড অ্যাডভাইজারসের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এরিক স্নাইডার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ কিছু সমস্যার মধ্যে থাকলেও সার্বিকভাবে কনজ্যুমার কনফিডেন্স বা ভোক্তা আস্থা সূচক কিঞ্চিৎ বেড়েছে। তবে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন প্রভৃতি উদীয়মান অর্থনীতির সহন ক্ষমতা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। সেজন্য এসব দেশের আগামী ছয় মাসের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে জনগণও বেশ আশাবাদী। এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর সুবাদে সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত থাকলেও সরকার ও ব্যবসায়িক খাতের আরো স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে বাইরের আঘাত বা অভিঘাত মোকাবিলায়ও জোর দিতে হবে।’

এশিয়া প্যাসিফিকে জরিপের ফলাফল

● চলতি ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলে সার্বিকভাবে কনজ্যুমার কনফিডেন্স বা ভোক্তাদের আস্থা মোটামুটি স্থিতিশীলই রয়েছে। এই সময়ে মাস্টারকার্ড ভোক্তা আস্থা সূচক শূন্য দশমিক শূন্য ৫ পয়েন্ট বেড়ে বেড়েছে ৫৯ দশমিক ৭২ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে; যা গত ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ৫৯ দশমিক ৬ পয়েন্ট। এর মধ্যে নিউট্রল বা নিরপেক্ষ অবস্থান ৫০ পয়েন্টের নিচে অবস্থানকারী দেশের সংখ্যা আগের জরিপের মতো (১৭টির মধ্যে ৮টি) অপরিবর্তিত রয়েছে।

● আগের জরিপে (২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধ) সবচেয়ে খারাপ করে তালিকার সর্বনিম্ন ১৭তম স্থানে নেমে যাওয়া দেশ তাইওয়ান কিন্তু এবারে সবচেয়ে ভালো করেছে। এ বছরের প্রথমার্ধে দেশটির ভোক্তা আস্থা সূচক সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ফিলিপাইন, ভারত ও মালয়েশিয়ার স্কোর কমপক্ষে ৫ পয়েন্ট করে বেড়েছে।

● উন্নয়নশীল বাজারগুলোর মধ্যে ভারত ৯৭ দশমিক ৬ পয়েন্ট, ফিলিপাইন ৯৫ দশমিক ২ পয়েন্ট, ভিয়েতনাম ৯৪ দশমিক ৯ পয়েন্ট ও মিয়ানমার ৯৯ দশমিক ৮ পয়েন্ট স্কোর নিয়ে মাস্টারকার্ডের ভোক্তা আস্থা সূচকে সর্বোচ্চ আশাবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

● জরিপের আওতাধীন ১৭টি দেশের মধ্যে ৭টি দেশের স্কোর কমেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৭ পয়েন্ট কমেছে ইন্দোনেশিয়ার। অন্য দেশগুলোর মধ্যে হংকংয়ের ১২ দশমিক ৪ পয়েন্ট, সিঙ্গাপুরের ১০ দশমিক ৭ পয়েন্ট ও জাপানের ৮ দশমিক ৮ পয়েন্ট কমেছে। এসব দেশ নিউট্রল বা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে চরম নিরাশার বা হতাশাপূর্ণ দেশের পর্যায়ে নেমে গেছে।

দেশভিত্তিক বিস্তারিত ফলাফল

● মাস্টারকার্ডের এই সূচকে ভারত আগের মতো শীর্ষ সারিতেই রয়েছে। দেশটির স্কোর ৭ দশমিক ৫ পয়েন্ট বেড়ে ৯৭ দশমিক ৬ পয়েন্টে উঠেছে। ফলে ভারত ভোক্তাদের কাছে সর্বোচ্চ আস্থা ও আশাবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

● মালয়েশিয়ার স্কোর ৯ দশমিক ৫ পয়েন্ট বেড়ে হয়েছে ৪১ দশমিক ৪ পয়েন্ট। জরিপে এই দেশ পাঁচটি বিষয়ের সব কটিতে এগিয়েছে। এর মধ্যে শেয়ারবাজার বিষয়ে ১২ দশমিক ৪ পয়েন্ট ও জীবনযাত্রার মানে ১১ দশমিক ৪ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

● জরিপে ১৭টি দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার স্কোরই সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৭ পয়েন্ট কমে ৬১ দশমিক ৮ পয়েন্টে নেমে গেছে। দেশটি জরিপের পাঁচটি বিষয়ের সবকটিতেই পিছিয়েছে। এর মধ্যে কর্মসংস্থানে ২৬ দশমিক ৯ পয়েন্ট ও অর্থনীতিতে ২২ দশমিক ৫ পয়েন্ট স্কোর কমেছে।

● হংকংয়ের স্কোর গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মতো এ বছরের প্রথমার্ধেও কমেছে। দেশটির স্কোর ১২ দশমিক ৪ পয়েন্ট কমে ৩২ দশমিক ১ পয়েন্টে নেমে পড়েছে; যা সব দেশের চেয়ে নিচে। দেশটি জরিপের পাঁচ বিষয়ের সব কটিতে পিছিয়েছে। এর মধ্যে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত আস্থা কমেছে ২০ দশমিক ৯ পয়েন্ট।

● সিঙ্গাপুরের স্কোর ১০ দশমিক ৭ পয়েন্ট কমে ৩৩ দশমিক ৬ পয়েন্টে নেমেছে। জরিপের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে তিনটিতে দেশটির স্কোর ১০ পয়েন্টের বেশি কমেছে। এর মধ্যে জীবনযাত্রার মানে ১৪ দশমিক ৫ পয়েন্ট, দৈনন্দিন বা নিয়মিত আয়ে ১২ পয়েন্ট এবং কর্মসংস্থানে আস্থা ১১ পয়েন্ট কমেছে।

● জাপানের স্কোর আবারও কমেছে। এবারে কমেছে ৮ দশমিক ৮ পয়েন্ট। এতে দেশটির স্কোর নেমে এসেছে ৩৮ পয়েন্টে। এ নিয়ে দুটি জরিপে দেশটির স্কোর ২২ পয়েন্ট কমেছে। জাপানের শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে ৩৫ দশমিক ৯ পয়েন্ট।

● মাস্টারকার্ডের সূচকে থাইল্যান্ডের অবস্থা দুই বছর ধরেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশটির স্কোর ২০১৪ সালের প্রথমার্ধ থেকেই কমছে। জরিপের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে থাইল্যান্ডের অর্থনীতির প্রতিই মানুষের আস্থা সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৩ পয়েন্ট কমেছে।

● অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এ বছরের প্রথমার্ধের জরিপেও নিরপেক্ষ অবস্থায় আছে। সূচকে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক ১ পয়েন্ট। তবে নিউজিল্যান্ডের সূচক ৩ দশমিক ৪ পয়েন্ট বেড়েছে। এই দেশটিতে কর্মসংস্থান ও শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

● মাস্টারকার্ডের জরিপে ভিয়েতনামের স্কোর বেড়ে হয়েছে ৯৪ দশমিক ৯ পয়েন্ট। তবে এটি আগের চেয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ পয়েন্ট বেশি। মায়নামারের স্কোর ৪ পয়েন্ট বেড়ে ৯৯ দশমিক ৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। যার মানে হলো, এ দুটি দেশ এখন ভোক্তাদের কাছে সর্বোচ্চ আস্থা ও আশাবাদের জায়গা। এর মধ্যে ভিয়েতনামে শেয়ারবাজার ও মিয়ানমারে প্রোপার্টি মার্কেটের (দেশটিতে শেয়ারবাজার নেই) প্রতি জনগণের তুমুল আস্থা রয়েছে।

● মাস্টারকার্ড কনজ্যুমার কনফিডেন্স বা ভোক্তা আস্থা সূচকে চীনের স্কোর ১ দশমিক ৪ পয়েন্ট বেড়ে ৭৬ পয়েন্টে উন্নীত হওয়ায় দেশটি আশাবাদ থেকে ভীষণ আশাবাদের দেশ হয়ে উঠেছে বলা যায়। আর বাংলাদেশের স্কোর ৪ দশমিক ৩ পয়েন্ট বেড়ে ৭১ দশমিক ৬ পয়েন্টে উঠেছে। এর মানে হলো ভোক্তাদের বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন আশাবাদের দেশ।

● শ্রীলঙ্কার স্কোর ৪ দশমিক ২ পয়েন্ট ৩৮ পয়েন্টে নেমেছে। এর অর্থ, দেশটি এখন ভোক্তাদের বিবেচনায় নৈরাশ্য বা হতাশার জায়গা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.